পশ্চিমবঙ্গের দল বদলের রাজনীতি
মুকুল রায় আবার তৃণমূল কংগ্রেসে যোগদান করেছেন। তিনি যে তৃণমূলে ফিরবেন এ নিয়ে চাপা গুঞ্জন ছিল দীর্ঘদিন ধরেই।
সদ্য সমাপ্ত পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভা নির্বাচনে বিজেপি বহু চেষ্টা করেও ক্ষমতাসীন হতে পারেনি। তবে মুকুল নিজে এই প্রথম সরাসরি ভোটে জিতে আইনসভায় প্রবেশ করেছেন। এর আগে দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনে সরাসরি ভোটে জিতে লোকসভা বা বিধানসভায় প্রবেশের সৌভাগ্য মুকুলের হয়নি।
ভারতীয় সংসদের উচ্চকক্ষ রাজ্যসভায় মুকুল রায় তৃণমূলের সংসদ সদস্য ছিলেন। তবে সেখানে যেতে সরাসরি জনগণের ভোট নয়, প্রয়োজন হয় রাজ্য বিধানসভার সদস্য বিধায়কদের ভোট।
সরাসরি জনগণের ভোটে জিতে প্রথমবারের মতো বিধায়ক হয়ে শপথ নিতে এসে মুখ্যমন্ত্রী, মন্ত্রীদের জন্যে নির্ধারিত দরজা দিয়ে বিধানসভায় মুকুলের প্রবেশ, বিধায়কদের নিয়ে বিজেপি সভাপতি দিলীপ ঘোষের বৈঠকে না গিয়ে তৃণমূল নেতা সুব্রত বক্সীর সঙ্গে একান্তে কথা- সব মিলিয়ে তার তৃণমূলে ফেরার ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছিল। অবশেষে সেই ইঙ্গিতটা বাস্তব রূপ পেল।
মুকুল রায়ের এই তৃণমূল কংগ্রেসে ফেরা পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিকে কতটা প্রভাবিত করবে তা এখন অনেকেরই প্রশ্ন। আগামী লোকসভা নির্বাচনে মুকুলের এই প্রত্যাবর্তন কি তৃণমূল কংগ্রেসকে ভারতের জাতীয় রাজনীতিতে আদৌ কোনো সুবিধা দেবে? এই প্রশ্নও মানুষের মনে ঘুরপাক খেতে শুরু করেছে।
মুকুলের এই কিছুদিন পরপর দলবদল নিয়ে আলোচনায় আমাদের প্রথমেই মনে রাখতে হবে যে, তৃণমূল কংগ্রেস ছেড়ে বিজেপিতে যোগ দেওয়ার আগে কলকাতার নন্দনে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে প্রায় দুই ঘণ্টাব্যাপী একান্ত বৈঠক করেছিলেন মুকুল। সেই বৈঠকের কয়েকদিন পরেই মুকুল যোগ দেন বিজেপিতে। সেই বৈঠকে কী আলোচনা হয়েছিল? এ নিয়ে মমতা বা মুকুল কেউই আজ পর্যন্ত মুখ খোলেননি।
মমতার সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির বিজেপির যতোই সংঘাত থাকুক না কেন, মমতা কিন্তু আজ পর্যন্ত বিজেপির মূল মস্তিষ্ক রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ সম্পর্কে কোনো কটু কথা বা আক্রমণাত্মক কথা বলেননি। অপরদিকে মুকুলকে নিয়ে তৃণমূলের নেতাদের মধ্যে যত কথাই হোক না কেন, মুকুল বা মমতা কেউই একে অপরের বিরুদ্ধে ব্যক্তিগত আক্রমণাত্মক বা অমর্যাদাকর কোনো শব্দ ব্যবহার করেননি। বরং কিছু সূত্র দাবি করছে, বিজেপিতে থাকার সময়েও মমতার সঙ্গে সৌজন্যমূলক সম্পর্ক অটুট ছিল মুকুলের।
বিজেপি বিধানসভা নির্বাচনে যে সাম্প্রদায়িক বিভাজনের পথে হেঁটেছে, মুকুল নাকি সেই বিভাজনের রাজনীতিকে সমর্থন করেননি। আরও বলা হচ্ছে, নির্বাচনে বিজেপি যেভাবে মমতাকে ব্যক্তিগত আক্রমণ করেছে সেটাও নাকি মুকুল কোনো অবস্থাতেই সমর্থন করতে পারেননি।
মুকুলের বিজেপি ছাড়ার যুক্তি দেখাতে তার ঘনিষ্ঠমহল থেকে যাই বলা হোক না কেন, বিজেপিতে থাকাকালীন মুকুল কখনও বিজেপির সাম্প্রদায়িক রাজনীতির বিরুদ্ধে একটা শব্দও উচ্চারণ করেছেন বলে ভারতের কোনো গণমাধ্যমে প্রকাশ পায়নি। শুধুমাত্র ২০২১ এর বিধানসভা নির্বাচনেই নয়, ২০১৯ এর লোকসভা নির্বাচনের সময়েও বিজেপির সাম্প্রদায়িক মেরুকরণের রাজনীতির প্রতিবাদে মুকুলকে কখনও সোচ্চার হতে দেখা যায়নি। বিগত কয়েকবছরে পশ্চিমবঙ্গের যেখানে যতো সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা হয়েছে, তার প্রতিটিতেই মুকুলের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ভূমিকার অভিযোগ উঠেছে।
