তুরাগ নদীতে ট্রাক স্ট্যান্ড

তুরাগ নদীর তীরে অবৈধভাবে ভরাট করে ট্রাক স্ট্যান্ড গড়ে তোলা হয়েছে। ছবি: রাশেদ সুমন/স্টার

রাজধানীর দিয়াবাড়িতে ঢাকা রক্ষা বাঁধের কাছে তুরাগ নদীতে অবৈধভাবে ভরাট করা অংশে তৈরি করা হয়েছে ট্রাক স্ট্যান্ড। তুরাগ নদের বাঁধ অঞ্চলে সীমানা পিলারের ভেতরে অবৈধভাবে গড়ে তোলা ট্রাক স্ট্যান্ডটিতে দুই সারিতে সারিবদ্ধভাবে দিনরাত দাঁড়ানো থাকে ট্রাক। নদী থেকে ট্রাকে পণ্য নামানো ও ওঠানো হয়।

পরিবেশবিদরা বলছেন, নদীর জায়গা ভরাট করে ট্রাক স্ট্যান্ড স্থাপন নদী, নৌপথ ও বাঁধের জন্য ক্ষতিকর। এটি আইনের পরিপন্থী। অবিলম্বে ট্রাক স্ট্যান্ড উচ্ছেদ এবং নদীর অবৈধ ভরাটকৃত স্থান খননের দাবি তাদের।

অন্যদিকে তুরাগ নদ রক্ষণাবেক্ষণের জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ পরিবহন কর্তৃপক্ষ বলছে, প্রয়োজনীয় ফান্ডের অভাবে দিয়াবাড়িতে ট্রাক স্ট্যান্ড স্থাপনের জন্য তুরাগ নদীর অবৈধভাবে ভরাটকৃত স্থানটি তারা খনন করতে পারছে না।

পরিবেশবিদ ও স্থানীয়দের সূত্রে জানা গেছে, নয় বছর আগে এমপি আসলামুল হক এই ট্রাক স্ট্যান্ডটি গড়ে তুলেন এবং মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনিই এটা নিয়ন্ত্রণ করতেন। দুই মাস আগে তার মৃত্যুর পর অবৈধ এই ট্রাক স্ট্যান্ডটির নিয়ন্ত্রণ নেন তার বড় ভাই, জাতীয় পার্টির প্রেসিডিয়ার সদস্য মফিজুল হক বেবু।

ঢাকা-১৪ আসনের সাবেক এমপি আসলাম ও তার প্রতিষ্ঠান মাইশা গ্রুপের বিরুদ্ধে অবৈধভাবে তুরাগ নদী দখল ও সেখানে স্থাপনা নির্মাণের একাধিক অভিযোগ ও এর পরিপ্রেক্ষিতে নেওয়া ব্যবস্থা নিয়ে বিস্তারিত তথ্য দ্য ডেইলি স্টারসহ অন্যান্য সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে।

গত ডিসেম্বরে জাতীয় নদী কমিশনের তদন্তে দেখা গেছে, বিদ্যুৎ কেন্দ্র ও কারখানা নির্মাণের জন্য আসলামুল বুড়িগঙ্গা নদীর ৪৫ একরেরও বেশি জমি ও জলাভূমি ভরাট করেছেন।

এ বিষয়ে যোগাযোগ করা হলে বিষয়টি অস্বীকার করে মফিজুল দাবি করেন, তিনি, তার প্রয়াত ভাই আসলামুল কিংবা পরিবারের কোনো কেউই ট্রাক স্ট্যান্ড প্রতিষ্ঠা বা পরিচালনায় জড়িত ছিলেন না।

মফিজুল বলেন, জায়গাটি খালি ছিল এবং বাংলাদেশ আন্তঃজেলা ট্রাকচালক ইউনিয়ন সেখানে ট্রাক স্ট্যান্ডটি প্রতিষ্ঠা করেছিল। তিনি ট্রাকচালক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক আহমেদ আলীর সঙ্গে যোগাযোগের পরামর্শ দেন।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে আহমদ আলী ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘আমাদের ইউনিয়ন কোনোভাবেই দিয়াবাড়ির ট্রাক স্ট্যান্ড স্থাপন ও পরিচালনার সঙ্গে জড়িত না।’

তুরাগ নদের উৎপত্তি ভাওয়াল গড়ের কালিয়াকৈর অঞ্চলে। প্রায় ৭১ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের নদীটি এরপর জয়দেবপুর, মির্জাপুর, গাজীপুর, সাভার, মিরপুর হয়ে মোহাম্মদপুরে বুড়িগঙ্গা নদীতে মিলিত হয়। বর্তমানে বুড়িগঙ্গার উৎসমুখ থেকে ধলেশ্বরীর সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। বুড়িগঙ্গা এখন পানি পেয়ে থাকে মূলত তুরাগ নদী থেকে।

পণ্য পরিবহনের জন্য তুরাগ নদীর ধউর (আশুলিয়া) থেকে খোলামুড়া পর্যন্ত অংশটি রাজধানীর অন্যতম ব্যস্ত নৌপথ বলে বিবেচিত। ধউর থেকে খোলামুড়া পর্যন্ত তুরাগ নদীর দুই পাশে সীমানা চিহ্নিত করে সীমানা পিলার স্থাপন করেছে বিআইডব্লিউটিএ।

