মধ্যবিত্তের যে গল্প আপনি জানেন না
কেউ যখন সামাজিক শ্রেণিগুলো নিয়ে কথা বলে, তখন আপনার মনে কোন চিত্রটি জাগে? বিলেতের গার্ডিয়ান পত্রিকার এক পাঠক এক সময় এ বিষয়ে একটি মজার অথচ খুবই সাদামাটা একটা পর্যবেক্ষণ তুলে ধরেছিলেন। ‘উচ্চবিত্ত শ্রেণি: তোমার নাম ভবনের গায়ে। মধ্যবিত্ত শ্রেণি: তোমার নাম ডেস্কের ওপর। কর্মজীবী শ্রেণি: তোমার নাম পোশাকে।’
বাস্তবতা অবশ্য এত সরল না। আবার শ্রেণি-বৈষম্য নিয়ে লম্বা কোনো গবেষণায় ঢুকে পড়াটাও আমার উদ্দেশ্য না। বরং এটা বলা যে, যা যা এই সামাজিক শ্রেণিবিন্যাস নির্মাণ করে তার সম্পর্কে আমাদের সবার কিছু কিছু ধারণা আছে। ধনী কিংবা গরিব, আমরা সবাই আমাদের অবস্থান সম্পর্কে জানি।
আবার এটাও সম্ভব যে, প্রতিষ্ঠিত শ্রেণি ধারণার বাইরেও যে এক শ্রেণির মানুষ আছে, সেটা সম্পর্কে আমাদের ধারনাই নেই। কিংবা বিষয়টিকে আমরা খুব বেশি গুরুত্ব দেই না। তাদের ক্ষেত্রে যুতসই শব্দ যেহেতু পাওয়া যাচ্ছে না, চলুন আমরা তাদের হাইব্রিড শ্রেণি বলে ডাকি। সমাজে যাদের উপস্থিতি মধ্যবিত্তের মতো, কিন্তু যে বাস্তবতা তারা মোকাবিলা করেন, তা নিম্নবিত্ত অথবা কর্মজীবী শ্রেণির মতোই। এমন অস্পষ্ট সামাজিক পরিচয় তাদের আলাদা একটা শ্রেণিতে পরিণত করেছে। যারা একইসঙ্গে খুব অসহায়।
চলতি সপ্তাহে নারায়ণগঞ্জ সদর উপজেলার কাশীপুর ইউনিয়নের বাসিন্দা ফরিদ আহমেদের কাহিনীর ভেতর দিয়ে আমরা এই ‘আলাদা’ শ্রেণির নিজস্ব জগতের জটিল গড়ন সম্পর্কে খানিকটা ধারণা পেয়েছি।
গত ১৯ মে ফরিদ আহমেদ সরকারি হটলাইন ৩৩৩ নম্বরে ফোন করে কিছু খাদ্য সহায়তা চান। সবাই জানে, নানা ধরনের সহযোগিতার জন্য এই হটলাইনটি ব্যবহার করা যেতে পারে। সম্প্রতি এই হটলাইনের সেবার আওতায় খাদ্য সহায়তার বিষয়টিও যুক্ত করেছে সরকার।
হটলাইনে ফরিদ আহমেদের কলে সাড়া দিয়ে উপজেলা প্রশাসন তাকে সাহায্য করতে আসে। তখন তারা জানতে পারে যে, ফরিদ আহমেদ একটি চারতলা ভবন ও হোসিয়ারি কারখানার মালিক। এ অবস্থায় প্রতারণা ও সরকারি কর্মকর্তাদের ‘হয়রানি’ করার অভিযোগে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা হিসেবে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) আরিফা জহুরা ফরিদ আহমেদকে একশ লোকের জন্য খাবার আয়োজনের নির্দেশ দেন।
এই পরিস্থিতিতে তিন মাসের জেল হয়ে যাওয়ার হুমকির মুখে ফরিদ নির্দেশ পালনের জন্য ৬৫ হাজার টাকার খাদ্যসামগ্রীর প্যাকেট তৈরি করেন। প্রতিটিতে পাঁচ কেজি চাল, এক কেজি করে লবণ, আলু, পেঁয়াজ ও তেলের ওই প্যাকেটগুলো পরবর্তীতে বিতরণ করেন ইউএনও জহুরা।
