মমতাজউদদীন আহমদ: এক সৃষ্টিশীল অবিস্মরণীয় স্রষ্টা
স্বাধীনতা উত্তর বাংলাদেশের নাট্য আন্দোলনে তিনি পথিকৃৎ। তিনি আর সেলিম আল দীন, বাংলাদেশের নাটকের কথা বলতে গেলে অবধারিতভাবে এই দুই নাট্যকারের জীবন ও সৃষ্টি উঠে আসবে। তার মতো নাট্যকারেরাই জাগরণ সৃষ্টি করেছেন এদেশের নাট্যাঙ্গনে। এক অঙ্কের নাটক রচনায় তিনি ছিলেন পথিকৃৎ। পূর্ব পাকিস্তানের নাট্য আন্দোলন থেকে শুরু যার সূচনা, তারপর একাধারে ভাষা আন্দোলন, ৬৯ এর গণঅভ্যুত্থান মুক্তিযুদ্ধ, গ্রুপ থিয়েটার আন্দোলন, স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন সমস্ত আন্দোলনে যিনি ছিলেন প্রথম সারির মানুষ। যিনি বাংলাদেশে নাটককে এক অনন্য উচ্চতায় পৌঁছে দিয়েছেন। নাটক থেকে গণতান্ত্রিক সব আন্দোলনে যিনি ছিলেন অনবদ্য অংশ। বিশ্বব্যাপী বাংলা ও বাংলাদেশের নাটককে সর্বমহলে যিনি তুলে ধরেছেন জীবনব্যাপী একাগ্র চিত্তে, তিনি কিংবদন্তী নাট্যকার মমতাজউদদীন আহমদ।
মমতাজউদদীন আহমদের জন্ম ১৯৩৫ সালের ১৮ জানুয়ারি পশ্চিমবঙ্গের মালদহ জেলার হাবিবপুর থানার আইহো গ্রামে। তার বাবা কলিমুদ্দিন আহমদ ও মা সখিনা বেগম। মমতাজউদদীন আহমদের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার সূচনা হয় মালদহের আইহো জুনিয়র স্কুলে পাঁচ বছর বয়সে। তাদের পরিবার ছিল ভীষণ নাট্যপ্রেমী ও সংস্কৃতিবান। তাদের পারিবারিক মঞ্চে থিয়েটার হতো। আত্মীয় স্বজনের মধ্যে অনেকে শখের বশে অভিনয় করতেন। তার মামা, চাচা, ভাই সবাই অভিনয়ে পারদর্শী ছিলেন। কলকাতায় শিশিরকুমার ভাদুড়ি, অহিন চৌধুরীর নাটক দেখে বাড়িতে এসে অনুকরণ করতেন তারা।
আমার নাট্যভাবনায় মমতাজউদদীন আহমদ লিখেছিলেন, “আমার নাট্যবোধের বালককালের কথা বলতে বসেছিলাম। আমার শিক্ষক চারুচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের কথায় আসি। বেশ রাশভারী লোক, উল্টানো বিস্তৃত চুল। দেখতে ছবি বিশ্বাস। অভিজাত মুখ আর কণ্ঠ জলদ গম্ভীর। পড়াতেন কবিতা, আর মেঘনাদবধের আবৃত্তি করতেন। চোখের সামনে সব ভেসে উঠতো। মেঘনাদ রক্তের দরিয়াতে ভাসছে, তবু তার শৌর্য নিঃশেষ হয় না- সেটা আমরা দেখতে পেতাম তার কণ্ঠে। আমরা চুপ, ক্লাসটা ঠান্ডা। আমাদের বুক জুড়ে আদর শূন্যতা। তো সেই চারু বাবু আমাদের স্কুলের বার্ষিক নাটিকা পরিচালনা করতেন। আমাকে একবার দুবার মঞ্চে দাঁড়াবার সুযোগ দিয়েছিলেন। একবার মন্ত্রী। দাঁড়িয়ে থাকবো আনত মুখে, কিছু কথা নেই। একবার বার্তাবাহক ছুটে এসে বার্তা দিয়ে চলে যাবে। ব্যস এটুকুই, তাতেই আমার মন ভরে গেল। আমাকে যে নাটক করতে দিলেন তাতেই আমি ধন্য। তার চলাফেরা খুব ভালো লেগে ছিল। কোনোদিন এমন রাজকীয় হাঁটা হাঁটতে পারবো না।”
সেই স্কুলে থাকতে নাটকের প্রতি অসীম প্রেম জন্ম নিয়েছিল মমতাজউদদীন আহমদের।
