বেসরকারি হাসপাতালে করোনা চিকিৎসায় সর্বস্বান্ত রোগী-পরিবার
রোকেয়া সুলতানা গত সপ্তাহে একটি বেসরকারি হাসপাতালের নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রের (আইসিইউ) শয্যায় মৃত্যুর সঙ্গে যুদ্ধ করছিলেন। সেসময় তার ছেলে মামুনুর রশীদকে দেখা যায় ফোনে কারো সঙ্গে খুব দ্রুত কথা বলতে। তিনি ফোনের অপর প্রান্তে থাকা মানুষটিকে জমি কেনার জন্য রাজী করানোর চেষ্টা করছিলেন।
দ্য ডেইলি স্টার তার সঙ্গে কথা বলতে গেলে তিনি জানান, তার ৫০ বছর বয়সী মা গত চার দিন ধরে আইসিইউতে। কিন্তু ডাক্তাররা বলতে পারছেন না কতদিন তাকে আইসিইউতে রাখতে হবে। পরিবারটি তার চিকিৎসার জন্য এক লাখ ২০ হাজার টাকা নিয়ে এসেছিল। ইতোমধ্যে সব টাকা খরচ হয়ে গেছে।
বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা অনেক ব্যয়বহুল জানিয়ে মামুনুর বলেন, 'অর্ধেক টাকা আত্মীয়-স্বজনের কাছ থেকে ধার করে আনা। বর্তমান বাজার মূল্যের চেয়ে কম দামে বাড়ির উঠানের দুই শতাংশ জমি মাত্র দেড় লাখ টাকায় বিক্রি করছি। আরও টাকার প্রয়োজন। প্রয়োজনে বাড়িটাও বিক্রি করে দেব।'
মামুনুর ও তার ভাইয়েরা দিন মজুরের কাজ করেন। তাদের বৃদ্ধ বাবা শয্যাশায়ী। সামান্য যেটুকু সম্পত্তি আছে সেটা বিক্রি করা ছাড়া টাকা পাওয়ার আর কোনো উপায় তাদের নেই বলে জানান।
কিন্তু, সব প্রচেষ্টা ব্যর্থ করে দিয়ে গত ২০ আগস্ট মারা যান রোকেয়া।
ইতোমধ্যে পরিবারটি তার চিকিৎসার জন্য চার লাখ টাকা ব্যয় করে ফেলেছে। এর মধ্যে হাসপাতালে ছয় দিন ভর্তি থাকার বাবদ খরচ তিন লাখ ২০ হাজার টাকা।
গতকাল সোমবার দ্য ডেইলি স্টারের সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে মামুনুর জানান, মায়ের করোনাভাইরাস ধরা পড়ার পর তারা তাকে কুমিল্লায় স্থানীয় উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে যান। তিনি শ্বাসপ্রশ্বাসের সমস্যার কথা জানালে দ্রুত কুমিল্লা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়।
কিন্তু সেখানে কোনো শয্যা খালি না থাকায় তাকে কুমিল্লার একটি বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি করাতে বাধ্য হয় তার পরিবার। পরবর্তীতে অবস্থার অবনতি হলে তাকে ঢাকায় নেওয়া হয়।
'ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ও ডিএনসিসি (ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন) হাসপাতালে নিয়ে গেলেও কোথাও শয্যা খালি ছিল না', বলেন মামুনুর।
তিনি আরও বলেন, 'মাকে কুমিল্লা থেকে অ্যাম্বুলেন্সে করে আনতে এবং বিভিন্ন হাসপাতালে শয্যা খুঁজতে গিয়ে ভাড়া দিতে হয়েছে প্রায় ৩০ হাজার টাকা।'
মামুনুর বলেন, 'অবশেষে আমরা ডিএনসিসি হাসপাতালে একটি শয্যা খালি পাই।'
রোকেয়ার মতো আরও অনেক নিম্ন ও মধ্যবিত্ত পরিবার করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগীদের চিকিৎসা করাতে গিয়ে আর্থিক সংকটে পড়ছেন কিংবা সর্বস্বান্ত হয়ে যাচ্ছেন। কারণ সরকারি হাসপাতালে শয্যা সংকটের কারণে তাদের যেতে হচ্ছে বেসরকারি হাসপাতালে।
ঢাকার পাঁচটি বেসরকারি হাসপাতালে সরেজমিনে গিয়ে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগীদের পরিবারের প্রায় এক ডজন সদস্যের সঙ্গে কথা বলেছে দ্য ডেইলি স্টার। তাদের বেশিরভাগই জানিয়েছেন, চিকিৎসা খরচ মেটাতে শেষ সম্বল বিক্রি করতে বাধ্য হয়েছেন তারা। তারপরও চিকিৎসার জন্য অর্থ জোগাড় করতে গিয়ে তাদেরকে দেনার দায়ে ডুবতে হচ্ছে।
৬০ বছর বয়সী মনোয়ারা বেগমের পরিবারের ঘটনাও একই রকম।
গত ২৮ জুলাই মিরপুরের একটি বেসরকারি হাসপাতালে আইসিইউতে ভর্তি হন মনোয়ারা। কয়েকদিন পরে তাকে লাইফ সাপোর্টে দেওয়া হয়। ২০ আগস্ট মারা যান তিনি।