গল্পটি এখানেই শেষ হতে পারতো। বাঙালি মধ্যবিত্তের অবক্ষয়ের আরও কিছু প্রমাণ নিয়ে আমরা ঘুমাতে যেতে পারতাম। কিন্তু পরবর্তীতে জানা গেল, সচ্ছল মানুষ হিসেবে পরিচিত ফরিদ আহমেদ আসলেই একজন দরিদ্র ব্যক্তি। যে সহযোগিতা তিনি চেয়েছিলেন, সেটা তার প্রয়োজন ছিল। যে বাড়িটি তার বলে প্রচার করা হয়েছিল, উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া ওই সম্পত্তির ভাগীদার তার সাত ভাই-বোন। যা তার একার বলা যায় না। ছাদের ওপর তৈরি টিনশেডের ঘরে তিনি তার স্ত্রী, দুই কন্যা ও বুদ্ধি প্রতিবন্ধী ছেলেকে নিয়ে থাকেন।
আরও জানা যায়, স্ট্রোকের রোগী ষাটোর্ধ ফরিদ আহমেদ পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি। যে হোসিয়ারি কারখানায় তিনি সামান্য বেতনে চাকরি করেন, সেটা তার নিজের বলে চালিয়ে দেওয়া হয়েছে। আর শাস্তি হিসেবে ইউএনও’র নির্দেশ পালন করতে গিয়ে তিনি স্ত্রীর গয়না বন্ধক রেখে চড়া সুদে ঋণ নিয়েছেন।
এমন অদ্ভুত পরিস্থিতি এড়ানো কঠিন। লোকটির জরুরি সাহায্যের দরকার ছিল। সহযোগিতার জন্য আবেদনের আগে তিনি ও তার পরিবারের সদস্যরা একপ্রকার না খেয়ে থাকার মতো অবস্থায় ছিলেন। কিন্তু সাহায্য পাওয়ার বদলে তারা নিগৃহীত হলেন। তাদের মতোই একশ মানুষকে খাওয়ানোর শাস্তি পেলেন। এখন যদি স্থানীয় প্রশাসন তাদের ক্ষতিপূরণ দেয়, তাহলে আর্থিক ক্ষতি হয়তো পুষিয়ে যাবে। কিন্তু এই পরিবারটির যে অবমাননা হলো, তা তাদের সারাজীবন তাড়িয়ে নিয়ে বেড়াবে। আর যে পরিস্থিতি তাদের সত্যিকার অর্থেই ক্ষুধার হুমকির মুখে ফেলেছে, তার জন্য তারা কাকে দায়ী করবেন?
সাদা চোখে দেখলে, গল্পটি অতিমাত্রায় তৎপর রাষ্ট্রের একজন নির্বাহী কর্মকর্তার দ্বারা ভুল পরিচয়ের একজন মানুষকে শাস্তির মুখে ঠেলে দেওয়ার ঘটনা। যখন এই সংক্রান্ত খবরটি ভাইরাল হলো, তখন অনেকে ওই কর্মকর্তাকে তুলোধুনো করতে শুরু করেন। একইসঙ্গে সরকারের সুরক্ষা কর্মসূচিগুলোতে সুবিধাভোগী বাছাই প্রক্রিয়ার সমালোচনা করেন তারা। পাশাপাশি আলোচনায় কথিত অপরাধের মুখোমুখি রাষ্ট্রের নির্বাহীদের অবাধ ক্ষমতা চর্চার বিষয়টিও উঠে আসে।
এর সবকিছুই ঠিক আছে। সেই সঙ্গে এটাও মনে রাখা দরকার যে, কিছু সরকারি কর্মকর্তার অদক্ষতার কারণে রাষ্ট্রের এমন একটা মহতী উদ্যোগ ভেস্তে গেছে। পাশাপাশি হটলাইনের মাধ্যমে খাদ্য সহায়তা দেওয়ার ক্ষেত্রে কারা এর সুবিধাভোগী হবেন কিংবা হবেন না কিংবা সম্ভাব্য অন্যায়কারীদের বিরুদ্ধে কী ব্যবস্থা নেওয়া হবে, তার কোনো নির্দেশনা ছিল না। সেক্ষেত্রে এটাকে একটা দুর্বল পরিকল্পনার কার্যক্রম হিসেবেও দেখা যায়।