দেশভাগের সময় তিনি ছিলেন সপ্তম শ্রেণির ছাত্র। দেশভাগের পর কলিমুদ্দিন আহমদ ও তার পরিবারে চলে এলেন পদ্মার এপাড়ে নিজের পূর্বপুরুষের বাড়ি চাঁপাইনবাবগঞ্জের ভোলাহাটে। ভোলাহাটে এ ভোলাহাট রামেশ্বর পাইলট মডেল ইনস্টিটিউশনে ভর্তি হলেন মমতাজউদদীন আহমদ। সেখান থেকেই ১৯৫১ সালে কৃতিত্বের সঙ্গে ম্যাট্রিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হলেন মমতাজউদদীন আহমদ।
এরপর রাজশাহী কলেজে ভর্তি হয়েছিলেন তিনি। রাজশাহী কলেজে থাকার সময়ে পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়নে যোগ দেওয়ার মধ্য দিয়ে ছাত্র রাজনীতিতে হাতেখড়ি হয় মমতাজউদদীন আহমদের। ঠিক তখন ঢাকা ছাড়িয়ে রাজশাহীতে রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের জোর হাওয়া লেগেছে। প্রতিদিনই মিছিল, মিটিং হচ্ছে। কমিউনিস্ট পার্টি, ছাত্র ইউনিয়ন থেকেও হচ্ছে নিয়মিত সভা সমাবেশ। তখন তাদের অনার্স প্রথম বর্ষের পরীক্ষা হবে কিছুদিন পরে ঠিক তখনই ২১শে ফেব্রুয়ারি ঢাকায় ছাত্রদের মিছিলে প্রশাসনের হস্তক্ষেপে নির্বিচারে গুলি চালালো পুলিশ। বেশ কয়েকজন ছাত্র শহীদ হলেন ঢাকার রাজপথে। খবর পৌঁছে গিয়েছিল রাজশাহীতেও।
২১ ফেব্রুয়ারি বিকেলে ছাত্র ইউনিয়নের সভাপতি ও রাজশাহীর ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের যুগ্ম আহ্বায়ক গোলাম আরিফ টিপুর নেতৃত্বে রাজশাহী মেডিকেলের ছাত্র এস এম গাফফারের সভাপতিত্বে এক প্রতিবাদ সভার আয়োজন করা হয়। সেখানে উপস্থিত থেকে বক্তব্যও দিয়েছিলেন মমতাজউদদীন আহমদ। গোলাম আরিফ টিপুই মূলত ছাত্র ইউনিয়নের সঙ্গেই সংশ্লিষ্ট করেছিলেন মমতাজউদদীন আহমদকে। গোলাম আরিফ টিপু তখন রাজশাহী কলেজের আইন বিভাগের অনার্সের ছাত্র। তারা ছিলেন একই মহকুমা থেকে আগত, তথা চাঁপাইনবাবগঞ্জ থেকে। ২১শে ফেব্রুয়ারি বিকেলের সেই সভায় দুটো প্রস্তাব গৃহীত হয়েছিল। এর মধ্যে একটি শহীদ ছাত্রদের স্মরণে শহীদ মিনার নির্মাণ করা হবে। ২১শে ফেব্রুয়ারি রাতে লন্ঠন, মশাল আর হারিকেন জ্বালিয়ে রাজশাহী কলেজের ছাত্ররা সারারাত জেগে রাজশাহী কলেজ হোস্টেলের মাঠে ইট ও কাদা দিয়ে বানিয়েছিলেন সেই শহীদ মিনার। শহীদ মিনারের নির্মাণ শেষে শহীদ মিনারের নামকরণ করা হয়েছিল "শহীদ স্মৃতি স্তম্ভ"। শহীদ মিনারের দেয়ালে সেঁটে দেয়া হয়ে ছিল রবীন্দ্রনাথের বিখ্যাত সুপ্রভাত কবিতার অমর সেই দুটি চরণ;
“উদয়ের পথে শুনি কার বাণী,
ভয় নাই ওরে ভয় নাই।
নিঃশেষে প্রাণ যে করিবে দান,
ক্ষয় নাই তার ক্ষয় নাই।”
রাজশাহী কলেজে নির্মিত সেই শহীদ মিনার ছিল দেশের সর্বপ্রথম শহীদ মিনার। কিন্তু পরদিন পুলিশ সেই শহীদ মিনার ভেঙে দিয়েছিল।
