অনলাইন জুয়া: পাচার হচ্ছে কোটি কোটি টাকা
আন্তর্জাতিক একটি জুয়া চক্র প্রতিদিন দেশ থেকে কোটি কোটি টাকা পাচার করে ক্রিপ্টোকারেন্সিতে (ভার্চুয়াল মুদ্রা) বিনিয়োগ করছে বলে জানিয়েছেন আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা।
গত ১৪ জুন রাজধানীর বাড্ডা থেকে মো. মহিউদ্দিন পারভেজ (২৭) নামে এক ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করে পুলিশের কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি) ইউনিট। এরপরই এসব তথ্য সামনে আসে। তার কাছ থেকে ছয়টি ল্যাপটপ ও পাঁচটি মোবাইল ফোন উদ্ধার করে পুলিশ।
সিটিটিসির অতিরিক্ত উপকমিশনার তোহিদুল ইসলাম জানিয়েছেন, ইলেক্ট্রিক্যাল অ্যান্ড ইলেক্ট্রনিক ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে (স্নাতক) ডিগ্রি নেওয়ার পরে পারভেজ গত সাত মাস ধরে চারটি এজেন্ট অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে অনলাইন জুয়া খেলার সাইটগুলোতে কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছিলেন। এর মাধ্যমে দৈনিক গড়ে দেড় লাখ টাকা পর্যন্ত আয় করতেন তিনি।
তোহিদুল ইসলাম আরও জানান, পারভেজ এই চারটি অ্যাকাউন্টে প্রতিদিন ৫০ লাখ টাকা পর্যন্ত লেনদেন করতেন। ১৪ জুন ধরা পড়ার আগ মুহূর্তে তিনি দেশের বিভিন্ন ব্যাংক অ্যাকাউন্টে প্রায় ৮২ লাখ টাকা জমা করেন। তিন দিন রিমান্ডে থাকার পর গতকাল শনিবার ঢাকার একটি আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন পারভেজ।
‘পারভেজের মতো এজেন্ট অ্যাকাউন্ট থাকা এক ডজনেরও বেশি মানুষের তথ্য আছে আমাদের কাছে। তারা আমাদের নজরদারিতে আছে। এই দুই হাজার ৩০০টি জুয়ার এজেন্ট অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে দেশ থেকে প্রতিদিন অন্তত ৫০ কোটি টাকা বিদেশে পাচার করা যেতে পারে’, বলেন তোহিদুল ইসলাম।
সিটিটিসির কর্মকর্তারা রাশিয়া ও সাইপ্রাসের দুই ব্যক্তিকে এ চক্রের হোতা হিসেবে চিহ্নিত করেছেন জানিয়ে তোহিদুল বলেন, ‘তাদের ধরতে ইন্টারপোলের সহযোগিতা চাইব আমরা।’
দেশের জুয়াড়িরা বেশির ভাগ টাকা ব্যয় করে থাকেন মূলত অনলাইন ক্যাসিনোগুলোতে ফুটবল বা ক্রিকেটের মতো আন্তর্জাতিক খেলায় এবং কম্পিউটার ও অন্যান্য ডিভাইসে খেলা গেমগুলোর ওপর বাজি ধরে।
সিটিটিসির কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, ওয়ানএক্সবেটডটকম, মেলবেটডটকম এবং লাইনবেটডটকম বাংলাদেশের জনপ্রিয় তিনটি জুয়ার সাইট। এসব সাইট রাশিয়া থেকে পরিচালনা করা হয়। জুয়াড়িদের জেতা অর্থ অবৈধ পথে রাশিয়ার পরিচালকদের হাতে পৌঁছে যায়।
জুয়াড়িদের বেশিরভাগ টাকা বিভিন্ন পোশাক কোম্পানির নামে থাকা ব্যাংক অ্যাকাউন্টে গিয়ে জমা হয়। পরে এই অর্থ দেশের বাইরে পাচার করে দেওয়া হয়। এ সংক্রান্ত নথিকে কাঁচামাল আমদানির নথি দাবি করে মিথ্যা তথ্য দেওয়ার মাধ্যমে পুলিশকে ফাঁকি দেয় এসব কোম্পানি।
