শিগগিরই শুরু হবে ভ্যাকসিন প্ল্যান্টের নির্মাণকাজ
ভ্যাকসিন জাতীয়তাবাদের রূঢ় বাস্তবতার মুখোমুখি হয়ে সরকার নিজস্ব ভ্যাকসিন উৎপাদন প্ল্যান্ট তৈরি করার পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে। যাতে ভবিষ্যতে ভ্যাকসিনের জন্যে অন্য দেশের ওপর নির্ভরশীল থাকতে না হয়।
সরকার এ পর্যন্ত দেশের ১৬ কোটি ৩০ লাখ জনসংখ্যার তিন শতাংশেরও কম মানুষকে কোভিড-১৯ এর ভ্যাকসিন দিতে পেরেছে। আন্তর্জাতিক মহলগুলোর কাছ থেকে প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী ভ্যাকসিন সরবরাহ না পাওয়ায় গত ৭ ফেব্রুয়ারি থেকে শুরু হওয়া দেশব্যাপী গণটিকাদান কর্মসূচিটি থমকে গেছে।
স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘আমরা এই মহামারি থেকে অনেক কিছু শিখেছি। সরকার সিদ্ধান্ত নিয়েছে একটি ভ্যাকসিন প্ল্যান্ট তৈরি করার। এটি নিয়ে একটি প্রকল্প প্রস্তাব তৈরি করা হচ্ছে।’
তিনি আরও বলেন, কর্মকর্তারা ন্যূনতম সময়ে ভ্যাকসিন উৎপাদন চালু করার উদ্দেশ্যে কাজ শুরু করবেন। তবে, প্রকল্পের খরচ কত হতে পারে, সে বিষয়ে তিনি কিছু জানাননি।
সব কিছু ঠিকমতো এগোলে উৎপাদন শুরু করতে প্রায় দুই বছর সময় লাগতে পারে। স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলেন, ‘মহামারি সবাইকে দেখিয়েছে কেন দেশগুলোর নিজস্ব ভ্যাকসিন প্ল্যান্ট থাকা উচিত।’
করোনাভাইরাস বিষয়ক জাতীয় পরামর্শক কমিটির সভাপতি অধ্যাপক ডা. মোহাম্মদ শহীদুল্লাহ বলেন, ‘সরকারের উচিত হবে প্রক্রিয়াটিকে গতিশীল করা। মহামারি আমাদের চোখ খুলে দিয়েছে এবং আমাদেরকে দেখিয়েছে একটি ভ্যাকসিন প্ল্যান্ট কত গুরুত্বপূর্ণ হতে পারে।’
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার দক্ষিণপূর্ব এশিয়া অঞ্চলের সাবেক উপদেষ্টা অধ্যাপক মোজাহেরুল হক বলেন, কর্তৃপক্ষ চাইলে দ্য এসেনশিয়াল ড্রাগসের ওপর ভরসা রাখতে পারেন। তবে, এক্ষেত্রে ইনস্টিটিউট অব পাবলিক হেলথের (আইপিএইচ) আরও উন্নয়ন ঘটিয়ে তাদেরকে দায়িত্ব দিলে ভালো হতো। কারণ, এই প্রতিষ্ঠানটির ভ্যাকসিন উৎপাদনের পূর্ব-অভিজ্ঞতা আছে।
আইপিএইচের সাবেক পরিচালক অধ্যাপক মোজাহেরুল হক বলেন, ‘যেহেতু আইপিএইচের অবকাঠামো ও মানবসম্পদ আছে, সেহেতু সরকার প্রযুক্তি স্থানান্তর, নিয়োগ ও প্রশিক্ষণের মাধ্যমে খুব অল্প সময়ের মধ্যে উৎপাদন শুরু করতে পারবে। এটি সরকারের জন্যে একটি ভালো উদ্যোগ হবে। তবে, এক্ষেত্রে আমাদেরকে খুব দ্রুত সিদ্ধান্ত নিতে হবে।’
তিনি বলেন, বাংলাদেশের অন্যান্য ভ্যাকসিনও প্রয়োজন। ‘যদি সরকার দ্রুত কাজ করতে পারে, তাহলে আমরা ভবিষ্যতে ভ্যাকসিন রপ্তানি ও করতে পারব’, বলেন তিনি।
তবে, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সাবেক পরিচালক (রোগনিয়ন্ত্রণ) অধ্যাপক বে-নজির আহমেদ আইপিএইচ নিয়ে ভিন্ন অভিমত পোষণ করেন।
তিনি বলেন, ‘আইপিএইচের এক সময় ভ্যাকসিন উৎপাদন করার সক্ষমতা ছিল। কিন্তু, সেটিকে নষ্ট করে ফেলা হয়েছে।’
‘আইপিএইচকে পুনরুজ্জীবিত করার কাজটি খুবই জটিল। কারণ, এই প্রতিষ্ঠানের গবেষণাগার সুবিধা ও দক্ষ মানবসম্পদ নেই। এটিকে পুনঃবিন্যস্ত করে ভ্যাকসিন উৎপাদনের জন্যে প্রস্তুত করা যেতে পারে। কিন্তু, এর জন্যে সময় ও অর্থের প্রয়োজন’, বলেন তিনি।