১৯৫৩ সালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলায় বিএ'তে ভর্তি হলেন মমতাজউদদীন আহমদ। এরপর একই বিশ্ববিদ্যালয়ে এমএ তেও। তখন ছাত্র ইউনিয়নের বিশ্ববিদ্যালয়সহ রাজশাহী জেলার বিভিন্ন শাখার দায়িত্বে ছিলেন তিনি। বিশ্ববিদ্যালয়ে জীবনে ছাত্র ইউনিয়নের হয়ে ভাষা আন্দোলন, গণতান্ত্রিক আন্দোলন সংগ্রাম, নানা দাবিতে সক্রিয় থাকার কারণে ১৯৫৪, ১৯৫৫, ১৯৫৭ ও ১৯৫৮ সালে তাকে কারাগারেও বহুদিন থাকতে হয়েছিল। বিশ্ববিদ্যালয়ে থাকা অবস্থাতে নানা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান মঞ্চে ও পথনাটকে অভিনয় করেছিলেন মমতাজউদদীন আহমদ। দিয়েছিলেন নির্দেশনাও। তবে মমতাজউদদীন আহমদের নাটক লেখার যাত্রা শুরু হয় আরো কিছুদিন পরে, ১৯৬০ সালে। ভাষা আন্দোলন নিয়ে তার লেখা প্রথম নাটক বিবাহ। বিবাহ নাটকে আমরা দেখি সখিনাকে। যে কিনা স্বপ্ন দেখেছিল তার একটি সংসার হবে, যে কিনা বধূবেশে বসার স্বপ্ন দেখেছিল, বসেছিলও। গায়ে হলুদের দিন মেহেদী মেখেছিল হাতে। কিন্তু যার সাথে তার বিয়ে হবে সেই বর ছুটে গেল মিছিলে। বায়ান্নর রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের মিছিলে। পুলিশের গুলি খেয়ে পড়ে ছিল রাজপথে। যার রক্তের বিনিময়ে প্রতিষ্ঠিত হলো বাংলা ভাষা। সখিনার অস্ফুট স্বরে আর্তনাদ তাইতো বুক ভেঙে আসে। সখিনা বলে, ‘আমার আনন্দ, গৌরব, সুখ, সংসার। কাকে দেবো, কেমন করে দেবো ছোট মামা। হলুদ শাড়ি– আমার ওই শাড়িতে যে বেঁচে থাকার প্রদাহ, দাহ লেগে আছে। না জানা ভালোবাসা ছোট মামা, আমার এক এক করে অনেক বছরের ফাল্গুন জমে আছে। আমি যে নীড় রচনার কাজে নিমগ্ন আছি। এই দেখলাম হাঁড়িতে ভাত টগবগ করে ফুটছে, কখনো শুনছি একটি সবল নরম কণ্ঠ এসে আমাকে বলছে, চল না নৌকায় চড়ে নদীর মোহনায় যাই। কখনো শুনি একটি কচিকণ্ঠের অমৃত কান্না বলছে, মা, ওমা আমাকে কোলে নাও, ঘুম যাব। ছোট মামা আকাশ, ঘর, পানি ভরা কলসি, বর্ণপরিচয়, দুঃখ, অভিমান, আমি যে এক এক করে এত বছর, সাতশো বছর – অন্ধকার, আলো, জীবন বুনছি – আমি বাঁচার জন্য।' কেবল তাই নয়, সেই সখিনার বাবাকে চিত্রায়িত করেছেন মমতাজউদদীন আহমদ। আমরা বিবাহ নাটকে দেখি সখিনার বাবার কথা। সখিনার বাবা সখিনার মাকে বলছেন, ‘ঢাকাতে শুনছি ছাত্ররা খুব ক্ষেপে গিয়েছে আতিয়া। মিছিল করবে, হরতাল করবে। করবেই তো। বাংলাভাষা যদি না থাকে তো কিসের দেশ, কিসের স্বাধীনতা।’ আবার পরক্ষণে তার গভীরতম প্রেমও জেগে উঠেছে ভাষার প্রতি, ভাষা শহীদ হবু জামাতার প্রতি। তিনি বলছেন, 'আমার মেয়ের জামাই জালেমের গুলিতে শহীদ হয়েছে। বাংলাভাষার জন্য জীবন দিয়েছে। এ তো একটা ঘটনা না। এ তো ইতিহাস, এ তো একটা অগ্নিগিরি। আমি বলছি, আমার দেল বলছে – ওই ছেলেকে আমরা মাটির নিচে রাখব না। আমার ছেলেকে হরগিজ কবরে যেতে দেব না।'
১৯৬৪ সালে তিনি চট্টগ্রাম কলেজের বাংলা বিভাগের শিক্ষক হিসেবে যোগদানের মাধ্যমে শিক্ষকতা শুরু হয় মমতাজউদদীন আহমদের। মুক্তিযুদ্ধের সময় মমতাজউদদীন আহমদ ছিলেন চট্টগ্রামে। চট্টগ্রাম কলেজের বাংলা বিভাগের শিক্ষক হিসেবে কর্মরত। মুক্তিযুদ্ধের সময় সক্রিয়ভাবে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন তিনি। মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি লিখেছিলেন “স্বাধীনতা আমার স্বাধীনতা” নাটকটি।