সেখানে গিয়ে দেখা যায়, ছোট দিয়াবাড়ি এলাকায় তুরাগ নদীর ১৩ নম্বর সীমানা পিলার থেকে ১৮ নম্বর সীমানা পিলার পর্যন্ত ঢাকা রক্ষা বাঁধ সংলগ্ন নদী ভরাট করে ট্রাক স্টান্ডটি স্থাপন করা হয়েছে। ট্রাক স্ট্যান্ডটি বেড়িবাঁধ থেকে কিছুটা নিচুতে। বাঁধ সংলগ্ন নদীর ভরাটকৃত অংশটি প্রায় সমতল করা হয়েছে। ১৪ নম্বর সীমানা পিলারের কাছে ট্রাক আসা-যাওয়ার জন্য বেড়িবাঁধ থেকে ট্রাক স্ট্যান্ড পর্যন্ত একটি সংযোগ সড়কও তৈরি করা হয়েছে। সংযোগ সড়কটি দিয়ে ঢাকা রক্ষা বাঁধ থেকে নিচের ট্রাক স্ট্যান্ডটিতে ট্রাক আসা যাওয়া করতে দেখা যায়।

এসময় নদী সংলগ্ন দিকে দাঁড়ানো ট্রাকগুলোতে নদী তীরে ভেড়ানো কার্গো থেকে পণ্য ওঠানো ও নামানো হয়। ট্রাক স্ট্যান্ডে দুই সারি ট্রাকের মাঝখানের উন্মুক্ত স্থানে কোথাও বালু, রড এসব নির্মাণসামগ্রী স্তুপাকারে থাকতে দেখা যায়।

সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, ১৩ নম্বর সীমানা পিলার থেকে ১৮ নম্বর সীমানা পিলার পর্যন্ত ট্রাক স্ট্যান্ড সংলগ্ন ঢাকা রক্ষা বাঁধের উত্তর দিকের ৫ থেকে ৬ ফুট জায়গা চলাচলের অযোগ্য করে রাখা হয়েছে। ঢাকা রক্ষা বাঁধের সেখানে সেলুন, গরু পালনের ঘর, রিকশার গ্যারেজ, ময়লা-আবর্জনা ফেলার স্থান করে রাখা হয়েছে।

বিষয়টি নিয়ে পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলনের (পবা) চেয়ারম্যান ড. আবু নাসের খানের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, নদী অবৈধভাবে ভরাট করে ট্রাক স্ট্যান্ড তৈরি দেশের প্রচলিত আইনের চরম লঙ্ঘন। এটি কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। এ থেকে অন্যরা উৎসাহিত হবে। অবিলম্বে অবৈধভাবে ভরাটকৃত স্থান খনন করে নদীর জায়গা নদীকে ফিরিয়ে দিতে হবে।

তুরাগ নদীতে ট্রাক স্ট্যান্ড তৈরির বিষয়ে বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) সাধারণ সম্পাদক শরিফ জামিলের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, ট্রাক স্ট্যান্ড এমন একটি দখল, যা কেন্দ্র করে সামাজিক অস্থিরতা তৈরি করা যায়। অবিলম্বে ট্রাক স্ট্যান্ডটি উচ্ছেদ, নদীতে অবৈধভাবে ভরাটকৃত মাটি খনন এবং দায়ী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে সংশ্লিষ্ট দপ্তরের মামলা করা প্রয়োজন।

তিনি আরও বলেন, ঢাকার চারপাশে নদীতে অবৈধভাবে ভরাট করে গড়ে ওঠা এ ধরনের ট্রাক স্ট্যান্ড আরও আছে। এসব ক্ষেত্রে অবৈধভাবে ভরাট করা অংশ খনন ও দায়ীদের বিরুদ্ধে মামলা হওয়া প্রয়োজন।

তুরাগ নদী তত্ত্বাবধানের জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত সংস্থা বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআইডব্লিউটিএ) নির্বাহী প্রকৌশলী এবং ঢাকার সার্কুলার ওয়াটারওয়ে প্রকল্পের উপ প্রধান মো. মতিউল ইসলামের সঙ্গে অবৈধ ট্রাক স্ট্যান্ডের বিষয়ে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, ট্রাক স্ট্যান্ডটি স্থায়ী নয়। এটি উঠিয়ে দেওয়া হবে।

ট্রাক স্ট্যান্ডের অবৈধভাবে ভরাট করা অংশ খনন করা তিনি বলেন, জায়গাটি খনন করা হবে। তবে, খনন করা একটি ব্যয়বহুল কাজ। খনন করতে হলে দরকার ফান্ড। ফান্ড প্রাপ্তি সাপেক্ষে ভবিষ্যতে দিয়াবাড়িতে ট্রাকে পণ্য ওঠানো-নামানোর জন্য অবৈধভাবে ভরাটকৃত মাটিও খনন করা হবে।

তরুণ সরকার: ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক ও গবেষক

Comments

The Daily Star  | English

JP central office vandalised, set ablaze

A group of unidentified people set fire to the central office of Jatiyo Party in Dhaka's Kakrail area this evening

1h ago