দীর্ঘমেয়াদি কর অবকাশ দেশীয় মোটরগাড়ি শিল্পের জন্যে ইতিবাচক
মোটরগাড়ি শিল্পের সঙ্গে জড়িত বিশেষজ্ঞদের মতে, প্রস্তাবিত বাজেটে ঘোষিত ২০ বছরব্যাপী কর রেয়াতের সুবিধাটি নিঃসন্দেহে বাংলাদেশের এই ক্রমবর্ধনশীল শিল্পটিকে ঈর্ষণীয় পর্যায়ে নিয়ে যাবে এবং স্থানীয় উৎপাদনের প্রচারণা করবে।
এই খাতে গ্রহণযোগ্য তথ্য-উপাত্তের অভাব থাকলেও এর সঙ্গে জড়িত ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানগুলোর ধারণা, বছরে অটোমোবাইল ও থ্রি-হুইলার বিক্রি থেকে কমপক্ষে ৪০ হাজার কোটি টাকা আসছে এবং এর বার্ষিক প্রবৃদ্ধি গড়ে ১০ থেকে ১২ শতাংশ হারে।
যদি উপকরণ বা যন্ত্রাংশের ৩০ শতাংশ স্থানীয় উৎস থেকে নেওয়া হয়, তাহলে নির্মাতা প্রতিষ্ঠানগুলো ১০ বছরের জন্য কর অবকাশ সুবিধা পাবেন। যন্ত্রাংশের ৪০ শতাংশ যদি স্থানীয় উৎস থেকে জোগাড় করা হয়, তাহলে এই সুবিধাটির মেয়াদ আরও ১০ বছর বাড়বে।
এই খাতটি এখন সম্পূর্ণরূপে আমদানি-নির্ভর। কারণ, ৫০ বছর আগে স্বাধীনতা অর্জন করলেও এখনো দেশে কোনো মোটরগাড়ি নির্মাণ কারখানা গড়ে উঠেনি।
ফলশ্রুতিতে আমরা প্রতিবছর লাখো ডলার ব্যয় করে যানবাহন আমদানি করতে বাধ্য হচ্ছি।
রানার গ্রুপের চেয়ারম্যান হাফিজুর রহমান খান বলেন, ‘এই দীর্ঘমেয়াদি নীতিমালাটি বিনিয়োগকারীদেরকে উৎসাহিত করবে এবং এই শিল্পের উন্নয়ন ঘটাবে, যা সরকারের বিচক্ষণতার প্রমাণ।’
‘বিনিয়োগকারী হিসেবে আমরা আশা করি যে সরকার ক্রমাগত আইন-কানুনের পরিবর্তন না করে এ ধরনের দীর্ঘমেয়াদি নীতিমালার মাধ্যমে এ খাতে সহায়তা দিবে’, বলেন তিনি।
হাফিজুর রহমানের মতে, এই উদ্যোগটি দেশ ও দেশের বাইরের, উভয় ধরনের বিনিয়োগকারীদেরকেই আকৃষ্ট করবে।
‘দীর্ঘ সময় ধরে চালু থাকবে এমন একটি নীতিমালার প্রচলন আমাদের দীর্ঘদিনের চাহিদা ছিল, যাতে বিনিয়োগকারীরা নিজেদেরকে প্রস্তুত করতে পারেন এবং একটি সুষ্ঠু ব্যবসায়িক পরিকল্পনা তৈরি করতে পারেন’, বলেন তিনি।
তিনি আরও বলেন, ‘আমরা বিশ্বাস করি যে “বাংলাদেশে তৈরি” পণ্যের প্রসারকে উৎসাহিত করার জন্য নেওয়া উদ্যোগগুলো ফলপ্রসূ হবে। কারণ, সরকার এ ধরনের নীতিমালার মাধ্যমে তাদের স্বদিচ্ছা প্রকাশ করেছে।’
নিটল-নিলয় গ্রুপের চেয়ারম্যান আবদুল মাতলুব আহমাদ বলেছেন, কর অবকাশের সুযোগটি এই খাতকে পরবর্তী পর্যায়ে নিয়ে যাবে।
‘আমি বিশ্বাস করি এই উদ্যোগটি আরও বিনিয়োগকে আকৃষ্ট করবে এবং এটি সরকারের পক্ষ থেকে একটি প্রশংসনীয় উদ্যোগ’, বলেন তিনি।
এর পাশাপাশি, সরকারের উচিত যন্ত্রাংশ নির্মাতাদেরকেও তাদের খাতের উন্নয়নের জন্য সহায়তা দেওয়া। যন্ত্রাংশ খাতের উন্নয়ন ছাড়া মোটরগাড়ি খাতের উন্নয়ন করা সম্ভব হবে না, বলেন তিনি।