কিন্তু সবকিছু ছাপিয়ে ফরিদ আহমেদের কাহিনীটি একইসঙ্গে আমার কাছে সমাজের মধ্যবিত্ত ও নিম্ন-মধ্যবিত্ত শ্রেণির মাঝে অবস্থানকারী হাইব্রিড শ্রেণীর অগ্নিপরীক্ষার বিষয়টিকেই মূর্ত করে তুলেছে। কল্পনা করুন তো, কোন পরিস্থিতিতে পারিবারিক সূত্রে একটি ভবনের মালিকানার দাবিদার একজন ব্যক্তি সরকারি সাহায্য চেয়েছেন। এই শ্রেণির মানুষদের আত্নমর্যাদাবোধ আছে, কিন্তু মর্যাদার সঙ্গে জীবনটাকে চালিয়ে নেওয়ার উপায় নেই!
অনেকের মতোই তারা সরাসরি সাহায্য চাইতে পারেন না। আর এমন কিছু হলে তাদের সমাজের ভ্রূকুটি সহ্য করতে হয়। তাদের সহযোগিতার সরকারের কোনো প্যাকেজ নেই। সুতরাং এটা স্পষ্ট যে, একটি বাড়ি কিংবা ফ্ল্যাট অথবা ডেস্ক না থাকাটাই দারিদ্রের একমাত্র মাপকাঠি না।
এমনকি পোশাকও দরিদ্রদের অদৃশ্য করে ফেলতে পারে। এখন তৈরি পোশাক খাতের বিপ্লবের সময়ে, ‘ভালো বাড়িতে থাকা, খাওয়া ও চিকিৎসার চেয়ে পরিপাটি পোশাক পরা সহজ’। সুতরাং সত্যিকার অর্থেই এই শ্রেণির মানুষের দুর্দশা বোঝার জন্য সবাইকে তাদের বেশভূষা ও সমৃদ্ধির চিহ্নগুলোকে অগ্রাহ্য করে তাদের মানিব্যাগের দিকে তাকাতে হবে। যা তাদের আসল অবস্থাকে উন্মোচন করতে পারে। যেমন: খাবার গ্রহণের মাত্রা কমিয়ে দেওয়া, সঞ্চয় শেষ হয়ে যাওয়া ও ঋণগ্রস্ত হয়ে পড়ার মতো বিষয়গুলো।
অর্থনীতির পরিভাষায় এই ধরনের মানুষদের অবস্থা বর্ণনার জন্য কাছাকাছি একটা পরিভাষা আছে। সেটা হচ্ছে ‘নতুন দরিদ্র’। কোভিড-১৯ মহামারি শুরুর আগে বাংলাদেশে দারিদ্রের হার ছিল ২০ দশমিক ৫ শতাংশ। তবে মহামারির সময়ে ঠিক কত সংখ্যক মানুষ দারিদ্রসীমার নিচে নেমে গেছে, তার কোনো সরকারি জরিপ এখনো হয়নি।
যদিও সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনোমিক মডেলিং (সানেম) পরিচালিত একটি জরিপের তথ্য বলছে, মোট জনগোষ্ঠীর ৪০ শতাংশ এখন দরিদ্র। পাওয়ার অ্যান্ড পার্টিসিপেশন রিসার্চ সেন্টার (পিপিআরসি) ও ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অব গভর্নেন্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (বিআইজিডি) আরেকটি জরিপ অনুসারে, মহামারির প্রভাবে দুই কোটি ৪৫ লাখ মানুষ দরিদ্র হয়ে গেছে। স্পষ্টতই মধ্যবিত্ত শ্রেণির একটা বড় অংশ এর মধ্যে পড়েছে। কারণ মহামারির কারণে অনেকে তাদের চাকরি হারিয়েছেন। নয়তো কর্তিত বেতনে তাদের চলতে হচ্ছে। আবার নগরজীবনের দৈনন্দিন খরচ মেটাতে ব্যর্থ হয়ে অনেকে কম খরচের বাসায় উঠেছেন কিংবা স্থায়ীভাবে গ্রামের বাড়িতে চলে গেছেন।