বে-নজির এসেনশিয়াল ড্রাগসকে নির্বাচিত করার সিদ্ধান্তের প্রতি সমর্থন জানিয়েছেন এবং বলেছেন, ‘এই উদ্যোগ থেকে ভালো ফলাফল পাওয়া যাবে।’
‘আমাদের নিজস্ব সংস্থা থাকা উচিত। প্রতি বছর আমাদের শিশুদের জন্যে ভ্যাকসিন প্রয়োজন হবে। আমাদের নিজস্ব সংস্থার মাধ্যমে আমরা সেগুলো উৎপাদন করতে পারব। অভ্যন্তরীণ চাহিদা মেটানোর পর আমরা রপ্তানিও করতে পারব’, বলেন তিনি।
কোভ্যাক্স ও অন্যান্য চুক্তির আওতায় বিশ্বজুড়ে ভ্যাকসিন প্রবাহের ওপর নজর রাখছে ইউনিসেফ। ইউনিসেফ জানিয়েছে, বেশিরভাগ উচ্চ আয়ের দেশগুলো কমপক্ষে ৩৫০ শতাংশ ডোজ সংগ্রহ করেছে (এখনো উৎপাদিত হয়নি এরকম ভ্যাকসিন বাদ দিয়ে)। ইতোমধ্যে নিম্ন ও মধ্যম আয়ের দেশগুলো ২০২৩ সাল পর্যন্ত ভ্যাকসিনের জন্য যেসব চুক্তি করেছে, তাতে তাদের জনসংখ্যার অর্ধেক কিংবা তারচেয়েও কম মানুষের জন্য ডোজ পাওয়া যাবে।
উন্নত ও ধনী রাষ্ট্রগুলো ইতোমধ্যেই তাদের জনসংখ্যার একটি বড় অংশকে টিকা দিতে পেরেছে। এক্ষেত্রে গরিব ও উন্নয়নশীল দেশের চিত্র পুরোপুরি ভিন্ন।
উন্নত দেশগুলো স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে যাওয়ার পরিকল্পনা করছে, আর উন্নয়নশীল ও দরিদ্র দেশগুলো এখনো ভ্যাকসিন স্বল্পতায় ভুগছে এবং সেখানে করোনার সংক্রমণের ঊর্ধ্বগতি পরিলক্ষিত হচ্ছে।
গত ২৯ মে নিউইয়র্ক টাইমসের প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, অল্প কিছু দেশ জনসংখ্যার ৫০ শতাংশকে ভ্যাকসিন দিতে পারলেও অন্তত ৪১টি দেশ আছে যারা এখনো তাদের জনসংখ্যার দুই শতাংশকেও টিকাদান কর্মসূচির আওতায় আনতে পারেনি।
ভ্যাকসিনের মজুত কমে যাওয়ায় বাংলাদেশ অক্সফোর্ড অ্যাস্ট্রাজেনেকার ভ্যাকসিন দেওয়ার কার্যক্রমটি ২৬ এপ্রিল স্থগিত করেছিল। অনেক জায়গায় দ্বিতীয় ডোজের টিকা দেওয়ার কার্যক্রমও স্থগিত আছে।
বিভিন্ন পর্যায়ে ১৮ বছর ও তার চেয়ে বেশি বয়সী নাগরিকদেরকে ভ্যাকসিন দেওয়ার লক্ষ্যমাত্রা হাতে নিয়ে গণটিকাদান কর্মসূচিটি শুরু হয়েছিল। সরকার ভ্যাকসিন নিবন্ধন প্রক্রিয়া স্থগিত করে দেয় গত ৫ মে থেকে।
ভারতের সেরাম ইনস্টিটিউট অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকা সরবরাহে ব্যর্থ হলে বাংলাদেশের টিকাদান কর্মসূচি বাঁধার মুখে পড়ে। চুক্তি অনুযায়ী, ছয় চালানে জানুয়ারি থেকে জুনের মধ্যে বাংলাদেশের তিন কোটি ডোজ ভ্যাকসিন পাওয়ার কথা ছিল। সেরাম জানুয়ারিতে প্রথম ৫০ লাখ ডোজ পাঠিয়েছিল। কিন্তু, এরপর ফেব্রুয়ারিতে তারা মাত্র ২০ লাখ ডোজ ভ্যাকসিন পাঠায়। এরপর থেকে আর কোনো চালান আসেনি বাংলাদেশে।
কোভ্যাক্স নামক বৈশ্বিক প্রকল্প থেকে বাংলাদেশের এ বছর ছয় কোটি ৮০ লাখ ডোজ ভ্যাকসিন পাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু, এ পর্যন্ত মাত্র ফাইজার ভ্যাকসিনের এক লাখ ছয় হাজার ডোজ পাওয়া গেছে।
চীন সরকারের কাছ থেকে উপহার হিসেবে পাওয়া সিনোফার্ম ভ্যাকসিনের ১১ লাখ ডোজের মজুত নিয়ে গত সপ্তাহ থেকে সীমিত আকারে টিকাদান কর্মসূচি আবারও শুরু হয়েছে।
বাংলাদেশ স্থানীয়ভাবে ভ্যাকসিন উৎপাদনের জন্য অ্যাস্ট্রাজেনেকার কাছে ফর্মুলা চেয়ে চিঠি পাঠিয়েছে। কিন্তু, এখনো সেটির কোনো উত্তর আসেনি। সরকার রাশিয়া ও চীনের সঙ্গেও ভ্যাকসিন উৎপাদন নিয়ে কথা বলছে। কিন্তু, এখনো এ বিষয়ে কোনো সমঝোতা হয়নি।
ইংরেজি থেকে অনুবাদ করেছেন মোহাম্মদ ইশতিয়াক খান
Comments