জগন্নাথের জীবনের জয়গান

আত্মপ্রত্যয়ী জগন্নাথ তার ৬৯ বছর বয়সেও গেয়ে চলেছেন জীবনের জয়গান। ছবি: মির্জা শাকিল/ স্টার

জগন্নাথের জন্মের পর বাবা গোপীনাথ শীল ও মা আন্না রানী ভীষণ মর্মাহত হয়েছিলেন। ছেলে দেখতে ফুটফুটে সুন্দর, কিন্তু জন্মেছে দুই হাত ছাড়াই।
হতদরিদ্র দম্পতির মনে আশংকা জন্মেছিল, ভবিষ্যতে হয়তো ভিক্ষাবৃত্তিই হবে ছেলের জীবিকার একমাত্র পথ। তবে, বাবা-মা'র সেই আশংকাকে অমূলক প্রমাণ করেছেন তিনি। কারও ওপর নির্ভর না করে নিজেকে স্বাবলম্বী করেছেন জগন্নাথ।
আত্মপ্রত্যয়ী জগন্নাথ তার ৬৯ বছর বয়সেও গেয়ে চলেছেন জীবনের জয়গান।
কথা হয় তার সঙ্গে। জানান, ১৯৫২ সালে টাঙ্গাইলের ভূঞাপুর উপজেলার নিকরাইল ইউনিয়নের কয়ড়া গ্রামে জন্ম। বাবা পেশায় ছিলেন নরসুন্দর। পরিবারে চরম দারিদ্র সত্ত্বেও পড়ালেখা করতে চেয়েছিলেন। বাড়ির পাশের প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে পঞ্চম শ্রেণি পাশ করার পর ভর্তি হয়েছিলেন পার্শ্ববর্তী নিকরাইল পলশিয়া রানী দিনমণি উচ্চ বিদ্যালয়ে। নিজের অদম্য ইচ্ছায় হাত না থাকলেও পা দিয়ে লেখাপড়া চালিয়ে গেছেন। প্রতিবন্ধী ও প্রান্তিক হওয়ায় বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তাকে বিনামূল্যে পড়ার সুযোগ দিয়েছিল।
তবে বই-খাতা-কলম ও অন্যান্য শিক্ষা উপকরণের খরচ যোগাতে কারও দ্বারস্থ হননি জগন্নাথ। গ্রামের প্রাথমিক বিদ্যালয়ের কয়েকজন ছাত্রকে পড়িয়ে নিজের পড়ালেখা চালিয়েছেন।
১৬ বছর বয়সে প্রথমবার ঢাকায় আসেন জগন্নাথ। বলেন, 'গ্রামের এক প্রতিবেশীর ডাকে বই-খাতা ব্যাগে ভরে ঢাকায় চলে আসি। 'মলুয়া' নামে একটি বাংলা সিনেমায় অভিনয়ের সুযোগও ঘটে সেসময়।' 
তবে কিছুদিন পরেই নিজের গ্রামে ফিরে যান। ১৯৬৯ সালে ম্যাট্রিক পরীক্ষায় অংশ নিয়ে পা দিয়ে লিখেই দ্বিতীয় বিভাগে উত্তীর্ণ হন। 
সেসময় দেশের উত্তাল রাজনৈতিক পরিস্থিতির কারণে দূরের কলেজে ভর্তি হওয়া তার পক্ষে সম্ভব হয়ে উঠেনি।
পরের বছর ১৯৭০ সালের ঐতিহাসিক জাতীয় নির্বাচনে স্থানীয় আওয়ামী লীগ প্রার্থীর পক্ষে নির্বাচনী প্রচারণায় অংশ নেন জগন্নাথ। নির্বাচনে মুসলিম লীগ প্রার্থী প্রিন্সিপাল ইব্রাহীম খাঁকে পরাজিত করে আওয়ামী লীগ প্রার্থী হাতেম আলী তালুকদার নির্বাচিত হন।
১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে জগন্নাথ স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে স্থানীয় মুক্তিবাহিনীর সঙ্গে কাজ করেন। তখন বাড়ির কাছে গৌরবোজ্জ্বল 'জাহাজমার' যুদ্ধের একজন সাক্ষী হন।
ঐতিহাসিক সেই যুদ্ধে কাদেরিয়া বাহিনীর অসমসাহসী বীর মুক্তিযোদ্ধারা যমুনায় অস্ত্র-গোলাবারুদ বোঝাই দুটি পাকিস্তানি জাহাজ ধ্বংস করে বিপুল সংখ্যক অস্ত্র নিজেদের দখলে নেন। এই জয় তখন মুক্তিযুদ্ধের চূড়ান্ত বিজয়কে ত্বরান্বিত করেছিল।
দেশ স্বাধীনের পর টাঙ্গাইলের কাগমারীতে মওলানা মোহাম্মদ আলী কলেজে ভর্তি হন জগন্নাথ এবং ১৯৭৩ সালে আইএ পরীক্ষায় অংশ নেন। তবে ইংরেজি দ্বিতীয়পত্রে প্রয়োজনীয় নম্বর না থাকায় উত্তীর্ণ হতে পারেননি। এতে তার হৃদয় ভেঙে যায়। পরে দারিদ্রের কারণে আর লেখাপড়া চালিয়ে যেতে পারেননি। 
জগন্নাথ দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'চাকরির জন্যে অনেক ঘুরেছি। প্রতিবন্ধী হওয়ায় কেউ চাকরি দেয়নি।'
এমন পরিস্থিতিতে জীবিকার জন্যে নিজেই কিছু করার সিদ্ধান্ত নেন জগন্নাথ। ভেবে-চিন্তে টাঙ্গাইল শহরের একটি বইয়ের দোকান থেকে কিছু বই কিনে এনে গ্রামের হাট-বাজারে ঘুরে ঘুরে বিক্রি শুরু করেন।
১৯৭৭ সালে বাড়ি থেকে প্রায় এক কিলোমিটার দূরে নিকরাইল বাজারে বইয়ের ছোট দোকান দেন জগন্নাথ। পাশাপাশি সেখানে গ্রামের প্রাথমিক বিদ্যালয়ের কয়েকজন ছাত্রকে পড়ানো শুরু করেন।
স্থানীয় বাসিন্দা হৃদয় মণ্ডল বলেন, 'জগন্নাথ শীল গরিব কিন্তু আত্মমর্যাদাশীল একজন মানুষ। ছোটবেলা থেকেই তাকে দেখে আসছি। অভাবের কারণে তাকে কখনো ভিক্ষা করতে দেখিনি।'

