মুক্তিযুদ্ধ

১৯ জুন ১৯৭১: পাকিস্তানকে সহায়তা বন্ধের অনুরোধ আইএমএফের

মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে ১৯ জুন গুরুত্বপূর্ণ ও ঘটনাবহুল একটি দিন। এদিন পূর্ব পাকিস্তান জামায়াতে ইসলামির আমির অধ্যাপক গোলাম আজম পাকিস্তানের রাওয়ালপিন্ডিতে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন।

এসময় গোলাম আজম প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানকে বলেন, ‘অখণ্ড পাকিস্তান রক্ষায় পূর্ব পাকিস্তানের মানুষ ঐক্যবদ্ধ। দেশের জন্য তারা জান কোরবান করতে রাজি আছে। পূর্ব পাকিস্তানে বিচ্ছিন্নতাবাদীরা দেশকে যখন অস্থিতিশীলতার দিকে নিয়ে যাচ্ছিল তখনই আমাদের দেশপ্রেমিক সেনাবাহিনী দেশে শান্তিশৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার লক্ষে কাজ শুরু করে। এখন কিছু বিচ্ছিন্ন ঘটনা বাদে পুরো দেশ স্থিতিশীল এবং শান্ত। আমি আশা করি শিগগির আপনি পূর্ব পাকিস্তান সফরে আসবেন।’

অন্যদিকে অধ্যাপক গোলাম আজম রাওয়ালপিন্ডিতে এক সাংবাদিক সম্মেলনে বলেন, ‘পাকিস্তান শুধু টিকেই থাকবে না, শক্তিশালীও হবে। ভারতের হাত থেকে আমাদের দেশকে আমাদেরই বাঁচাতে হবে। পূর্ব পাকিস্তানে সেনাবাহিনীর হস্তক্ষেপ ছাড়া দেশকে বিচ্ছিন্নতার হাত থেকে রক্ষা করার বিকল্প কিছু ছিল না।’

ঢাকায় এদিন

১৯ জুন পাকিস্তানের করাচী থেকে ঢাকায় ফিরে আসেন সামরিক গভর্নর জেনারেল টিক্কা খান। তিনি ঢাকায় ফেরার পর বলেন, ‘বিদেশিদের কাছে ভারতীয়দের অপপ্রচার রুখতে ও ভারতের মুখোশ খুলে ফেলতে শিগগির পূর্ব পাকিস্তানের সমন্বয়ে একটি প্রতিনিধি দল বিদেশ সফর করবেন। সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী হামিদুল হক চৌধুরীর নেতৃত্বে এই প্রতিনিধি দলে থাকবেন বিচারপতি নুরুল ইসলাম, উপাচার্য সাজ্জাত হোসাইন চৌধুরী ও পিডিবির মাহমুদ আলী।’

ভারতে এদিন

১৯ জুন ইন্দিরা গান্ধী কাশ্মীরের শ্রীনগরে এক জনসভায় বলেন, ‘পূর্ববঙ্গে এখন যা ঘটছে তা জাতীয় বিপ্লব। যুগের পর যুগ ধরে নিষ্ঠুর শাসকদের পৈশাচিকতার বিরুদ্ধে ঘুরে দাঁড়িয়েছে পূর্ব বাংলার মানুষ। কতদিন মানুষ আর মুখ বুজে সহ্য করবে?’

১৯ জুন বুদ্ধিজীবী ও শিক্ষাবিদদের নিয়ে গঠিত বাংলাদেশ সরকারের প্রতিনিধি দল দিল্লিতে পৌঁছে। দিল্লিতে এক সংবাদ সম্মেলনে প্রতিনিধি দলের নেতা চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ড. এ আর মল্লিক বলেন, ‘পাকিস্তানের সঙ্গে একটিমাত্র রাজনৈতিক সমাধান হতে পারে। আর তা হলো স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশ।’

১৯ জুন একযোগে ভারতের ট্রেড ইউনিয়নের আওতাধীন প্রতিষ্ঠানগুলোতে ‘বাংলাদেশ সংহতি দিবস’ উদযাপিত হয়। কলকাতায় এদিন বাংলাদেশ সংহতি দিবসের সমাবেশে ভারত কর্তৃক স্বাধীন বাংলাদেশের স্বীকৃতি ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মুক্তির বিষয়ে ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি জানানো হয়।

