‘বাতাসে এত অক্সিজেন, অথচ আমি তাকে একটুও দিতে পারিনি’
স্বামী আমান সরদারের জীবন বাঁচাতে চার বছর আগে নিজের একটি কিডনি দিয়েছিলেন রাজশাহীর পাপিয়া সুলতানা।
বুধবার যখন তার করোনা আক্রান্ত স্বামীর বেঁচে থাকার জন্য হাইফ্লো অক্সিজেনের প্রয়োজন ছিল, তখন অসহায়ের মতো তাকিয়ে থাকতে হয় পাপিয়াকে।
রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান আমান (৩৫)। তার বাড়ি রাজশাহীর বাঘা উপজেলার নারায়ণপুর গ্রামে। স্বামীর মৃত্যুতে চিৎকার করে কাঁদতে থাকেন পাপিয়া।
‘বাতাসে এত অক্সিজেন, অথচ আমি তাকে একটুও দিতে পারিনি’, কান্নাজড়ানো কণ্ঠে বলেন পাপিয়া।
সেদিন রামেক হাসপাতালের কোভিড ইউনিটে সর্বোচ্চ ১৮ জন মারা যান। তাদের মধ্যে আট জন ছিলেন কোভিড-১৯ পজিটিভ এবং ১৩ জনই রাজশাহীর বিভিন্ন এলাকার।
গত ১৬ জুন করোনা শনাক্ত হওয়ার পর আমানকে হাসপাতালে ভর্তি করে অক্সিজেন দেওয়া হয়। অক্সিজেন দেওয়ার পর তার রক্তে স্যাচুরেশন প্রায় ৯৩ শতাংশে পৌঁছায়। ২০ জুন রাতে তার শ্বাসকষ্ট শুরু হলে, চিকিৎসকরা তাকে আইসিইউতে নেওয়ার পরামর্শ দেন।
কিন্তু, ২০ জন ধারণ ক্ষমতার আইসিইউ ইউনিটে একটি শয্যা পেতে আমানের আগে থেকেই আরও অন্তত ৭৫ জন করোনা রোগী অপেক্ষমান ছিলেন। আইসিইউতে একজন রোগী সুস্থ হলে বা মারা গেলেই কেবল একটি শয্যা খালি পাওয়া যায়। রোগী সুস্থ হয়ে আইসিইউ ছাড়ার ঘটনা সেখানে বিরল।
২২ জুন রাতে অক্সিজেন স্যাচুরেশন ৬০ শতাংশে নেমে আমানের অবস্থার মারাত্মক অবনতি হলে তাকে একজনের মৃত্যুতে সদ্য খালি হওয়া আইসিইউ বেড়ে নেওয়া হয়। কিন্তু তার অক্সিজেন স্যাচুরেশন কখনোই আর স্বাভাবিক অবস্থায় আসেনি। পরদিন সকাল ১১টায় তিনি মারা যান।
‘মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি টানা তিন দিন একটুও ঘুমাতে পারেননি। প্রতি মুহূর্তে শ্বাস-প্রশ্বাসের জন্যে যুদ্ধ করেছেন’, অশ্রুসিক্ত কণ্ঠে বলছিলেন পাপিয়া।
‘তিনি বারবার বলছিলেন আইসিইউতে নেওয়া হলে তিনি ভালো বোধ করবেন। কিন্তু, আইসিইউ পাওয়া তখন প্রায় অসম্ভব ছিল।’
অক্সিজেনের মাত্রা আশঙ্কাজনকভাবে কমে যাওয়ার পরও আইসিইউ শয্যার অপেক্ষায় থেকে আমানের মৃত্যু রামেক হাসপাতালে বিচ্ছিন্ন কোনো ঘটনা নয়।
গুরুতর অবস্থায় আরও অনেককেই দেখা গেছে অপেক্ষায় থাকতে। হাসপাতাল কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, বুধবার মারা যাওয়া ১৮ জনের বেশিরভাগই আইসিইউর জন্যে অপেক্ষায় ছিলেন।
বৃহস্পতিবার যখন ৬১ বছর বয়সী কোভিড-১৯ রোগী হোসনে আরা একটি আইসিইউ শয্যার জন্যে অপেক্ষা করছেন, তখন তার অক্সিজেন স্যাচুরেশন মাত্রা ৭০ শতাংশ এবং মুক্তারা বেগমের (৫০) ৬০ শতাংশ ও সোহরাব আলীর (৬০) ৬৫ শতাংশ।
হাসপাতালের কর্মীরা বলেছেন, এই রোগীদের হাইফ্লো ন্যাজাল ক্যানুলা দিয়ে মিনিটে ৬০ লিটার অক্সিজেন দিয়েও অবস্থার উন্নতি করা যাচ্ছিল না।
রাজশাহী বিভাগে মোট ১০০টি ন্যাজাল ক্যানুলা আছে। যার ৬৫টি আছে রামেক হাসপাতালে।
