এমএফএস অপারেটরদের করপোরেট কর বৃদ্ধি

‘সোনার ডিম পাড়া হাঁসটিকে মেরে ফেলো না’- উপদেশ দিয়েছিলেন বিখ্যাত গ্রীক গল্পকার ঈশপ। আসন্ন অর্থবছরে মোবাইল আর্থিক সেবা (এমএফএস) সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামালের প্রস্তাবিত কর সংক্রান্ত সিদ্ধান্তগুলো দেখে এই বিখ্যাত গল্পটি স্মরণ না করলেই নয়।
এমএফএস

‘সোনার ডিম পাড়া হাঁসটিকে মেরে ফেলো না’- উপদেশ দিয়েছিলেন বিখ্যাত গ্রীক গল্পকার ঈশপ। আসন্ন অর্থবছরে মোবাইল আর্থিক সেবা (এমএফএস) সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামালের প্রস্তাবিত কর সংক্রান্ত সিদ্ধান্তগুলো দেখে এই বিখ্যাত গল্পটি স্মরণ না করলেই নয়।

গত দশকের শেষের দিকে বাংলাদেশ ব্যাংকের আর্থিক অন্তর্ভুক্তি প্রকল্পের অংশ হিসেবে চালু হওয়া এই প্ল্যাটফর্মটি ডিজিটাল বাংলাদেশের স্বপ্নকে বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে অগ্রগামী ভূমিকা রেখেছে।

প্রযুক্তি মানুষের জীবনকে সহজ ও উন্নত করে দিতে পারে- এই ব্যাপারটির উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হিসেবে এমএফএস প্রযুক্তি নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছে। এমএফএস’র মাধ্যমে গ্রাম্য অঞ্চলের মানুষরা, যারা সাধারণত ভৌগলিক ও বাণিজ্যিক কারণে আনুষ্ঠানিক ব্যাংকিং চ্যানেলের আওতার বাইরে থাকেন, তারাও কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই তাদের শহরে থাকা আত্মীয় ও বন্ধুদের কাছ থেকে টাকা পেতে পারেন। 

তবে, এমএফএস শুধু গ্রাম ও শহরের মানুষের মধ্যে রেমিট্যান্সের মাধ্যম হয়েই থেমে থাকেনি। বৈশ্বিক করোনাভাইরাস মহামারির সময়ে এর এতদিন পর্যন্ত সুপ্ত থাকা সম্ভাবনাগুলো বিকশিত হয়েছে।

লেনদেনের ক্ষেত্রে শারীরিক সংস্পর্শের কোনো প্রয়োজনীয়তা না থাকায়, মহামারিকালে এটি পয়েন্ট অব সেল টার্মিনালে ব্যবহার, ইউটিলিটি বিল দেওয়া এবং বেতন প্রদানের ক্ষেত্রে বেশ সুবিধাজনক পদ্ধতি হিসেবে জনপ্রিয় হয়েছে।

সঙ্গে প্রতিটি লেনদেনের ক্ষেত্রে এর সহজ ব্যবহারবিধি মহামারির সময়ে পার্সন টু পার্সন (পিটুপি) লেনদেনকে এমএফএস প্ল্যাটফর্মের এ যাবতকালীন সবচেয়ে জনপ্রিয় সেবা ক্যাশ আউটের মতোই জনপ্রিয় করে তুলেছে এবং সঙ্গে বহুদিনের আরাধ্য টাকাবিহীন সমাজের স্বপ্নকে ডানা মেলতে সাহায্য করেছে।

তবে, এই প্ল্যাটফর্মের অন্য যেকোনো সেবার চেয়ে সামাজিক সুরক্ষা বেষ্টনীর ভাতাকে তার যথাযোগ্য প্রাপকের কাছে পৌঁছে দেওয়ার ক্ষমতাটি সবচেয়ে বেশি মুগ্ধ করে।

মহামারির সময়ে ইউনিয়ন পরিষদ অফিসে লম্বা লাইন প্রতিহত করার জন্য সরকার গত বছর থেকে এমএফএস অপারেটরদের মাধ্যমে ৫০ লাখ প্রাপকের কাছে পরীক্ষামূলক ভিত্তিতে সামাজিক সুরক্ষা বেষ্টনীর ভাতা বণ্টন করতে শুরু করে।

সামাজিক সুরক্ষা বেষ্টনী প্রকল্পগুলোর মাধ্যমে মূলত এর আওতায় থাকা ব্যক্তিদের কাছে টাকা পাঠানো হয়। এ প্রকল্পগুলোর বিরুদ্ধে একটি সাধারণ অভিযোগ হচ্ছে যে, এই প্রক্রিয়াটিকে ধোঁকা দেওয়া যায় এবং এতে যাদের টাকার প্রয়োজন নেই, তাদের কাছেও টাকা চলে যায়। এ ক্ষেত্রে ন্যায়সঙ্গত সুবিধাভোগীদের এক পাশে ঠেলে দিয়ে মধ্যস্বত্বভোগীরা অন্যায় সুবিধা নেয়। স্থানীয় রাজনৈতিক কর্মীরাই সাধারণত মধ্যস্বত্বভোগীর ভূমিকায় অবতীর্ণ হন।

