বহুতল ভবন চান না প্রধানমন্ত্রী, নতুন নকশায় নির্মিত হবে টিএসসি
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশনার সঙ্গে মিল রেখে নতুনভাবে নির্মিত হবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্র (টিএসসি)।
বিশ্ববিদ্যালয়টির উপ-উপাচার্য অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ সামাদ দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘গত ২৪ মে পরিকল্পনাটির তিনটি নকশা প্রধানমন্ত্রীর কাছে উপস্থাপন করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। তখন প্রধানমন্ত্রী এসব নির্দেশনা দেন।’
তিনি জানান, প্রাচীন কাঠামো অটুট রেখে এবং বর্তমান ছাত্র ও শিক্ষকের সংখ্যার ওপর ভিত্তি করে আধুনিক সুযোগ-সুবিধাসহ টিএসসি পুনর্নির্মাণের নির্দেশনা দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। এ ছাড়া, টিএসসির খোলা সবুজ চত্ত্বর এবং এর সামনের খোলা জায়গার আয়তন বাড়াতে বলেছেন তিনি। পাশাপাশি, একটি আধুনিক অডিটোরিয়াম নির্মাণেরও নির্দেশনা দিয়েছেন।
বর্তমান টিএসসি ভবন সংস্কার করা হলে তা কেবল ২৫ বছরের মতো টিকবে। এরপর এটিকে ভেঙে ফলতে হবে। তাই সংস্কারের বদলে নতুন করে টিএসসি নির্মাণের নির্দেশনা দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী।
স্থাপত্য অধিদপ্তরের করা তিনটি নকশা প্রধানমন্ত্রীর কাছে উপস্থাপন করা হয়েছিল। কিন্তু, তিনি পছন্দ না করায় এগুলো বাতিল হয়ে গেছে বলে জানান ড. সামাদ।
তিনি বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শের ওপর ভিত্তি করে নতুন একটি নকশা তৈরি করা হবে। তিনি অনুমোদন দিলে ওই নকশা চূড়ান্ত করা হবে।’
এ ছাড়া, প্রধানমন্ত্রী টিএসসির সুইমিং পুলের পাশে একটি ১০তলা ভবন নির্মাণের পরিকল্পনাও বাতিল করে দিয়েছেন বলে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন।
যোগাযোগ করা হলে ঢাবি উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. আখতারুজ্জামান বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করে একটি আধুনিক, পরিবেশবান্ধব ও ছাত্র-শিক্ষকবান্ধব টিএসসি নির্মাণ করতে বলেছেন।’
বিষয়টি নিয়ে জানতে চাইলে স্থাপত্য অধিদপ্তরের প্রধান স্থপতি মীর মঞ্জুরুর রহমান ডেইলি স্টারকে জানান, তারা এ নিয়ে এখন কোনো মন্তব্য করতে পারবেন না। ঢাবি কর্তৃপক্ষ তাদের চাহিদার বিস্তারিত তথ্য দেওয়ার পর স্থাপত্য অধিদপ্তর সে অনুযায়ী কাজ করবে।
সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, নতুন নকশায় টিএসসির সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলোর জন্য পৃথক কক্ষ, ক্যাফেটেরিয়া, শিক্ষক লাউঞ্জ, পুরুষ ও নারী শিক্ষার্থীদের জন্য পৃথক নামাজ কক্ষ ও ব্যায়ামাগার, ওয়াশরুম ও গাড়ি পার্কিং সুবিধা রাখা হবে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্মশতবার্ষিকীর প্রাক্কালে যখন ঐতিহাসিক টিএসসি ভেঙে ফেলে বহুতল টিএসসি ভবন নির্মাণের সিদ্ধান্তের কথা জানানো হয়, ঢাবির বর্তমান-প্রাক্তন শিক্ষার্থীরাসহ ঢাকাবাসী তখন স্তম্ভিত হয়ে পড়েন।