রামেক হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল শামীম ইয়াজদানী বলেন, ‘রোগীদের অক্সিজেন স্যাচুরেশনের মাত্রা ৮৬ শতাংশের নিচে নেমে গেলেই চিকিৎসকরা সাধারণত তাদের আইসিইউতে নেওয়ার পরামর্শ দিয়ে থাকেন। তবে, এখন ৭০ শতাংশের নিচের স্যাচুরেশনের রোগীদেরও আইসিইউ শয্যার ব্যবস্থা করা প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়েছে।’
‘এখন আমাদের মূল লক্ষ্য হলো, যাদের অক্সিজেন দিয়ে বাঁচানো যাবে তাদের অক্সিজেন সরবরাহ করা। অন্যদের ক্ষেত্রে আমাদেরকে আশা ছেড়ে দিতে হচ্ছে’, বলেন তিনি।
যদিও হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ কোভিড-১৯ ইউনিটের জন্য প্রায় প্রতিদিনই শয্যা ও অক্সিজেন সরবরাহ বাড়াচ্ছে। কিন্তু, তারা আইসিইউতে শয্যা বাড়াতে পারছেন না।
হাসপাতাল পরিচালক ইয়াজদানী বৃহস্পতিবার দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘আমরা চাইলেই আইসিইউ ক্ষমতা বাড়াতে পারি না। কারণ, এর জন্যে জায়গা দরকার, অবকাঠামো দরকার ও ভেন্টিলেটর প্রয়োজন।’
‘এখন আমাদেরকে ভেন্টিলেটর ও শয্যা দেওয়া হলেও অবকাঠামো তৈরিতে কয়েক মাসেরও বেশি সময় লাগবে’, বলেন তিনি।
গত বছর মহামারি শুরু হওয়ার পরে ১০ শয্যার আইসিইউকে ২০ শয্যার পূর্ণাঙ্গ আইসিইউ ইউনিটে পরিণত করা হয়েছিল।
‘জুনে আইসিইউর চাহিদা দ্বিগুণ হয়ে গেছে। এই মাসের শুরুর দিকে আইসিইউ বেডের জন্য অপেক্ষমাণ রোগীর সংখ্যা ছিল ৩০ এর কাছাকাছি এবং মাসের শেষের দিকে এখন এই সংখ্যা ৭০ এর কাছাকাছি’, বলেন রামেক হাসপাতালের পরিচালক।
এমনকি বিএসএমএমইউতেও ২০ শয্যার উপরে আইসিইউ ইউনিট নেই বলে জানান তিনি।
তিনি জানান, রাজশাহীর জন্যে পৃথক একটি কোভিড ডেডিকেটেড হাসপাতাল স্থাপনের প্রস্তাব করা হয়েছে। সেখানে কেন্দ্রীয় অক্সিজেন সরবরাহ ব্যবস্থাসহ পৃথক ২০ শয্যাবিশিষ্ট আইসিইউ স্থাপনের প্রস্তাব করা হয়েছে।
এটা হবে রাজশাহী সদর হাসপাতালের দোতলা ভবনে। সদর হাসপাতালটি গত ২০ বছর ধরে রামেক হাসপাতালের ডেন্টাল ইউনিট হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছিল।
প্রস্তাবটি অনুমোদন পেলে হাসপাতালে কেন্দ্রীয় অক্সিজেন সরবরাহ ব্যবস্থা স্থাপনসহ রোগী ভর্তি করার উপযোগী করতে কমপক্ষে দুই মাস সময় লাগবে বলে জানান তিনি।
রামেক হাসপাতালে এখন প্রতিদিন ৫০ জনের বেশি নতুন রোগী ভর্তি হচ্ছেন এবং গতকাল ৩৫৭ শয্যাবিশিষ্ট কোভিড ইউনিটে ৪২৩ জন রোগীর চিকিত্সা চলছিল।
স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সামাজিক সংক্রমণ বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে পরিস্থিতি আরও খারাপ হয়েছে।
রাজশাহী সিটি করপোরেশন ও রাজশাহী মহানগর পুলিশ ডেইলি স্টারকে জানিয়েছে, তারা বিনামূল্যে অক্সিজেন সিলিন্ডার সরবরাহের জন্য যে কর্মসূচি গ্রহণ করেছেন, তাতে তাদেরকে বেশ বেগ পেতে হচ্ছে। প্রায় প্রতিটি বাড়ি থেকে তারা কল পেতে শুরু করেছেন এবং পরিস্থিতি ক্রমাগত খারাপের দিকে যাচ্ছে।
জুনে রামেক হাসপাতালের কোভিড ইউনিটে রেকর্ড সংখ্যক মৃত্যু হয়েছে। মাসের প্রথম ২৪ দিনে মারা গেছেন কমপক্ষে ২৮৭ জন। তাদের মধ্যে ১৪৬ জন কোভিড-১৯ পজিটিভ। এর আগের রেকর্ড মৃত্যু ছিল মে মাসে ১২৪।