১৯ জুন ভারতের প্রতিরক্ষামন্ত্রী জগজীবন পশ্চিমবঙ্গের আসানসোলে এক জনসভায় বলেন, ‘পূর্ব বাংলা থেকে আগত শরণার্থীরা অবরুদ্ধ পূর্ব পাকিস্তানের নয় বরং শেখ মুজিবুর রহমানের স্বাধীন বাংলাদেশে ফিরতে আগ্রহী। আমরা বিশ্বব্যাপী পূর্ব বাংলায় গণহত্যা বন্ধে ও রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনতে বিশ্বব্যাপী কাজ করছি। পাকিস্তানের ওপর চাপ চলমান রাখতে আমরা শক্তিধর দেশগুলো ও জাতিসংঘকে অনুরোধ করেছি। পাকিস্তানকে দেওয়া সকল প্রকার সামরিক অস্ত্র সাহায্য ও ত্রাণ সরবরাহ বন্ধের আহ্বান জানিয়েছে আমরা। যেকোন মূল্যে পূর্ব বাংলায় গণহত্যা ও নিপীড়ন বন্ধ করতে হবে। আমরা আশা করি শিগগির আমরা দারুণ কিছু দেখতে যাচ্ছি।’

১৯ জুন ভারত এক বিজ্ঞপ্তিতে জানায় ভারতে আশ্রয়গ্রহণকারী পূর্ব বাংলা থেকে আগত শরণার্থীর সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৫৯ লাখ ২৩ হাজার চারশ ৩৯ জনে।

পাকিস্তানে এদিন

১৯ জুন ঢাকার সামরিক গভর্নর লেফটেন্যান্ট জেনারেল টিক্কা খান পাকিস্তানের করাচীতে পূর্ব পাকিস্তানে ফিরে আসার আগ মুহূর্তে বলেন, ‘পাকিস্তান জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকল খাঁটি পাকিস্তানি উদ্বাস্তুকে গ্রহণ করতে প্রস্তুত। ভারতের প্ররোচনা ও মুক্তিবাহিনীর ধ্বংসাত্মক কার্যক্রমের জন্য তারা দেশ ত্যাগ করেছেন। এখন পাকিস্তান তাদের ফিরিয়ে নিতে প্রস্তুত আছে। দুষ্কৃতকারীদের ধ্বংসাত্মক কাজের ফলে ঢাকা-চট্টগ্রাম রেল লাইনের চারটি প্রধান সেতুর ক্ষতি সাধিত হয়েছে। সেতুগুলো মেরামত ও পুনর্নির্মাণের কাজ শেষ হলে ঢাকা-চট্টগ্রাম রেল যোগাযোগ আবার চালু হবে।’

সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী হামিদুল হক চৌধুরী এদিন রাওয়ালপিণ্ডিতে বলেন, ‘এখনো পাকিস্তান গভীর সঙ্কটে ডুবে আছে। সাম্প্রতিক ঘটনা থেকে এটা প্রমাণিত হয় আগরতলা মামলা বানোয়াট ছিল না। প্রতিটি অভিযোগ পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে এখন প্রমাণিত হচ্ছে। শেখ মুজিবুর রহমান এজন্য উপযুক্ত সাজা ভোগ করবেন।’

আন্তর্জাতিক মহলে মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষে বিবৃতি

১৯ জুন ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সরদার শরণ সিং নিউইয়র্ক ত্যাগ করেন এবং এদিন লন্ডনে পৌঁছান। এই সফরে তার ব্রিটেনের রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিবর্গ ও রাজনৈতিক নেতাদের সঙ্গে বৈঠকের কথা ছিল।

ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির নেতা ভূপেন গুপ এদিন পূর্ব জার্মানির বার্লিনে সমাজতান্ত্রিক দলের অষ্টম কংগ্রেসে পূর্ব বাংলায় চলমান গণহত্যা, নিপীড়ন পৈশাচিকতার বিবরণ দেন।  তিনি তার বক্তব্যে বলেন, ‘পূর্ব বাংলায় যা হচ্ছে তার নজির পৃথিবীর ইতিহাসে আর কোথাও পাওয়া যাবে না। দিনের পর দিনে মানুষের ওপর যে নির্যাতন চালানো হয়েছে এর একমাত্র পরিণতি বাংলাদেশের স্বাধীনতা। আর কোনো রাজনৈতিক সমাধানের পথ আমার চোখে পড়ে না। পাকিস্তান সরকার নিজের পায়ে নিজেই কুড়াল মেরেছে। আমাদের উচিত পূর্ব বাংলার আর্ত নিপীড়িত মানুষের পাশে দাঁড়ানো।’

আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধ

১৯ জুন নিউইয়র্ক টাইমসের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল আইএমএফের একটি গবেষক দল পশ্চিমা দেশগুলোকে পাকিস্তানকে দেওয়া সব সহায়তা বন্ধের অনুরোধ করেছে। তারা বলেছে, পূর্ব বাংলায় গণহত্যা বন্ধের জন্য এর চেয়ে কার্যকর কোনো উপায় তাদের জানা নেই। শরণার্থীদের স্রোত থামাতে এবং যারা শরণার্থী হিসেবে ভারতে আশ্রয় নিয়েছে তাদের ফেরাতে তাহলে বাধ্য হবে পাকিস্তান সরকার।’