তদন্তকারী কর্মকর্তাদের পারভেজ জানিয়েছেন, মাইকেল ভিক্টর নামে এক ব্যক্তির সঙ্গে পরিচয়ের মাধ্যমে এ পথে যাত্রা শুরু হয় তার। ভিক্টরের কাছে অনলাইন জুয়ার সাইট ওয়ানএক্সবেটডটকমে একটি এজেন্ট অ্যাকাউন্ট চান তিনি। এরপর ভিক্টর তাকে বিস্তারিত ব্যক্তিগত তথ্য জানাতে বলেন। এসব তথ্য দেওয়ার পর টম নামে একজন তার সঙ্গে যোগাযোগ করেন এবং একটি বাংলাদেশি ফ্যাশন হাউজ ও একটি আইটি ফার্মের ব্যাংক অ্যাকাউন্টে পাঁচ হাজার মার্কিন ডলার জমা দিতে বলেন। টাকা জমা দেওয়ার পর পারভেজ সাইটে এজেন্ট অ্যাকাউন্ট খুলতে পারেন। পরে ক্রিপ্টোকারেন্সির মাধ্যমে এই টাকা এজেন্টের কাছে ফেরত পাঠানো হয়। বাংলাদেশে ক্রিপ্টোকারেন্সি অবৈধ।
তোহিদুল বলেন, ‘আমাদের তালিকায় বেশকিছু দেশীয় ফ্যাশন হাউজ ও আইটি ফার্ম আছে। জুয়া চক্রের সঙ্গে তাদের সংশ্লিষ্টতার বিষয়ে তদন্ত করছি আমরা।’
পারভেজ আরও জানিয়েছেন, তার মতো এজেন্টরা মূলত স্থানীয় জুয়াড়িদের কাছ থেকে মোবাইল ফিন্যান্সিয়াল প্ল্যাটফর্মের (এমএফএস) মাধ্যমে টাকা সংগ্রহ করে থাকেন।
এমএফএসে কয়েকটি করে এজেন্ট অ্যাকাউন্ট থাকে এজেন্টদের। কোনো জুয়াড়ি এমএফএসের মাধ্যমে টাকা জমা দিলে সেই টাকা দেশের বাইরে স্থানান্তর করা এবং সাইট পরিচালকদের হাতে পৌঁছে দেওয়ার কাজটি নিশ্চিত করেন এ এজেন্টরা।
এসব সাইটগুলো মুদ্রা হিসেবে ক্রিপ্টোকারেন্সি ব্যবহার করে বলে জানিয়েছেন তদন্তকারীরা।
পরিচয় গোপন রাখার শর্তে সিটিটিসির উচ্চ পদস্থ এক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, ‘রাজধানীতে আমরা বেশ কয়েকটি বিকাশ এজেন্ট অ্যাকাউন্ট পেয়েছি, যেগুলোতে অনলাইন জুয়াড়িদের পাঠানো টাকা গ্রহণ করা হয়। ভুয়া তথ্য ও ট্রেড লাইসেন্স ব্যবহার করে এসব বিকাশ অ্যাকাউন্ট খোলা হয়েছে বলে জানতে পেরেছি।’
এ ছাড়া, পারভেজের মতো স্থানীয় এজেন্টরা টাকা লেনদেনের কাজে স্বীকৃত কিছু অনলাইন পেমেন্ট ব্যবস্থাও ব্যবহার করেন। টাকা পাওয়ার পর পারফেক্ট মানি, স্ক্রিল, পেপল ও নেট হিলারের মতো অনলাইন পেমেন্ট ব্যবস্থার মাধ্যমে জুয়াড়ির অ্যাকাউন্টে তা ফেরত দেওয়া হয়। এরপর জুয়াড়িরা সাইটগুলোতে এ টাকা খরচ করতে পারেন।
এসব পেমেন্ট ব্যবস্থার মধ্যে বর্তমানে পারফেক্ট মানি সবচেয়ে জনপ্রিয় বলে জানিয়ে ওই কর্মকর্তা বলেন, ‘জুয়ার এজেন্টরা বর্তমানে পারফেক্ট মানির এক ইউনিটের জন্য ৯০ টাকা চার্জ ধরছেন।’
এ ব্যাপারে যোগাযোগ করা হলে বাংলাদেশ ফিনান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ) প্রধান আবু হেনা মো. রাজি হাসান বলেন, ‘জুয়ার কাজে অনলাইন পেমেন্ট ব্যবস্থা ব্যবহারের তথ্য আমরাও পাচ্ছি। আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে এসব তথ্য জানিয়েছি।’
ভুয়া তথ্য দিয়ে কীভাবে বিকাশ এজেন্ট একাউন্ট খোলা হচ্ছে— জানতে চাইলে বিকাশের করপোরেট কমিউনিকেশন প্রধান শামসুদ্দিন হায়দার ডালিম বলেন, ‘এজেন্ট অ্যাকাউন্ট ব্যবহার করে কোনো অপরাধমূলক কার্যক্রম চালানোর অভিযোগ পেলে আমরা সব সময় তদন্ত করে দেখি। ওই অ্যাকাউন্ট বন্ধ করে দেওয়ার মতো ব্যবস্থা নিই আমরা। বিএফআইইউ ও আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গে কাজ করছে এমন দুটি বিশেষায়িত টিম আছে আমাদের।’
এ ছাড়া, এজেন্ট অ্যাকাউন্টগুলো রুটিনমাফিক যাচাই করা হয় বলে উল্লেখ করেন তিনি।
প্রতিবেদনটি ইংরেজি থেকে অনুবাদ করেছেন জারীন তাসনিম।
Comments