তবে, এক ধাক্কায় এমএফএস অপারেটররা সমগ্র প্রক্রিয়াটি থেকে মধ্যস্বত্বভোগীদের বিতাড়ন করে দিয়েছে।

এমএফএস ব্র্যান্ড বিকাশ, নগদ, রকেট ও সিওরক্যাশের জন্য শুরুটা ছিল অর্থ মন্ত্রণালয়ের দেওয়া একটি তালিকা।

তারা তালিকাভুক্ত এই মোবাইল নম্বরগুলোকে জাতীয় পরিচয়পত্রের ডেটাবেজের সঙ্গে মিলিয়ে দেখে, যাতে একই ব্যক্তি একাধিকবার অর্থ না পান। ‘একই ব্যক্তি একাধিকবার টাকা পাচ্ছেন’- এটি এ ধরনের লেনদেনের ক্ষেত্রে একটি সাধারণ প্রতারণার অভিযোগ।

এরপর সমন্বিত তালিকাটিকে বাংলাদেশে ব্যাংকের কাছে পাঠানো হয়, যাতে তারা পরীক্ষা করে দেখতে পারেন কোনো এনআইডির মাধ্যমে জাতীয় সঞ্চয়পত্র কেনা হয়েছে কিনা। যদি এরকম কোনো এনআইডি পাওয়া যায়, তাহলে সেটিকে তালিকা থেকে বাদ দিয়ে দেওয়া হয়।

এই প্রক্রিয়ার মাধ্যমে ৫০ লাখ নম্বরের তালিকাটিকে ছেঁটে ৩৫ লাখে নামিয়ে আনা হয় এবং বাকি ১৫ লাখ সুবিধাভোগীদের জন্য বরাদ্দ ভাতার পরিমাণকে এক নজিরবিহীন প্রক্রিয়ায় অর্থ মন্ত্রণালয়ের কাছে ফেরত পাঠানো হয়।

সংক্ষেপে বলতে গেলে, সমগ্র প্রক্রিয়াটিতে অপচয়ের পরিমাণ থাকে একেবারেই ন্যুনতম পর্যায়ে এবং এভাবেই এটি কার্যকরী হয়ে ওঠে।

পরীক্ষামূলক বিতরণের সাফল্যে উৎসাহিত হয়ে সরকার তাদের বিতরণ কর্মসূচিতে আরও বেশি করে এমএফএস অপারেটরদের সম্পৃক্ত করে। এ পর্যন্ত তিন কোটি মানুষ এই প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে তাদের ভাতা পেয়েছেন।

এসব ঘটনা এটাই প্রমাণ করে যে, সামাজিক সুরক্ষা বেষ্টনীর কার্যক্রম সম্পূর্ণরূপে এমএফএস অপারেটরদের মাধ্যমে পরিচালনা করা হলে তা সরকারের জন্য একটি কার্যকর প্রকল্পে পরিণত হবে।

তবে, এ ক্ষেত্রে সফল হতে হলে এই শিল্পে অনেক উন্নয়নের প্রয়োজন এবং প্রযুক্তি ও এর লজিস্টিকাল অবকাঠামোকে অনেকাংশেই উন্নত করতে হবে। সংক্ষেপে বলতে গেলে, এই খাতে বিপুল পরিমাণ বিনিয়োগের প্রয়োজন হবে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সর্বশেষ হালনাগাদ তথ্য অনুযায়ী, এপ্রিল মাসে নয় কোটি ৬০ লাখ নিবন্ধিত এমএফএস অ্যাকাউন্ট ছিল, কিন্তু মাত্র ৩৮ দশমিক পাঁচ শতাংশ অ্যাকাউন্ট থেকে গত ৯০ দিনের মধ্যে অন্তত একটি লেনদেন করা হয়েছে। এক বছর আগে আট কোটি পঞ্চাশ লাখ নিবন্ধিত অ্যাকাউন্ট এবং দুই কোটি ৮০ লাখ সক্রিয় অ্যাকাউন্ট ছিল।

এই মুহূর্তে দেশের ১৫টি এমএফএস অপারেটর রয়েছে, যার মধ্যে বিকাশ, নগদ এবং রকেট শীর্ষস্থান দখল করে রেখেছে।

