প্রবাসে

সুইজারল্যান্ড: শব্দ দূষণ ও নাগরিক অধিকারের কয়েকটি অভিনব দৃষ্টান্ত

জুরিখ লেকের জাহাজগুলো এখন আর ভেঁপু বাঁজায় না। ছবি: সংগৃহীত

সুইজারল্যান্ডের জুরিখ লেকের জাহাজগুলো আগের মতো আর ভেঁপু বাঁজায় না। কেন জানেন? কারণ, লেকের পাড়ের এক বাসিন্দা ভেঁপুর শব্দ দূষণ নিয়ে একটি মামলা করেছিল। মামলাটি প্রায় দেড় বছরের মতো চলে এবং আদালত রায় দেন সেই নারীর পক্ষে।

তিনি অভিযোগ করেছিলেন, ‘আমি ঘুমিয়ে ছিলাম। হঠাৎ জাহাজের ভেঁপুর শব্দে ঘুম থেকে লাফিয়ে উঠি। তারপর থেকে রোগে ভুগছি।’ মূল কথা বা তার অভিযোগ হলো- জাহাজের ভেঁপুর শব্দ পরিবেশে দূষণ হচ্ছে।

পরে আদালত রায় দেন, জাহাজগুলো ঘাটে ভিড়তে, এমনকি লেকের মাঝখানেও কোনো বিপদ না হলে ভেঁপু বাজাতে পারবে না। যদিও জাহাজের নিয়মেই ছিল ঘাটে ভিড়তে এবং ছেড়ে যেতে ভেঁপু দিতে হবে।

জাহাজের ভেঁপু বাজানোর এই নিময় অনেকটা সংস্কৃতিতে পরিণত হয়েছিল জাহাজের ভ্রমণ শিল্পে। একেকটা জাহাজের ছিল একেক রকম বাহারি শব্দ। শব্দ শুনে দূর থেকেই সাধারণ মানুষ বলে দিতে পারত, কোন জাহাজটি এখন এসে ভিড়ল!

তবে, এই রায় মানতে চাননি জাহাজের নাবিকেরা। তারা রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করে জিততে পারেননি। এক পর্যায়ে শব্দ দূষণের মতো বিষয়টি সামনে এনে পরিবেশ রক্ষার্থে সেই রায় মেনে নেন।

এখন জাহাজের নাবিকেরা অভ্যস্ত হয়ে গেছেন। তারা আর ভেঁপু বাজান না। আর সাধারণ মানুষও ভুলে গেছে জুরিখ লেকের জাহাজের সেই ঐতিহ্যবাহী ভেঁপুর শব্দ।

মান কোম্পানি যখন বিশ্বে প্রথম জেমসওয়াটের বাষ্পীয় ইঞ্জিন মানে কয়লা পুড়িয়ে চাকা ঘুড়িয়ে জাহাজ তৈরি শুরু করেছিল, তখন থেকেই জুরিখ লেকে জাহাজ চলাচল শুরু হয় এবং ব্যবহার হয় জাহাজের ভেঁপুর। সবাই তখন থেকেই এই শব্দকে উপভোগ করত। আরও এখন ভেঁপুকে তারা পাঠিয়েছে জাদুঘরে।

এবার আসছি সুইজারল্যান্ডের আরও একটি ঐতিহ্যবাহী শব্দের কথায়। যে শব্দটি এসেছে গরুর গলার ঘণ্টি থেকে। সুইসদের একটি জাতীয় প্রতীক গরুর গলার ঘণ্টি। তাদের হাজার বছরের ঐতিহ্য এটি। সুবিনর হিসেবে এই ঘণ্টি সবার ঘরের দেওয়ালেই ঝুলে থাকে।

গরুর গলার ঘণ্টি সুইসদের হাজার বছরের ঐতিহ্য। ছবি: সংগৃহীত

এই ঐতিহ্যের বিরুদ্ধেও শব্দ দূষণকে সামনে আনা হয়েছে। আদালত অভিযুক্ত এক কৃষকের বিরুদ্ধে রায় দিয়েছেন, রাত দশটার পরে তার সব গরুর গলার ঘণ্টি যেন তিনি খুলে ফেলেন।

সম্প্রতি আদালতের এমন রায়ের ঘটনাটি ঘটেছে ক্যান্টন পৌরসভায়। এখানে একজন কৃষকের খামারের গরুর গলার ঘণ্টির শব্দের বিরুদ্ধে মামলা করেন কয়েকজন। তাদের অভিযোগ গরুর ঘণ্টির শব্দে তাদের ঘুমোতে সমস্যা হয়।

এই মামলায় আদালতের রায়, গরুর গলায় ঘণ্টি সারাদিন থাকতে পারবে, তবে রাত দশটার পরে শব্দ দূষণ রোধে তা খুলে নিতে হবে।

অভিযুক্ত কৃষকের বিষয়টি মানতে কষ্ট হলেও তিনি মেনে নিয়েছেন। যদিও তিনি বলেছেন, ঐতিহ্য বিলীন হয়ে যাচ্ছে।