অন্যদিকে ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সরদার শরণ সিং-এর কূটনৈতিক তৎপরতার ভূয়সী প্রশংসা করা হয় প্রতিবেদনটিতে।

প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘সরদার শরণ সিং একদিকে তো প্রেসিডেন্ট থেকে সিনেটের প্রভাবশালী সদস্যদের কাছে পূর্ব বাংলার পরিস্থিতি সম্পর্কে খোলাসা করেছেন, অন্যদিকে আইএমএফ বিশ্ব ব্যাংকের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিবর্গের সঙ্গেও আলোচনা করে উপযুক্ত উদ্যোগ নেওয়ার অনুরোধ করেছেন। মূলত সরদার শরণ সিং যখন নিউইয়র্ক থেকে লন্ডনের উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করেন ঠিক তার প্রস্থানের পরেই আইএমএফ এই অনুরোধ করে।’

দেশব্যাপী গণহত্যা ও প্রতিরোধ যুদ্ধ

১৯ জুন কুমিল্লায় মুক্তিযোদ্ধারা মন্দভাগের কাছে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর এক প্লাটুন সৈন্যকে এ্যামবুশ করে। এসময় হানাদার বাহিনীর নয় সেনা নিহত হয় এবং বাকি সেনারা মন্দভাগ গ্রামের দিকে পালিয়ে যায়।

১৯ জুন পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর দুই ব্যাটালিয়ন সৈন্য ফেনী ও লাকসামের দিক থেকে মুক্তিবাহিনীর চৌদ্দগ্রাম ঘাঁটির ওপর প্রবল আক্রমণ চালায়। দিনব্যাপী যুদ্ধের পর মুক্তিযোদ্ধারা চৌদ্দগ্রাম ঘাঁটি ত্যাগ করে। তবে এই যুদ্ধে হানাদার বাহিনীর ব্যাপক ক্ষতি হয়। হানাদার বাহিনীর ২০০ সৈন্য হতাহত হলেও,  দু’জন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন এবং চার জন আহত হন।

১৯ জুন পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ফেনীর ছাগলনাইয়া উপজেলার চাঁদগাজীতে মুক্তিযোদ্ধা ঘাঁটির ওপর হামলা চালায়। এ সময় হানাদার বাহিনীর দুটি পদাতিক বাহিনীর ব্যাটালিয়ন পিছন দিক থেকে মুহুরি নদী দিয়ে স্পিডবোটে করে একটি কোম্পানি ও পাকিস্তানিদের রিয়ার হেড কোয়ার্টার থেকে আরেক দল আর্টিলারি, মর্টার ও অন্যান্য স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রের সাহায্যে ত্রিমুখী আক্রমণ চালায়। এই সংঘর্ষে মুক্তিবাহিনীর ব্যাপক ক্ষতি হয়। হানাদারদের প্রায় ১৫০ সৈন্য নিহত হয়। পরিস্থিতি বিপজ্জনক দেখে পরবর্তীতে মুক্তিযোদ্ধারা চাঁদগাজীর দখল ছাড়তে বাধ্য হয়। অন্যদিকে হানাদার বাহিনী চাঁদগাজীর দখল নিয়ে নেয়।

১৯ জুন মুক্তিবাহিনী বড়পুঞ্জি সাব-সেক্টর কমান্ডার ক্যাপ্টেন রবের নেতৃত্বে এক কোম্পানি মুক্তিযোদ্ধা মৌলভীবাজার জেলার বড়লেখা থানায় হানাদার বাহিনীর সীমান্ত ঘাঁটি লাঠিটিলা আক্রমণ করে। তুমুল যুদ্ধের পর লাঠিটিলা মুক্তিবাহিনীর দখলে চলে আসে। এ যুদ্ধে চার জন মুক্তিযোদ্ধা আহত হন। অন্যদিকে হানাদার বাহিনীর ২২ বেলুচ রেজিমেন্টের একজন হাবিলদার ও এক সিপাহি মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে ধরা পড়ে। যুদ্ধের পর প্রচুর অস্ত্র এবং গোলাবারুদ মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে আসে।

সূত্র:

বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ: দলিলপত্র- অষ্টম, নবম, দ্বাদশ, ত্রয়োদশ খণ্ড ও চতুর্দশ খণ্ড। 

দৈনিক পাকিস্তান ২০ জুন ১৯৭১

দৈনিক অমৃতবাজার পত্রিকা ২০ জুন ১৯৭১ 

আহমাদ ইশতিয়াক, [email protected]

আরও পড়ুন:

Comments

The Daily Star  | English

No price too high for mass deportations

US President-elect Donald Trump has doubled down on his campaign promise of the mass deportation of illegal immigrants, saying the cost of doing so will not be a deterrent.

5h ago