কোনো অপারেটর এখনো লাভের মুখ দেখেনি। অর্থাৎ, এমএফএস অপারেটরদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য ৩২ দশমিক পাঁচ শতাংশ কর্পোরেট কর থেকে সরকারের কোষাগারে কোনো অর্থই আসছে না, কারণ এই কর শুধু লাভের পরিমাণ থেকেই সংগ্রহ করা যায়।

এরপরেও, আশ্চর্যজনকভাবে ২০২০-২১ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে এই কর্পোরেট করের হার বাড়ানো হয়েছে। নিবন্ধিত এমএফএস অপারেটরদের জন্য এটি ৩৭ দশমিক পাঁচ শতাংশ হবে এবং অনিবন্ধিতদের জন্য ৪০ শতাংশ।

এখান থেকে আমাদের মনে প্রশ্ন আসে, যদি ফলাফল আগের মতোই হয়, তাহলে করের হার বাড়ানোর পেছনে যুক্তি কী থাকতে পারে?

এ সিদ্ধান্তটি একটি ক্ষেত্রেই প্রভাব ফেলতে পারে এবং তা হচ্ছে সম্ভাব্য বিদেশি বিনিয়োগকারীদের নিরুৎসাহিত করা। এটি এমন এক সময়ে করা হচ্ছে, যখন এই শিল্পটি গত কয়েক বছরের বলিষ্ঠ প্রবৃদ্ধির কারণে তাদের কাছে আকর্ষণীয় হয়ে উঠছিল এবং এটাই প্রথমবার নয়, যখন সরকার একটি সম্ভাবনাময় শিল্পের প্রবৃদ্ধিকে গলা টিপে ধরেছে।

যখন মোবাইল শিল্প খুব দ্রুতগতিতে এগিয়ে যাচ্ছিল, তখন সরকার অপারেটরদের বিশ্বের সর্বাধিক পরিমাণ করের বোঝা বহন করতে দিয়েছিল এবং সেটি এত বেশি ছিল যে, এরপর সেখানে আর তেমন কোনো বিদেশি বিনিয়োগ আসেনি এবং যারা ছিল তাদের মধ্যেও কয়েকটি বড় প্রতিষ্ঠান পাততাড়ি গুটিয়ে চলে যেতে বাধ্য হয়।

সবশেষে, মোবাইল ব্যবহারকারীরাই সর্বাধিক পরিমাণে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন, কারণ তাদেরকে এখন নিম্নমানের সেবায় সন্তুষ্ট থাকতে হচ্ছে।

এমএফএস শিল্পেও একই ধারা দৃশ্যমান হচ্ছে, যেটি এখনো আঁতুড়ঘরে রয়েছে এবং ব্যাপারটি এরকম নয় যে, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) এমএফএস থেকে এই মুহূর্তে কিছুই পাচ্ছে না। এনবিআর প্রতিটি এমএফএস লেনদেন থেকে ১৫ শতাংশ মূল্য সহযোজন কর (ভ্যাট) এবং ১২ শতাংশ অগ্রিম আয়কর (এআইটি) সংগ্রহ করছে এবং একইসঙ্গে লাভ করতে ব্যর্থ হওয়া সত্ত্বেও অপারেটরদের মোট আয় থেকে আরও শূন্য দশমিক ছয় শতাংশ টার্নওভার কর সংগ্রহ করছে।

২০২০-২১ অর্থবছরের প্রথম ১০ মাসে এই প্ল্যাটফর্ম থেকে মোট লেনদেনের পরিমাণ দাঁড়ায় ৫৫২ হাজার ৩৭৫ দশমিক সাত কোটি টাকা, যা এর আগের বছরের তুলনায় ৪৬ দশমিক পাঁচ শতাংশ বেশি।

৪০ শতাংশ কর্পোরেট কর কোনো ক্ষুদ্র পরিমাণ নয় এবং এটি ব্যাংক এবং নন-ব্যাংকিং আর্থিক প্রতিষ্ঠানের কর হারের কাছাকাছি, যাদের রয়েছে লাভ করার অনেক ধরনের বিকল্প পদ্ধতি।

সবচেয়ে দুর্ভাগ্যজনক বিষয় হচ্ছে, এই কর্পোরেট ট্যাক্সটি বর্তমান এবং অদূর ভবিষ্যতের ক্ষেত্রে কোনো গুরুত্বই বহন করছে না।

সরকারের জন্য এই শিল্পটিকে পরিচর্যা করে একে প্রস্ফুটিত হতে দেখাই কি সর্বোত্তম কর্মপদ্ধতি নয়? কেন এটিকে অংকুরেই বিনষ্ট করতে হবে?

প্রতিবেদনটি ইংরেজি থেকে অনুবাদ করেছেন মোহাম্মদ ইশতিয়াক খান

Comments

The Daily Star  | English

Ex-public administration minister Farhad arrested

Former Public Administration minister Farhad Hossain was arrested from Dhaka's Eskaton area

3h ago