মুকুলের কাঁচড়াপাড়ার বাড়ির খুব কাছে হাজিনগরে পবিত্র মহরমের সময়ে মুসলমানদের ওপর একতরফা যে আক্রমণ হয়েছিল, সেই ঘটনার সঙ্গে মুকুলের সংযোগের সুনির্দিষ্ট অভিযোগ উঠেছিল। তখন মুকুল তৃণমূলেই ছিলেন। হাজিনগর, বসিরহাট, ধূলাগড় ইত্যাদি জায়গায় মুকুলের বিজেপিতে যোগ দেওয়ার আগে-পরে যেসব দাঙ্গা হয়েছে, তার প্রত্যেকটিতেই বিজেপির মেরুকরণের রাজনীতিকে তীব্র করতে মুকুল রায়ের ভূমিকা ঘিরে অভিযোগ উঠেছে।
তাই বিজেপির সাম্প্রদায়িক রাজনীতির বিরুদ্ধে সোচ্চার থাকার জন্যে বিজেপিতে উপযুক্ত মর্যাদা মুকুল রায় পাচ্ছিলেন না বলে তার শিবির থেকে যে প্রচার চালানো হচ্ছে, সেটি একদম অন্তঃসার শূন্য। মমতার পরেই বিজেপির সঙ্গে সংযোগরক্ষাকারী হিসেবে অটল বিহারী বাজপেয়ীর আমল থেকে মুকুলের একটি সুবিদিত ভূমিকা আছে। নরেন্দ্র মোদি গুজরাট গণহত্যার পরে ভোটে জিতে আবার গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার পর মমতার প্রতিনিধি হিসেবে তাকে শুভেচ্ছা জানানোর দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল মুকুলের ওপরেই।
মুকুলের সাংগঠনিক দক্ষতা ঘিরে রাজনৈতিক মহলে বেশ নামডাক আছে। তবে এটা কতটা সাংগঠনিক দক্ষতা আর কতটা ক্ষমতার অলিন্দে থেকে ঘোড়া কেনা-বেচায় দক্ষতা অর্জন করা তা নিয়ে যথেষ্ট বিতর্ক আছে। মনে রাখা দরকার, মুকুল বিজেপিতে যাওয়ার পর তৃণমূলে সেভাবে প্রভাব ফেলতে পারেননি। তৃণমূলে থাকাকালীন মুকুলের ঘনিষ্ঠ যারা ছিলেন, তৃণমূল তাদের নানা ভাবে ছাঁটাই করলেও, তাদের গণহারে বিজেপিতে শামিল হতে দেখা যায়নি।
মুকুল রায় যখন যে দলে থেকেছেন সেখানে তার প্রভাব থাকলেও বিজেপিতে যোগ দিয়ে তৃণমূলকে বেকায়দায় ফেলার যে তর্জন-গর্জন করেছেন তার সামান্য বর্ষণও হয়নি। তৃণমূলে ফেরার পরেই মুকুল রায় বিজেপির বেশ কয়েকজন সংসদ সদস্য ও বিধায়ককে ফোনে তৃণমূলে যোগ দেওয়ার প্রস্তাব দিচ্ছেন বলে অভিযোগ তুলেছে বিজেপি।
মুকুলের এই মৌসুমি দলবদল নিয়ে যে প্রশ্নটি বড় হয়ে সামনে আসছে তা হলো- বিজেপি বা তৃণমূল কোন ধরণের রাজনৈতিক মূল্যবোধকে প্রতিষ্ঠিত করে চলেছে? নির্বাচনের একমাসের মধ্যে যখন একজন বিধায়ক দল বদল করেন, তখন নির্বাচনের সময় ভোটারদের কাছে যে রাজনৈতিক কথা তিনি বলেছিলেন সেগুলোর কোনো কিছুই কি তার মনে থাকে না? আর শাসকদল কীভাবে এই দলবদলকে প্রশ্রয় দিতে পারে?
রাজীব গান্ধীর আমলে দলত্যাগ বিরোধী আইন হয়েছিল। সেই আইনটি সময়োপযোগী করতে আজ পর্যন্ত কোনো রাজনৈতিক দল গুরুত্ব দেয়নি। আজ কেন্দ্রে বিজেপি বা রাজ্যে তৃণমূল কংগ্রেস ওই আইনটিকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে আইনসভার সদস্যপদ বজায় রেখেই দলবদলকে প্রশ্রয় দিয়ে যাচ্ছে। রাজীবের পরে যতোগুলো রাজনৈতিক দল ভারতে সরকার গঠন করেছে, তারা কেউ কখনও এই দলত্যাগ বিরোধী আইনের প্রয়োজনীয় সংশোধনের কথা বলেনি।
বামপন্থীরা একাধিক বার কেন্দ্রীয় সরকারের সমর্থক থেকেও দলত্যাগ বিরোধী আইনের সময়োপযোগী সংশোধন নিয়ে সামান্য কিছু দাবিতেই নিজেদের সীমাবদ্ধ রেখেছে। যার কারণেই শুধু মুকুল রায়ের দলবদল নয়, বিজেপি এই দলবদলের খেলা খেলে রাজ্য সরকার বদলে ফেলছে। এখন মহারাষ্ট্রে এই খেলায় মেতেছে বিজেপি।
গৌতম রায়: ভারতীয় ইতিহাসবিদ ও রাজনীতি বিশ্লেষক
Comments