তিউনিসিয়ায় নৌকাডুবি: এক মাসেও খোঁজ মেলেনি ১৩ বাংলাদেশির
তিউনিসিয়ায় নৌকাডুবিতে নিখোঁজ ১৩ অভিবাসনপ্রত্যাশী বাংলাদেশির একমাসেও খোঁজ মেলেনি। তিউনিসিয়ান কোস্টগার্ড, রেডক্রিসেন্ট ও অভিবাসন কর্তৃপক্ষ থেকে তাদের জীবিত বা মরদেহ উদ্ধারের নিশ্চিত কোনো তথ্য পায়নি বাংলাদেশ দূতাবাস।
দুর্ঘটনার এতদিন পরও উদ্ধারের কোনো খবর না পাওয়ায় তাদের বেঁচে থাকার সম্ভাবনা ক্ষীণ বলে ধারণা করা হচ্ছে। উদ্ধার বাংলাদেশিদের ভাষ্য থেকেও তেমন ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে। তবে মরদেহ উদ্ধার না হওয়া পর্যন্ত তাদের 'মৃত' বলার সুযোগ নেই বলেই জানিয়েছে সংশ্লিষ্টরা।
অন্যদিকে উদ্বেগ, উৎকণ্ঠা নিয়ে দেশে অপেক্ষায় থাকা স্বজনরা তাদের খোঁজের আশায় নিয়মিত যোগাযোগ রাখছেন দূতাবাস ও উদ্ধার হওয়া বাংলাদেশিদের সঙ্গে।
গত ১৭ মে মধ্যরাতে লিবিয়া থেকে ইতালি যাওয়ার সময় ভূমধ্যসাগরে তিউনিসিয়া জলসীমায় ঝড়ের কবলে পড়ে নৌকাটি ডুবে যায়। ৮১ জন বাংলাদেশির মধ্যে ৬৮ জনকে জীবিত উদ্ধার করে দেশটির নৌবাহিনী ও কোস্টগার্ড।
ঘটনার দুই দিন পরই লিবিয়ায় বাংলাদেশ দূতাবাসের চার্জ দ্য অ্যাফেয়ার্স (ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রদূত) গাজী মো. আসাদুজ্জামান কবিরের নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধি দল তিউনিসিয়ায় যায়। তারা উদ্ধার হওয়া বাংলাদেশিদের কাছ থেকে ১৩ জন নিখোঁজের বিষয়টি জানতে পারেন। এ ছাড়া দেশ থেকে নিখোঁজ কয়েকজনের পরিবারও দূতাবাসের সঙ্গে যোগোযোগ করে তাদের নৌকায় থাকার বিষয়টি নিশ্চিত করে।
চার্জ দ্য অ্যাফেয়ার্স গাজী মো. আসাদুজ্জামান কবির দ্য ডেইলি স্টারকে জানান, নিখোঁজ বাংলাদেশিদের মধ্যে মাদারীপুরের সেন্টু মণ্ডল, আখতারুজ্জামান ইলিয়াস, সাইফুল ইসলাম হাওলাদার, রাজন চৌকিদার, মোহাম্মদ নাজিম, টাঙ্গালের মো. আলমের পরিচয় নিশ্চিত হওয়া গেছে। এছাড়া মাদারীপুরের মিনটু হাওলাদার ও বরিশালের আল আমিন নামে দুই জনের বিষয়ে তথ্য পাওয়া গেলেও নিশ্চিত হতে পারেনি দূতাবাস।
ঘটনার ৫ দিন পর তিউনিসিয়ায় হোটলে থাকা উদ্ধার হওয়া বাংলাদেশিদের কয়েকজনের সঙ্গে দ্য ডেইলি স্টারের কথা বলার সুযোগ হয়। তাদের কাছ থেকে জানা যায়, বেশিরভাগই রমজানের আগে ঢাকা থেকে প্রথমে দুবাই এবং সেখান থেকে চাটার্ড ফ্লাইটে লিবিয়ার বেনগাজি পৌঁছান।
১৬ মে রাতে লিবিয়ার রাজধানী ত্রিপোলি থেকে ২০০ কিলোমিটার দূরে জাওয়ারা এলাকা থেকে তাদের নৌকাটি ইতালির দিকে রওনা হয়। একটানা ২০ ঘণ্টা উত্তাল সাগর পাড়ি দেওয়ার পর আচমকা ঝড়ের কবলে পড়ে নৌকাটি ডুবে যায়। অনেকে সাতার কেটে তেল-গ্যাসের ভাসমান প্ল্যাটফর্মে পৌঁছালে সেখানে তাদের তুলে নেওয়া হয়। বাকিদের নৌবাহিনী ও কোস্টগার্ডের জাহাজ এগিয়ে এসে সাগর থেকে তুলে নেয়।
মৃত্যুর মুখ থেকে বেঁচে আসা বরিশালের মুলাদী উপজেলার ওলিউল্লাহ খান বলেন, ‘হঠাৎ ঝড়ের ঝাপটায় নৌকাটি কাত হতেই যাত্রীদের অনেকেই সাগরে পড়ে যান। এদের মধ্যে নৌকার ক্যাপ্টেনের স্ত্রী ও দুই শিশু সন্তান এবং আমাদের বেশ কয়েকজন বাংলাদেশি ভাইও ছিলেন। উদ্ধারের পর তাদের মধ্যে কয়েকজনকে আর দেখতে পাইনি।’
মাদারীপুরের আল আমিন জানান, কারো কাছেই লাইফ জ্যাকেট বা রাবার টায়ার ছিল না। খারাপ আবহাওয়ায় উত্তাল সাগরে অনেককে ডুবে যেতে দেখা যায়।