দুর্ভাগ্যজনকভাবে, পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে তৈরি হওয়া সামাজিক তারল্য ও তার ফলে সৃষ্ট নতুন দরিদ্রদের অবস্থা অনুধাবনের ব্যাপারে সরকারের নীতি ও সামাজিক পরিসরে এক ধরণের উদাসীনতা লক্ষ্য করা গেছে। নীরবে দারিদ্রের সঙ্গে লড়ে যাওয়া সুবেশী মানুষগুলোকে আমরা এখনো ক্রোধের চোখে দেখছি। এটা আমাদের উপলব্ধিতে আসছে না যে, হঠাৎ করে আয় কিংবা সামাজিক মর্যাদা কমে যাওয়ার কারণে একেক জনের জীবনে কত ধরনের পরিবর্তন আসতে পারে।
একটা বিষয় ভাবুন তো, আপনার বন্ধু কিংবা সহকর্মীদের কাছ থেকে আপনি কতবার ছুটির দিনগুলোতে ঢাকার বাইরে যাওয়ার ক্ষেত্রে মানুষের যে প্রবণতা, সেটাকে বিদ্রূপ করতে শুনেছেন?
আর্থিক ও সামাজিক অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়ে যাওয়া এসব দরিদ্র জনগোষ্ঠী এবং নতুন দরিদ্র ব্যক্তিরা কম খরচে অপেক্ষাকৃত নিশ্চিত জীবনের খোঁজে শহর ছেড়ে তাদের গ্রামের দিকে ছুটছেন। এ জন্য অনেকে ছুটির দিনগুলো বেছে নিচ্ছেন। কারণ এটাই একমাত্র সময় যখন ভালোবাসার মানুষগুলোর সঙ্গে দেখা হয়। আর আমাদের সীমাহীন জ্ঞান দিয়ে আমরা নিশ্চিত হয়ে যাচ্ছি যে, ছুটির দিনগুলোতে উপার্জনের পথ কম থাকায় তারা গ্রামে ছুটছেন। তাদের কার্যক্রমে আমরা বেশিরভাগ সচেতনতার অভাব দেখতে পাচ্ছি। তারা কী করছে, কেন করছে তা না জেনেই তাদের উপহাস করে চলেছি আমরা!
এজন্য বাংলাদেশে জীবনযাপনের ক্রমবর্ধমান ব্যয় মেটাতে যুঝতে থাকা এসব দরিদ্র জনগোষ্ঠী ও নতুন করে দারিদ্রতার শিকার মানুষগুলোকে কি দায়ী করা যায়? সুরক্ষা কর্মসূচিগুলোতে নতুন দরিদ্রদের অন্তর্ভুক্তিও নিশ্চিত করার ব্যাপারে সরকার কি যথেষ্ট উদ্যোগ নিচ্ছে? তাদের দুর্ভোগ লাঘবে আমরা নিজেরা কতটা করছি? এক সময়ের সচ্ছল ব্যক্তি যখন দরিদ্র হয়ে যান, তার মানসিক ও সামাজিক অভিঘাত কেমন হয়? এটা তাদের পছন্দ, সিদ্ধান্ত ও সামাজিক সম্পর্কগুলোকে কীভাবে প্রভাবিত করে?
এমন অনেক প্রশ্ন থেকে যায়। কিন্তু বিদ্যমান সামাজিক শ্রেণিবিন্যাসের বাইরে প্রায় অদৃশ্য ও নীরব নতুন এই মধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষগুলোর ব্যাপারে খুব কমই জবাব পাওয়া যাবে। যা অবশ্যই আরও মনোযোগ পাওয়ার দাবি রাখে।
মতামতটি ইংরেজি থেকে অনুবাদ করেছেন মামুনুর রশীদ
Comments