স্বাধীনতা আমার স্বাধীনতা নাটকে তিনি যেমন স্বাধীনতাবিরোধী চরিত্র নূর মোহাম্মদ এর রূপ দিতে গিয়ে লিখেছিলেন, 'প্রয়োজন হলে লাখো মানুষের জীবন যাবে তবু দেশভাগ করা চলবে না।' আরেক জাগায় লিখেছিলেন ‘প্রেমের জ্বালা আর স্বাধীনতার আগুন কখনো নিভে না।'
মুক্তিযুদ্ধের পর মমতাজউদদীন আহমদ লিখেছিলেন তার বিখ্যাত “এবারের সংগ্রাম” নাটক। এবারের সংগ্রাম নাটকে আমরা দেখতে পাই, তিনি আঁকছেন একজন নির্যাতিত মানুষের অবয়ব। যেখানে সেই নির্যাতিত মানুষ হানাদারদেরকে উদ্দেশ্য করে বলছে, ‘আমার হৃদয়ের সমস্ত শক্তি দিয়ে এ আকাশ এ মাঠ আর সমুদ্রকে বলে দিচ্ছি, ভাইসব, এদের চিনে রাখ, এরা ধর্মের নামে, সংহতির নামে, নানা ফন্দির জাল বিস্তৃত করে আমাদের শোষণ করছে। আর এদের ছেড়ে দিও না। এবার এরা ঘরে ঘরে ঢুকে প্রত্যেকের সন্তানকে হত্যা করবে। এরা খুনী। মানুষের রক্তের বিনিময়ে এরা সাম্রাজ্যবাদীদের ডেকে আনে, তোমরা এদের নির্মূল কর।'
কিংবা বলা যায় তার স্বাধীনতার সংগ্রাম নাটকের জহুরুল এবং বর্ণচোরা নাটকের চরিত্র মতিউরের কণ্ঠে প্রতিবাদ, প্রতিরোধ এবং স্বাধীনভাবে বাঁচার স্পৃহা।
মুক্তিযুদ্ধের পর একে একে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নাট্যকলা ও সংগীত বিভাগের অধ্যাপনা করেছেন মমতাজউদদীন আহমদ। শিক্ষক হিসেবে তিনি ছিলেন ছাত্রদের কাছে অসম্ভব জনপ্রিয়। ছাত্ররা তার ক্লাস মিস করতে চাইতো না। পরবর্তীতে ১৯৭৭-৮০ সালে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমিতে গবেষণা ও প্রকাশনা বিভাগের পরিচালক ছিলেন মমতাজউদদীন আহমদ।
স্বাধীনতার এক যুগ পরে এসে তিনি রচনা করলেন তার বিখ্যাত নাটক "সাতঘাটের কানাকড়ি"। যে নাটক ঢাকার মঞ্চে আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল। তখন স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে আন্দোলন চলছে। মমতাজউদদীন আহমদ লিখলেন স্বাধীনতা বিরোধী ও স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে। এই নাটক ছিল ইজ্জতহারা মানুষের আকুতি, স্বাধীনতা বিরোধীদের উত্থান, তোষামোদকারীদের তেলবাজি, গণমানুষের প্রতিরোধ নিয়ে। যেখানে আবার তিনি যুবকদের মধ্যে জাগাচ্ছেন প্রশ্ন।
সেখানে যুবকেরা প্রশ্ন করছে। 'মুনীর চৌধুরীকে যারা হত্যা করেছে তাদের বিচার হলো না কেন?' আরেক যুবক প্রশ্ন করছে, 'জহির রায়হানের হত্যার তদন্ত হলো না কেন?' চতুর্থ যুবক যেমন প্রশ্ন করছে, 'বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারীরা ঘুরে বেড়ায় কেন?' নাটকের শেষ দিকে আমরা দেখি দাসু নামের এক সন্তান আর তার মায়ের প্রশ্ন উত্তর। যেখানে মা বলছেন, 'কারা আমার ছেলেদের ধরে ধরে ফাঁসিতে ঝুলোচ্ছেরে দাসু?' দাসু বলছে 'ওদের পরিচয় জানার দরকার নেযই, তুমি তাদের সঙ্গে পারবে না।' এবার মায়ের সেই কঠিন প্রশ্ন, 'তাহলে আমার ছেলেরা যুদ্ধ করল কেন? তাহলে আমার স্বামী জীবন দিলো কেন? তাহলে আমি ইজ্জত লুটিয়ে ঘরে ফিরলাম কেন?' এই প্রশ্নের জবাব কি আমাদের কাছে আছে?