যতদিন তিনি লাইফ সাপোর্টে ছিলেন, প্রতিদিনের জন্য তার পরিবারকে ৫০ হাজার টাকা করে খরচ করতে হয়েছে। চিকিৎসা চালিয়ে যেতে শেষ সঞ্চয়টুকু পর্যন্ত খরচ করেছে পরিবারটি। তাদের এমন কোনো আত্মীয় নেই যার কাছ থেকে তারা ধার নেননি।
মনোয়ারার স্বামী জাহাঙ্গীর আলম বলেন, 'আমরা ছেলের আয়ের ওপর পুরোপুরি নির্ভরশীল। সে একজন গ্রাফিক্স ডিজাইনার। মাসে ২৫ হাজার টাকার মতো বেতন পায়। মনোয়ারার চিকিৎসার জন্য গ্রামে আমাদের পৈত্রিক সম্পত্তি বিক্রি করে দিয়েছি।'
বেসরকারি হাসপাতালগুলোতেও শয্যার তীব্র সংকটের কারণে আর্থিক সীমাবদ্ধতায় থাকা রোগীদের দুর্দশা আরও বেড়েছে।
পাঁচ বছর বয়সী সন্তানের মা সানিয়া আক্তারের (২৩) প্রতি মিনিটে আট লিটার হারে নিরবচ্ছিন্ন অক্সিজেন প্রবাহ সুবিধাসহ একটি কোভিড শয্যার জরুরি প্রয়োজন ছিল। কিন্তু সাভার থেকে আসা সানিয়া কোনো সরকারি হাসপাতালে শয্যা পাননি।
পেশায় দিন মজুর সানিয়ার ভাই মোহাম্মদ ইব্রাহিম বলেন, 'যখন সব হাসপাতাল ফিরিয়ে দিচ্ছিল, মনে হচ্ছিল আমার বোনটা অ্যাম্বুলেন্সেই মারা যাবে। তখন অ্যাম্বুলেন্সের চালক আমাদেরকে শ্যামলীতে একটি নির্মাণাধীন হাসপাতালে নিয়ে যায়। যেখানে মাত্র কয়েকটি আইসিইউ শয্যা চালু হয়েছে। কিন্তু তারা এখনও সাধারণ ওয়ার্ড চালু করেনি।'
ইব্রাহিম বলেন, 'সেখানে আইসিইউয়ের খরচ দিতে হয়েছে। আমাদের অসহায় অবস্থা বিবেচনা করে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ ৫০ হাজার টাকা ছাড় দেয়।'
তারপরেও তাকে সর্বমোট দুই লাখ টাকার বিল দিতে হয়।
তিনি বলেন, 'আমরা বোনকে ফিরে পেয়ে খুশি। কিন্তু আমি এখন দেনার দায়ে জড়িয়ে গেছি। বাধ্য হয়ে উচ্চ সুদের হারে টাকা ধার নিতে হয়েছে। জানি না এসব ঋণ কীভাবে শোধ করবো।'
স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের হেলথ ইকোনমিকস ইউনিটের (এইচইইউ) এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, একজন করোনা আক্রান্ত রোগীকে বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে সরকারি হাসপাতালের চেয়ে কমপক্ষে দ্বিগুণ খরচ করতে হয়।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বেসরকারি হাসপাতালে সাধারণ শয্যার গড় দৈনিক খরচ ৩৭ হাজার ১২৮ টাকা এবং আইসিইউ শয্যার গড় খরচ ৬৮ হাজার ৮৮৫ টাকা।
বাংলাদেশ প্রাইভেট ক্লিনিক অ্যান্ড ডায়াগনস্টিকস ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের মহাসচিব ডা. মইনুল আহসান বলেন, 'করোনাভাইরাসের চিকিৎসা বেশ ব্যয়বহুল। কোভিড ইউনিট পরিচালনার খরচ অনেক বেশি হওয়ায় আমরা রোগীদের খুব বেশি ছাড় দিতে পারি না।'
তিনি আরও বলেন, 'এ ছাড়াও, হাসপাতালে করোনাভাইরাস ছাড়া অন্যান্য রোগে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা অনেক কমে গেছে। মহামারির কারণে মানুষ জরুরি পরিস্থিতি না হলে হাসপাতাল বা ডায়াগনস্টিক সেন্টারে আসেন না।'
'আমরা যদি করোনা রোগীদের অনেক বেশি ছাড় দেই, তাহলে সেবা অব্যাহত রাখতে পারবো না', যোগ করেন তিনি।
এইচইইউ গবেষণা দলের নেতা ডা. মো. নুরুল আমিন বলেন, 'সারা বিশ্বেই করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগীদের চিকিৎসা খরচ তূলনামুলকভাবে বেশি। কারণ এর সঙ্গে যুক্ত হয় ওষুধের উচ্চ মূল্য, জনশক্তি ও অবকাঠামো রক্ষণাবেক্ষণের বর্ধিত ব্যয়। কিন্তু তার মানে এই না যে হাসপাতালগুলো অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল মানুষের ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকবে।'
তিনি জানান, সরকার আর্থিক সহায়তা দিতে পারে অথবা যারা বেসরকারি ক্লিনিকে ভর্তি হতে বাধ্য হয়েছেন তাদের চিকিৎসার খরচ দিতে পারে।
প্রতিবেদনটি ইংরেজি থেকে অনুবাদ করেছেন মোহাম্মদ ইশতিয়াক খান।
Comments