শব্দ দূষণের বিরুদ্ধে সুইসের আছে আরও কিছু দৃষ্টান্তমূলক উদাহরণ। যেমন- শব্দ দূষণের কারণে জুরিখের বিমানবন্দরে মধ্যরাতের পর কোনো বিমান অবতরণ করতে পারে না। মধ্যরাতে সুইসে কোনো যাত্রীবাহী ট্রেনও যাতায়াত করে না। জুরিখ মেইন স্টেশনে এ সময় কেউ প্রবেশ অথবা বের ও হতে পারেন না। কেউ যদি মনে করে যে, শেষ ট্রেনে এসে তিন ঘণ্টা স্টেশনে থেকে সকালে অন্য ট্রেন ধরব। এমন সুযোগ জুরিখ রেলস্টেশনে নেই। নিরাপত্তা পুলিশ সবাইকে স্টেশন থেকে বের করে দিয়ে সবগুলো গেটে তালা লাগিয়ে দেন।

জুরিখ শহরের বহু রাস্তায় মধ্যরাতে কোনো প্রকার গাড়ি চলাচল করতে পারে না। শব্দ দূষণ রোধে পর্যায়ক্রমে এমন নিয়ম হচ্ছে। পরিকল্পনা হচ্ছে সপ্তাহের দু’একদিন শহরকে গাড়ি চলাচলমুক্ত রাখার নিয়ম চালুর!

শব্দ দূষণ এবং আতঙ্কের আরও এক মামলায় জুরিখের ট্রাম এবং বাসের টিকিট কন্ট্রোলারদেরকে টিকিট চেকিংয়ের নিয়মেও আনতে হয়েছে পরিবর্তন। পূর্বে টিকেট কন্ট্রোলার ট্রাম বা বাসে উঠেই একটু বড় গলায় বলতেন, ‘গুরুচ্ছি মিটেনান্ট, বিলেট কন্ট্রোলে. ..’ অর্থাৎ ‘গ্রেস গড সবাইকে, টিকেট কন্ট্রোল।’

সবাই তখন টিকিট বের করে হাতে তুলে ধরতেন চেকিংয়ের জন্য। তবে, এক নারী অভিযোগ করেন, এমন শব্দ করে টিকিট কন্ট্রোলের পদ্ধতি অসভ্যতা এবং শব্দ দূষণ।

শব্দ দূষণের অভিযোগে ট্রাম এবং বাসের টিকিট কন্ট্রোলারদেরকে টিকিট চেকিংয়ের নিয়মেও পরিবর্তন আনতে হয়েছে। ছবি: সংগৃহীত

তিনি অভিযোগ করলেন, ট্রামে তিনি একটু অন্যমনস্ক ছিলেন, কিছুটা অসুস্থও ছিলেন। টিকিট কন্ট্রোলারের চিৎকারে তিনি ভয়ে কেঁপে উঠেছিলেন এবং আতঙ্কিত হয়ে পড়েন। মামলায় ক্ষতিপূরণও চেয়েছিলেন তিনি।

তার মামলার পর থেকে টিকেট কন্ট্রোলারদের এখন নিজেদের আইডি কার্ড হাতে নিয়ে যাত্রীর সামনে ভদ্রভাবে তুলে ধরতে হয়। সেই ঐতিহ্যবাহী উচ্চ শব্দটি আর তারা করেন না।

দেশটিতে হাজার বছরের ঐতিহ্যর মাথায় আঘাত করে বন্ধ করা হয়েছে জুরিখ লেকের ভেঁপুর শব্দ। আরাওয়ের এক কৃষকের গরুর গলার ঘণ্টি। জুরিখের বাস ট্রামের টিকেট কন্ট্রোলারদের সেই ঐতিহ্যবাহী হাঁকডাক ‘বিলেট কন্ট্রোলে’। তবে,  এবার বলব শব্দ নিয়ে একটি বিপরীতমুখী খবর অর্থাৎ যেখানে শব্দ নেই সেখানে বরং শব্দ না থাকাটাই অপরাধ। 

কিন্তু, আগামী মাস থেকেই আবার ইলেক্ট্রো মটরের শব্দহীন গাড়িতে বাধ্যতামূলকভাবেই লাগাতে হবে বিশেষ ইলেক্ট্রনিক বা ডিজিটাল শব্দ যন্ত্র। আধুনিক সব গাড়ির পেছনে যেতে এমন শব্দ যন্ত্রের ব্যবহার করা হয়ে থাকে এবং তা বিভিন্ন দেশের ট্রাফিক আইনে বাধ্যতামূলকও।

দুর্ঘটনা রোধে গাড়ি পিছনে যাওয়ার সময় যেন রাস্তায় চলাচলকারী সবাই শব্দ শুনে সর্তক হতে পারেন সেজন্য এসব কৃত্রিম ডিজিটাল শব্দ যন্ত্র সংযোজন করা হয়।

শব্দহীন গাড়িতেও এই ধরণের শব্দ যন্ত্র সংযোজনের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। বিশেষ করে অন্ধ এবং প্রতিবন্ধীদের স্বার্থ রক্ষার্থে। যারা চোখে কম দেখেন তারা শব্দ শুনে সর্তক হয়ে পথ চলবেন, রাস্তায় গাড়ি আছে বুঝতে পারবেন। শব্দহীন গাড়ি দৃষ্টি প্রতিবন্ধীদের জন্য বিপজ্জনক। তাই এ ক্ষেত্রে শব্দ না থাকাটাই বরং অপরাধ।

Comments

The Daily Star  | English

Israel launches major attack on Iran: what we know so far

‘Nuclear plant, military sites’ hit; strikes likely killed Iranian chief of staff, top nuclear scientists; state of emergency declared in Israel, fearing Iranian retaliation

2h ago