১৯৮৩-৮৪ সালে এসে 'কী চাহ শঙ্খচিল' নাটকে মমতাজউদদীন আহমদ যেমন লিখলেন এক অনন্য প্রেম, স্বাধীনতা আর প্রতিবাদের কথা। যেখানে শঙ্খচিল আসলে হয়ে উঠলো সেই একাত্তরের শকুন। যে ছিল স্বাধীনতাকালীন সময়ের অশুভ শক্তি। যেখানে আমরা দেখি নাটকের প্রধান চরিত্র রৌশনারা হানাদারদের দ্বারা লাঞ্ছিত হওয়ার আগেই সন্তানসম্ভবা হয়। আর লোভী স্বামী বীরাঙ্গনা স্ত্রীর নাম ভাঙিয়ে হয় অর্থের মালিক। এরপর আমরা দেখি তার সন্তান লালনকে অপবিত্র ভেবে হত্যা করে স্ত্রীকে পাগল বানিয়ে মানসিক হাসপাতালে পাঠিয়েছে লোভী স্বামী। তখন সন্তানহারা মা চিৎকার করে বলে, ‘যুদ্ধকে নিয়ে তোমরা ভাগ্য গড়ে নাও, সাধের সিংহাসন মজবুত করো, পৃথিবীর রঙকে মলিন করো, আমি তো প্রতিবাদ করিনি। আমি তো সূর্যের আলোতে মুখ দেখাতে চাইনি, কিন্তু আমার সন্তানকে নিয়ে তোমরা বাণিজ্য করতে চাও কেন? আমার সন্তানের পরিচয়কে তোমরা অপবিত্র কর কেন? আমাকে নিয়ে তোমাদের এত উল্লাস কেন? কী পেয়েছি আমি? মায়ের কোলে বাচ্চা নাই, মানুষের চোখে নিদ নাই, নদীর বুকে পানি নাই। কেমন স্বাধীনতা? তোমার মাথার উপর থাইক্কা উড়াজাহাজের মতোন জল্লাদ পাখি তাড়াইতে পারবা? আমার মাথার আগুন নিভাইতে পারবা?’ রৌশনারার সেই প্রশ্ন আমাদের বুকের গহ্বরে গিয়ে স্পর্শ করে। কতখানি আত্মত্যাগের বিনিময়ে এসেছে স্বাধীনতা, এসেছে বাংলার এই মুক্তি।
"কি চাহ শঙ্খ চিল" ও "রাজা অনুস্বরের পালা" নাটক তো পশ্চিমবঙ্গের রবীন্দ্র ভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্যসূচিতে তালিকাভুক্ত হয়েছিল।
একে একে তার হাতে জন্ম নিলো "ক্ষত বিক্ষত", "রঙ্গপঞ্চাদশ", "প্রেম বিবাহ সুটকেশ", "জমিদার দর্পণ", "হৃদয় ঘটিত ব্যাপার স্যাপার" এর মতো অসাধারণ সব নাটক। কেবল মঞ্চেই নয়, টেলিভিশনের জন্যও নাটক লিখেছিলেন মমতাজউদদীন আহমদ।
টেলিভিশনে নাট্যকার হিসেবে মমতাজউদদীন আহমদের যাত্রা শুরু হয় ‘দখিনের জানালা’ নাটকটি দিয়ে। নাটকটির পরিচালক ছিলেন আতিকুল হক চৌধুরী। বলা যায় তার লেখা "এই সেই কণ্ঠস্বর" নাটক নিয়ে। যে নাটকে অভিনয় করেছিলেন তখনকার টেলিভিশনের সেরা জুটি আফজাল হোসেন ও সুবর্ণা মুস্তাফা। যেখানে আমরা দেখি মুক্তিযুদ্ধ ও প্রেম। কিংবা বলা যায় "সহচর" নাটকের কথা। এই নাটকে অবশ্য অভিনেতা হিসেবে ছিলেন মমতাজউদদীন আহমদ। যেখানে আমরা তাকে দেখি স্কুল শিক্ষক চরিত্রে। আরেকটা নাটকের কথা বলতেই হয়। "কূল নাই কিনার নাই" নাটক। এই নাটক রচিত হয়েছিল কাজী আবদুল ওয়াদুদের উপন্যাস অবলম্বনে। এ নাটকটি উপন্যাস থেকে নাট্যরূপ দিয়েছিলেন মমতাজউদদীন আহমদ। এই নাটকে অভিনয় করেছিলেন আসাদুজ্জামান নূর, আফজাল হোসেন ও সুবর্ণা মুস্তাফা।