প্রধানমন্ত্রী গত বছরের ২ সেপ্টেম্বর ঢাকা মেডিকেল কলেজ, টিএসসি ও পাবলিক লাইব্রেরিকে আধুনিক করতে বলার পর গণপূর্ত মন্ত্রণালয় এ উদ্যোগ নেয়।
তীব্র সমালোচনার মুখে গত ৩১ জানুয়ারি ঢাবি কর্তৃপক্ষ জানায়, পুরনো কাঠামো না ভেঙেই নতুন কিছু জিনিস যুক্ত করে টিএসসি ভবন সংস্কার করবে তারা।
প্রখ্যাত গ্রিক স্থপতি ও পরিকল্পনাবিদ কনস্টেনটিনোস অ্যাপোস্টোলোস ডক্সিয়াডিস ষাটের দশকে টিএসসির নকশা করেন। ইসলামাবাদ শহরের পরিকল্পনার নেপথ্যে মূল ভূমিকা পালন করা ডক্সিয়াডিসকে একিস্টিক্সের প্রতিষ্ঠাতা বলা হয়। একিস্টিক্স এমনি একটি চিন্তার স্কুল, যেখানে নগর, অঞ্চল, কমিউনিটি পরিকল্পনা ও আবাসন নকশাসহ মানব বসতির বিজ্ঞান নিয়ে আলোচনা করা হয়।
টিএসসির বিষয়ে জানতে চাইলে স্থপতি ও নগর পরিকল্পনাবিদ এবং বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের যুগ্ম সম্পাদক ইকবাল হাবিব ডেইলি স্টারকে জানান, স্থপতিদের সংগঠনটি ঢাবি উপাচার্যকে প্রকল্পটি সামগ্রিকভাবে বিবেচনা করার অনুরোধ করেছে।
টিএসসির পাশে থাকা পরমাণু শক্তি কমিশন তাদের অফিস সাভারে নিয়ে যাওয়ায় ওই জমি এখন খালি পড়ে আছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘এডুকেশন জোন সেখানে তৈরি করা যেতে পারে।’
‘কর্তৃপক্ষকে অবশ্যই বুঝতে হবে যে গাছের চেয়ে উঁচু কোনো ভবন গ্রহণযোগ্য নয়। আমরা আনুভূমিক ভিত্তিতে জায়গা সম্প্রসারণের পরামর্শ দিয়েছি। বিকল্প উপায় দেখিয়েছি আমরা। আমাদের বিশ্বাস, এসব বিকল্প উপায় ব্যবহার করে পরিবেশ ও জনবান্ধব আবহ তৈরি করা সম্ভব’, উল্লেখ করেন তিনি।
ইকবাল হাবিব বলেন, ‘টিএসসি শুধু ছাত্র-শিক্ষকদের মিলনকেন্দ্রই নয়, সাংস্কৃতিক চর্চারও আঁতুড়ঘর। তাই পরিবেশবান্ধব ও জনবান্ধব আবহ সেখানে জরুরি।’
তারা মূল কাঠামো ও আধুনিক স্থাপত্যের মিশেলে একটি নকশা তৈরির পরামর্শ দিয়েছেন উল্লেখ করে ইকবাল হাবিব বলেন, ‘আমরা এর নকশার জন্য একটি উন্মুক্ত জাতীয় প্রতিযোগিতা আয়োজনের পরামর্শ দিচ্ছি, যেখানে অনেক স্থপতি ও পরিকল্পনাবিদ অংশ নেবেন। এর মাধ্যমে অনেক বিকল্প খুঁজে পাবে সরকার। প্রধানমন্ত্রী ও বিশিষ্ট বিশেষজ্ঞরা পরিবেশবান্ধব ও নান্দনিক সেরা নকশাটি বাছাই করবেন।’
‘আধুনিকীকরণের এ কাজটিকে হালকাভাবে নেওয়া উচিত নয়। কারণ ঐতিহাসিক পটভূমি মাথায় রেখে কাজটি করতে হবে’, মত দেন তিনি।
বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের সাধারণ সম্পাদক আদিল মোহাম্মদ খান ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘বিশ্বে এমন কোনো পাবলিক প্লেস নেই, যেখানে বহুতল ভবন নির্মাণ করা হয়েছে। টিএসসি ভবন দুই বা তিনতলা হলে তা পাবলিক প্লেস হয়ে ওঠতে পারবে। কিন্তু, বহুতল ভবন পাবলিক প্লেসের আবেদন তৈরি করতে পারবে না।’
তিনি বলেন, ‘নতুন বিভাগ খোলার মাধ্যমে নাকি ঢাকার বাইরে জমি নিয়ে কার্যক্রম বর্ধিত করবেন, সে সিদ্ধান্ত নিতে হবে আপনাদের।’
টিএসসির বর্তমান বৈশিষ্ট্য ধ্বংস না করে বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্য কোনো স্থানে বা ঢাকার বাইরে শিক্ষার্থীদের জন্য অবকাঠামো নির্মাণের পরামর্শ দেন তিনি।
ইংরেজি থেকে অনুবাদ করেছেন জারীন তাসনিম
Comments