জানা গেছে উদ্ধার ও নিখোঁজ বাংলাদেশিদের বেশিরভাগই মাদারীপুর জেলার বাসিন্দা। তাদের বয়স ১৮ থেকে ৪৪ বছরের মধ্যে।
মাদারীপুর সদর উপজেলার নয়াচর গ্রামের ১৪ জনের উদ্ধারের খবর নিশ্চিত হলেও একই গ্রামের ৪৪ বছর বয়সী সেন্টু মণ্ডলের খোঁজ এখনও মেলেনি।
নিখোঁজ সেন্টু মণ্ডলের স্ত্রী সাথী আক্তার বলেন, ‘আমার স্বামীর খোঁজ পাইনি। তিনি বেঁচে আছেন কি না তাও জানি না’।
সেন্টু মণ্ডলের ভাতিজা আহমেদ রনি বলেন, ‘আমরা নিশ্চিত চাচা ওই নৌকায় ছিলেন। দূতাবাস জানিয়েছে উদ্ধার বাংলাদেশিদের মধ্যে তিনি নেই, খোঁজ পেলে দ্রুত জানানো হবে। সেই আশায় আছি।’
নিখোঁজ আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের স্ত্রী লায়লা আকতার বলেন, ‘আমার স্বামী ১৬ মে ফোনে রাতে রওনা দেওয়ার কথা জানিয়েছিলেন। ১৮ তারিখ নৌকাডুবির পর থেকে তার আর খোঁজ পাচ্ছি না। সঙ্গী আরেক বাংলাদেশি ভাই জানিয়েছে, ডুবে যাওয়ার সময় তিনিও সাতার কেটে বাঁচার চেষ্টা করেছিলেন। এরপর তাকে আর পাওয়া যায়নি। আমরা এখন বিধাতার ভরসায় আছি।’
চার্জ দ্য অ্যাফেয়ার্স গাজী মো. আসাদুজ্জামান কবির বলেন, ‘সংশ্লিষ্ট সবগুলো সংস্থার সঙ্গে দূতাবাসের সার্বক্ষণিক যোগাযোগ আছে। তিউনিসিয়াই শুধু নয়, লিবিয়াসহ আশপাশের কোথাও যদি নিখোঁজ বাংলাদেশি কাউকে জীবিত কিংবা কারও মরদেহ পাওয়া গেলে সেই খবর আমরা দ্রুত পেয়ে যাবো।’
ঘটনার আগের দিন সাগর পাড়ি দেওয়ার সময় ডুবতে যাওয়া একটি নৌকা থেকে ৫২ জন এবং গত ২৭ ও ২৮ মে আরও ১৭৯ জন বাংলাদেশিকে উদ্ধার করা হয়। সব মিলিয়ে মে মাসে তিউনিসিয়া উপকূল থেকে উদ্ধার ২২১ জন বাংলাদেশিকে এখন আইএমও ও রেড ক্রিসেন্টের তত্ত্বাবধানে দেশটির ৫টি শহরে ডিটেনশন সেন্টারে রাখা হয়েছে।
দূতাবাসের কর্মকর্তারা তিউনিশিয়ায় ১০ দিন অবস্থান করে তাদের তালিকা করেন এবং প্রয়োজনীয় সহায়তা দেন। এছাড়া তাদের কাউন্সেলিংও করা হয়। এর মধ্যে ৪৫ জন আইওএমের সহায়তায় দেশে ফেরার আগ্রহ জানিয়েছে। নিয়ম অনুযায়ী বাকিরা সেন্টারে থাকার সুযোগ পাবেন, জানিয়েছেন চার্জ দ্যা অ্যাফেয়ার্স।
এর আগে সর্বশেষ ২০১৯ সালের মে মাসে তিউনিসিয়ার উপকূলে নৌকাডুবিতে ৪৫ জন বাংলাদেশি নিখোঁজের খবর পাওয়া গিয়েছিল। পরে ২৭ জনের পরিচয় নিশ্চিত করতে পেরেছিল রেডক্রিসেন্ট। ওই ঘটনায় ১৪ জনকে জীবিত এবং একজনের মরদেহ উদ্ধার হয়েছিল।
জানা গেছে, লিবিয়া এবং তিউনিসিয়া থেকে অভিবাসীদের ইউরোপে প্রবেশের অন্যতম প্রধান পয়েন্ট ইতালি। দেশটি অভিমুখী নৌকাগুলো লিবিয়া থেকে সরাসরি না গিয়ে প্রায়ই তিউনিসিয়া উপকূল হয়ে ভূমধ্যসাগর পাড়ি দেয়ার চেষ্টা করে।
তিউনিসিয়ার বেসরকারি সংস্থা ফোরাম ফর সোশ্যাল অ্যান্ড ইকোনমিক রাইটস জানিয়েছে, এ বছরের শুরু থেকে তিউনিসিয়ার জলাসীমায় এবং সমুদ্র সৈকতে কমপক্ষে ১৫৩ জন অভিবাসীর মরদেহ পাওয়া গেছে এবং অনেকে নিখোঁজ রয়েছে।
তিউনিসিয়ান ন্যাশনাল গার্ড জেনারেল অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, এ বছরের ৩১ মে পর্যন্ত তিউনিয়ার জলসীমায় ইতালিমুখী ৩০৮টি অবৈধ অভিবাসন অপারেশন ঠেকানো হয়। এ সময় উদ্ধার ৪৩৭৬ জনের মধ্যে ২৫৩১ জন বিদেশি।
এজাজ মাহমুদ, ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক
আরও পড়ুন:
তিউনিসিয়া উপকূলে নৌকাডুবি: ৬৮ বাংলাদেশি উদ্ধার, নিখোঁজ ১৩
Comments