হুমায়ূন আহমদের উপন্যাস “শঙ্খনীল কারাগার” অবলম্বনে একই নামে চলচ্চিত্র নির্মাণ করেছিলেন মুস্তাফিজুর রহমান। সেই চলচ্চিত্রে মতিন উদ্দিন চরিত্রে অভিনয়ের মধ্য দিয়েই অভিনেতা হিসেবে চলচ্চিত্রে অভিষেক হয়েছিল মমতাজউদদীন আহমদের।
তানভীর মোকাম্মেলের বিখ্যাত চলচ্চিত্র তিস্তা নদীর পারে চলচ্চিত্রে তো কেন্দ্রীয় চরিত্রেই অভিনয় করেছিলেন মমতাজউদদীন আহমদ। নড়াইলের ডাকাবুকো উকিল শশীভূষণ সেনগুপ্ত চরিত্রে অসাধারণ অভিনয়। এই চলচ্চিত্রে আমরা দেখি মমতাজউদদীন আহমদের শক্তিমান অভিনয়। তিনি যে কতোটা শক্তিমান অভিনেতা ছিলেন তার প্রমাণ পাওয়া যায় এই চলচ্চিত্রে।
কেবল অভিনয়ই না। চলচ্চিত্রের জন্য চিত্রনাট্যও লিখেছিলেন মমতাজউদদীন আহমদ।
হাছন রাজার জীবন ও কর্ম নিয়ে ২০০২ সালে চাষী নজরুল ইসলাম বানিয়েছিলেন বিখ্যাত চলচ্চিত্র হাছন রাজা। সেই চলচ্চিত্রের কাহিনী, চিত্রনাট্য ও সংলাপ লিখেছিলেন মমতাজউদদীন আহমদ। শ্রেষ্ঠ সংলাপ রচয়িতা হিসেবে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার না পেলেও সেই চলচ্চিত্রে সংলাপ রচনার জন্য পেয়েছিলেন বাচসাস পুরস্কার। হাছন রাজা চলচ্চিত্রে নিজে অভিনয়ও করেছিলেন সেই চলচ্চিত্রে।
মমতাজ উদ্দিন আহমদ ছিলেন অসম্ভব ক্ষুরধার প্রাবন্ধিক, গবেষক। নিজের সমগ্র শিক্ষকতা জীবন, শিল্পকলা একাডেমিতে গবেষণা ও প্রকাশনা বিভাগের পরিচালক, জাতিসংঘের বাংলাদেশের স্থায়ী মিশনে সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রী ও পরবর্তীতে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যসূচি প্রণয়নে বিশেষজ্ঞ থাকাকালীন সময়ে একদিনের জন্যও তার নিজস্ব গবেষণা থেমে থাকেনি। ছিলেন যেমন বহু মাত্রিক লেখক, ঠিক তেমনি নাট্য রচনা, নাট্য নির্দেশনার বাইরে নিজ দায়িত্বেই লিখেছেন বাংলাদেশের নাটকের ইতিবৃত্ত ও বাংলাদেশের থিয়েটারের ইতিবৃত্ত নামে দুটি অমূল্য গবেষণা। তার গদ্য রচনার সৃষ্টিও ছিল বিস্তৃত। চার্লি চ্যাপলিন-ভাঁড় নয় ভবঘুরে