জগন্নাথ ১৯৮৩ সালে পার্শ্ববর্তী গোপালপুর উপজেলার ঝাওয়াইল গ্রামের মিলন রানীকে বিয়ে করেন।
মিলন রানী বলেন, কখনও অন্যের ওপর নির্ভরশীল নন তার স্বামী। দুটো হাত না থাকলেও, পা দিয়েই নিজের সব কাজ এবং পরিবারের অনেক কাজ জগন্নাথ নিজেই করেন।
টানা লোকসানে ১৯৯১ সালে জগন্নাথ তার বইয়ের দোকানটি আর রাখতে পারেননি। ভাড়া দিয়ে দেন। তবে, বাড়ি বাড়ি গিয়ে ছাত্র পড়ানো চলতে থাকে। সামান্য এই আয়ে স্ত্রী ও তিন সন্তানসহ পরিবারের সদস্যদের খাবার ও অন্যান্য প্রয়োজন মেটাতে হিমশিম খেতে হয় বলে জানান।
ক্ষোভ আর আক্ষেপ থেকে মিলন রানী বলেন, 'আমার স্বামী অন্যের বাচ্চাদের লেখাপড়া শিখতে সাহায্য করলেও অভাবের কারণে আমাদের তিন ছেলে-মেয়ের কেউই কলেজে যেতে পারেনি।'
'করোনা মহামারির আগ পর্যন্ত সবকিছু মোটামুটি ভালোই চলছিল। হঠাৎ স্কুল বন্ধ হয়ে যাওয়ায় আমার স্বামীর প্রাইভেট পড়ানো বন্ধ হয়ে যায়,' বলেন মিলন।
জগন্নাথ অবশ্য এই পরিস্থিতি নিয়ে বেশি কিছু ভাবতে নারাজ। তিনি বলেন, 'আমি কখনো আমার এই অবস্থা নিয়ে কারো কাছে নালিশ করিনি।'
এই পরিবারটি যখন চরম অনটনের মধ্য দিয়ে দিনাতিপাত করছিল, তখন স্থানীয় কর্তৃপক্ষ জগন্নাথকে একটি প্রতিবন্ধী কার্ড করে দেয়। তখন থেকে প্রতি মাসে ৭৫০ টাকা ভাতা পাচ্ছেন বলে জানান মিলন। এ ছাড়াও, স্থানীয় প্রশাসন ঘর তৈরির জন্যে ঢেউটিন ও নগদ ১৮ হাজার টাকা দিয়েছে।
জীবনের শেষ সময়ে এসে দুটো ইচ্ছের কথা জানান জগন্নাথ। মৃত্যুর আগে দখলদারের কাছ থেকে পৈতৃক জমিটুকু উদ্ধার করা আর বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনাকে একবার কাছ থেকে দেখা।

Comments

The Daily Star  | English
VAT changes by NBR

Govt divides tax authority in IMF-backed reform

An ordinance published last night disbands NBR and creates two new divisions

51m ago