বুধবার হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ ১১টি কোভিড-১৯ ওয়ার্ডে শয্যা ও অক্সিজেনের প্রবাহ বাড়াতে অক্সিজেন প্ল্যান্টে দ্বিতীয় অক্সিজেন ভ্যাপোরাইজার স্থাপন করেছে। কেন্দ্রীয় অক্সিজেন সরবরাহের পাশাপাশি হাসপাতালটিতে ১৮৩টি অক্সিজেন কনসেনট্রেটর ও ৭২৫টি অক্সিজেন সিলিন্ডার রাখা হয়েছে। কোভিড ওয়ার্ড আরও বাড়ানোর জন্যে হাসপাতালে আরও একটি তরল অক্সিজেন ট্যাংক স্থাপনের পরিকল্পনা করা হয়েছে।
রামেক হাসপাতালে সাধারণত রাজশাহী বিভাগের আটটি জেলা ও খুলনা বিভাগের অনেক জেলা থেকে রোগীরা আসেন।
হাসপাতালের বর্তমানে ভর্তি মোট ৪২৩ জন রোগীর মধ্যে ২৮৩ জন রাজশাহীর, ৬৪ জন চাঁপাইনবাবগঞ্জের, ৩১ জন নাটোরের, ২৯ জন নওগাঁর, আট জন পাবনার, তিন জন কুষ্টিয়ার, দুই জন চুয়াডাঙ্গার এবং দিনাজপুর, ঢাকা ও অন্যান্য জেলা থেকে একজন করে রোগী রয়েছেন।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুসারে, রাজশাহী বিভাগের আট জেলার মধ্যে রাজশাহী ও বগুড়ায় মোট ৪৬টি আইসিইউ শয্যা আছে। রাজশাহীতে ২০টি ও বগুড়ার তিনটি হাসপাতালে ২৬টি আইসিইউ শয্যা আছে।
বগুড়ার ২৬টি আইসিইউ শয্যার মধ্যে মোহাম্মদ আলী জেলা হাসপাতাল ও শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের প্রতিটিতে আট শয্যার মধ্যে ছয়টি করে পূর্ণ ছিল এবং টিএমএসএস মেডিকেল কলেজ ও রাফাতুল্লাহ কমিউনিটি হাসপাতালে ১০টি শয্যার একটিতে রোগী ছিল।
রাজশাহী বিভাগীয় স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক ডা. হাবিবুল আহসান তালুকদার ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘আইসিইউতে চিকিত্সা নেওয়া বেশিরভাগ রোগী হাসপাতালে যেতে দেরি করে এবং তাদের অনেকেই ৪০ শতাংশ ফুসফুস ক্ষতিগ্রস্ত করে হাসপাতালে যায়। এই রোগীদের বেশিরভাগই প্রত্যাশিত মাত্রার অক্সিজেন স্যাচুরেশন ফিরে পেতে ব্যর্থ হন।’
‘রোগীর সংখ্যা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে আমরা কেবল যারা বেঁচে থাকতে পারছে, তাদের দিকে মনোনিবেশ করছি। আইসিইউ সুবিধা রাতারাতি বাড়ানো যায় না। আইসিইউ পরিচালনার জন্য জনবল, অবকাঠামো ও সময় প্রয়োজন’, বলেন তিনি।
তিনি আরও জানান, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর কিছু আইসিইউ সরঞ্জাম কিনেছে এবং সেগুলো শিগগিরই রাজশাহী বিভাগের হাসপাতালগুলোতে সরবরাহ করা হবে।
‘শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল নতুন ১০ শয্যাবিশিষ্ট আইসিইউ ইউনিটের অবকাঠামো তৈরি করেছে। তবে, অন্যান্য হাসপাতাল এখনো প্রস্তুত নয়। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর এই বিভাগের জন্যে আরও পাঁচটি আরটি-পিসিআর পরীক্ষাগার বরাদ্দ দেওয়ায় করোনা পরীক্ষার সুবিধা বাড়বে’, যোগ করেন তিনি।
রাজশাহী মেডিকেল কলেজ ও রাজশাহী যক্ষ্মা হাসপাতালের দুটি পরীক্ষাগারে জুলাইয়ের প্রথম সপ্তাহ থেকে করোনা পরীক্ষা শুরু করার সম্ভাবনা রয়েছে। বগুড়া, পাবনা ও নওগাঁর তিনটি মেডিকেল কলেজ হাসপাতালেও শিগগিরই নতুন আরটি-পিসিআর পরীক্ষাগার স্থাপন করা হবে বলে জানান ডা. হাবিবুল আহসান তালুকদার।
Comments