নয়, আমার ভিতরে আমি, জগতের যত মহাকাব্য, লাল সালু ও সৈয়দ ওয়ালিউল্লাহ, মহানামা কাব্যের গদ্যরূপ, সাহসী অথচ সাহস্য, নেকাবী এবং অন্যগণ, জন্তুর ভিতর মানুষ' এর মতো বিশাল গদ্য ভাণ্ডার ছিল অসামান্য। ভাষা আন্দোলন নিয়ে তিনি লিখেছিলেন 'একুশ আমার বাংলা আমার', লিখেছিলেন শিশু সাহিত্য ও কিশোর রচনা, সরস রচনা। তিনি একাধারে ছিলেন ঔপন্যাসিক। সজল তোমার ঠিকানা, এক যে জোড়া, এক যে মধুমতি'র মতো উপন্যাসের জন্ম তার হাতে। অনুবাদক হিসেবে মমতাজউদদীন আহমদের কথা না বললেই নয়। বিশেষ করে ফেরদৌসির রচিত শাহনামা তিনি অনুবাদ করেছিলেন। তার সৃষ্টির বিস্তৃতি যে কতোখানি ছিল তা অবর্ণনীয়।
সমস্ত কিছুর বাইরে কেবল এক অতুলনীয় নাট্যকারের পরিচয়ই সবার আগে আসে। বাংলা ও বাংলাদেশের নাটকে তিনি যে জোয়ার আর সৃষ্টির মহিমায় মেতে উঠেছিলেন তা বাংলা নাটককে এগিয়ে দিয়ে ছিল কয়েক যুগ। বাংলা নাটকের এই কিংবদন্তি স্রষ্টার হাত ধরে স্বাধীনতা উত্তর বাংলাদেশের নাটক প্রাণ ফিরে পেয়েছিল। গণ মানুষের ভাষ্য, নির্যাতিত, নিপীড়িত মানুষের কথা, প্রান্তিক মানুষের জীবনাচার, লোককথা, স্বাধীনতা, মুক্তি, স্বপ্ন, স্বপ্নভঙ্গ, আশা, হতাশা, সমস্তই উঠে এসেছিল তার নাটকে। জন্ম নিয়েছিল বাংলা নাটকের এক নতুন ধারা। পূর্ব বঙ্গের বাংলা নাট্য আন্দোলন থেকে সমস্ত গণতান্ত্রিক আন্দোলনে তিনি ছিলেন অগ্রভাগের সৈনিক। তাইতো তার সৃষ্টি, তার কর্ম, তার চিন্তা আর ভাবনার প্রসারতা যুগযুগ টিকে থাকবে এই বাংলার বুকে। বাংলা নাটক যতোদিন থাকবে, এই বাংলা ভাষা থাকবে যতোদিন, এই বাংলাদেশ যতোকাল রবে, ততোদিন মমতাজউদদীন আহমদ থাকবেন চির স্মরণীয় হয়ে।
কিংবদন্তী নাট্যকার, নাট্য নির্দেশক, অভিনেতা, ঔপন্যাসিক, প্রাবন্ধিক, অনুবাদক, গবেষক, ভাষা সংগ্রামী মমতাজউদদীন আহমদের প্রয়াণ দিবস ছিল গতকাল ২ জুন। ২০১৯ সালে আমরা হারিয়েছিলাম আমাদের সাহিত্য ও নাট্যাঙ্গনের এই অনন্য মহীরুহকে। বিনম্র শ্রদ্ধা জানাই কিংবদন্তী স্রষ্টা মমতাজউদদীন আহমদের প্রতি।
তথ্যসূত্র-
আমার নাট্য ভাবনা/ মমতাজউদদীন আহমদ
মমতাজউদদীন আহমদ: অকুতোভয় নাট্যজন/ মোহাম্মদ জয়নুদ্দীন
স্বাধীনতা আমার স্বাধীনতা/ মমতাজউদদীন আহমদ
মমতাজউদদীন আহমদ স্মারক গ্রন্থ/ শাহরিয়ার মাহমুদ প্রিন্স।
আহমাদ ইশতিয়াক [email protected]
Comments