আহমাদ আরও বলেন, সরকারের উচিত হবে যন্ত্রাংশ নির্মাতাদের অনুপ্রাণিত করার জন্য বিভিন্ন উদ্যোগ নেওয়া। যেমন: কর অবকাশ সুবিধা দেওয়া ও করমুক্ত কাঁচামাল আমদানির ব্যবস্থা করা।
তার মতে, একটি গাড়ি তৈরি করার জন্য প্রায় এক হাজারেরও বেশি ভিন্ন ভিন্ন যন্ত্রাংশ প্রয়োজন হয় এবং এ কারণেই ব্যাকওয়ার্ড লিংকেজ ও যন্ত্রাংশ নির্মাণ শিল্প মোটরগাড়ি শিল্পের জন্য এতটা গুরুত্বপূর্ণ।
পিএইচপি ফ্যামিলির ভাইস চেয়ারম্যান মোহাম্মদ মহসিন বলেছেন, কর অবকাশ বিনিয়োগকে আকৃষ্ট করবে। পিএইচপি ফ্যামিলির অন্যতম অঙ্গ সংগঠন পিএইচপি অটোমোবাইলস চট্টগ্রামে প্রোটন ব্র্যান্ডের চারটি মডেলের গাড়ি সংযোজন করে।
তিনি আরও বলেন, এই উদ্যোগটি এই খাতের উন্নয়নে সহায়তা করবে এবং কর্মসংস্থান তৈরি করবে।
এই বিশেষ সুবিধাটির জন্যে তিনি সরকারকে ধন্যবাদ জানিয়ে বলেন, এটি ব্যাকওয়ার্ড লিংকেজ শিল্পের উন্নয়ন ঘটাবে।
তার মতে, প্রায় তিন হাজার লঘু প্রকৌশল প্রতিষ্ঠান এই উদ্যোগের কারণে উপকৃত হবে এবং তাদের পণ্যের মান উন্নয়নের জন্য ভালো একটি ক্ষেত্র তৈরি হবে।
উপযুক্ত স্থানীয় নির্মাতার অভাবে গাড়ি সংযোজন করার জন্য বেশিরভাগ যন্ত্রাংশ মালয়েশিয়া থেকে আমদানি করে নিয়ে আসতে হয়। তিনি এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘বাংলাদেশে স্থানীয় যন্ত্রাংশ নির্মাতা প্রতিষ্ঠান প্রয়োজন।’
এ সিদ্ধান্ত গাড়ির বাজারে আরও প্রতিযোগিতামূলক মূল্য আনার ক্ষেত্রে সহায়তা করবে, বলেন তিনি।
বাংলাদেশ অটো ইন্ডাস্ট্রিজ নামক প্রতিষ্ঠানটি দেশের প্রথম বৈদ্যুতিক যান তৈরি করার কারখানাটি স্থাপন করছে। এ প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মীর মাসুদ কবির সরকারের নীতিমালা সংক্রান্ত সহায়তায় সন্তোষ প্রকাশ করেছেন।
তিনি এর সঙ্গে সংযুক্ত ন্যূনতম ১০০ কোটি টাকা বিনিয়োগের শর্তটিকেও সাধুবাদ জানান। কারণ, এতে এই নীতিমালার যথেচ্ছা ব্যবহারের সুযোগ কমে গিয়েছে।
তার মতে, যেকোরনা খাতের উন্নয়ন সরকারি নীতিমালার ওপর নির্ভর করে এবং এই নীতিমালাটি ভোক্তাদেরকে প্রতিযোগিতামূলক দামে পণ্য কিনতে সাহায্য করবে।
ইফাদ অটোসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক তাসকিন আহমেদ জানান, তারা সরকারের এই ব্যবসাবান্ধব উদ্যোগ এবং এর ফলে সৃষ্ট বিনিয়োগ সম্ভাবনার কারণে এই খাতটির সাফল্যের বিষয়ে খুবই আশাবাদী।
তিনি বিশ্বাস করেন, এর মাধ্যমে বিদেশি বিনিয়োগকারীদের আকৃষ্ট করা যাবে এবং অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অনুযায়ী একটি ভালো বাজার তৈরি করা যাবে।
তিনি বলেন, ‘আমরা (বিনিয়োগকারীরা) প্রতি বছর লাখো ডলার খরচ করি যানবাহন ও মোটরগাড়ির যন্ত্রাংশ আমদানির পেছনে। শুধুমাত্র এ কারণেই আমাদের জন্য স্থানীয় যন্ত্রাংশ নির্মাণ কারখানা প্রয়োজন।’
ইংরেজি থেকে অনুবাদ করেছেন মোহাম্মদ ইশতিয়াক খান
Comments