কি কথা তাহার সাথে? তার সাথে!

১৫ আগস্ট অবিশ্বাস্য দ্রুততায় তালেবানের হাতে কাবুলের নিয়ন্ত্রণ যাওয়ার পর ১০ দিন চলে গেছে। কিন্তু এখন পর্যন্ত তালেবান কেন্দ্রীয় সরকার গঠনের কাজে তেমন অগ্রগতির খবর পাওয়া যায়নি। যদিও দুএকটি প্রদেশে (যেমন: জাবুল ও পাকতিয়া) প্রাদেশিক গভর্নর নিয়োগ দেওয়া হয়েছে বলে শোনা যাচ্ছে। আরও শোনা যাচ্ছে সরকার গঠন নিয়ে বিভিন্ন পর্যায়ের স্টেকহোল্ডারদের সঙ্গে নাকি তালেবানের আলোচনা চলছে। এই অবস্থাতেই ২৪ আগস্ট মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএর পরিচালক উইলিয়াম বার্নস কাবুলে তালেবান নেতা মোল্লা আবদুল গনি বারাদারের সঙ্গে বৈঠক করেছেন।
সিআইএ প্রধান উইলিয়াম বার্নস ও তালেবান নেতা আবদুল গনি বারাদার

১৫ আগস্ট অবিশ্বাস্য দ্রুততায় তালেবানের হাতে কাবুলের নিয়ন্ত্রণ যাওয়ার পর ১০ দিন চলে গেছে। কিন্তু এখন পর্যন্ত তালেবান কেন্দ্রীয় সরকার গঠনের কাজে তেমন অগ্রগতির খবর পাওয়া যায়নি। যদিও দুএকটি প্রদেশে (যেমন: জাবুল ও পাকতিয়া) প্রাদেশিক গভর্নর নিয়োগ দেওয়া হয়েছে বলে শোনা যাচ্ছে। আরও শোনা যাচ্ছে সরকার গঠন নিয়ে বিভিন্ন পর্যায়ের স্টেকহোল্ডারদের সঙ্গে নাকি তালেবানের আলোচনা চলছে। এই অবস্থাতেই ২৪ আগস্ট মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএর পরিচালক উইলিয়াম বার্নস কাবুলে তালেবান নেতা মোল্লা আবদুল গনি বারাদারের সঙ্গে বৈঠক করেছেন। দেশটিতে হাজার হাজার মানুষ যখন স্মরণকালের ভয়াবহতম মানবিক বিপর্যয়ের মুখোমুখি, ঠিক তখনই এই ধরনের একটি বৈঠক অনুষ্ঠিত হলো। স্বভাবতই প্রশ্ন উঠছে মাত্র ১০ দিনেই কী এমন ঘটল যে খোদ সিআইএ প্রধানকে কাবুলে উড়ে আসতে হলো? এদিকে সিআইএ প্রধানের সফরের মাত্র একদিন আগেই (২৩ আগস্ট) সাবেক প্রেসিডেন্ট হামিদ কারজাই এবং জাতীয় রিকনসিলিয়েশন কমিশনের প্রধান ডা. আব্দুল্লাহ আব্দুল্লাহর সঙ্গেও তালেবানের বৈঠক হয়েছে। হামিদ কারজাই একসময় সাবেক মার্কিন প্রতিরক্ষামন্ত্রী ডিক চেনির কোম্পানিতে কাজ করেছেন এবং বরাবরই যুক্তরাষ্ট্র ঘেষা। ২০০৪ সালে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার পর যতবারই পাকিস্তান সফরে গেছেন, তিনি মুমূর্ষুপ্রায় তালেবানের উদ্দেশে বলেছেন 'তালেবান আমার ভাই, আমি তালেবানের ভাই'। ২০১১ সালে তার সৎ ভাই আহমদ ওয়ালি কারজাই যখন তালেবানের কথিত আত্মঘাতী হামলায় নিহত হন, তখনও হামিদ কারজাই তালেবানের প্রতি কোনো কড়া মন্তব্য করেননি। তালেবানের প্রতি তার এই ভ্রাতৃপ্রেম এখনো অটুট আছে। এদিকে কান্দাহারি পশতুন পিতা এবং পাঞ্জশীরি তাজিক মায়ের সন্তান ডা. আব্দুল্লাহ নিজেকে সব সময়ই নর্দার্ন এলায়েন্সের ঘনিষ্ঠজন হিসেবে জাহির করে আসছেন। তিনি কারজাইয়ের প্রথম মেয়াদে কিছুদিন পররাষ্ট্রমন্ত্রীর দায়িত্বও পালন করেছেন। ২০১৪ সালের বিতর্কিত প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে প্রথম দফায় তিনি আশরাফ গনির চেয়ে অন্তত ১০ শতাংশ ভোটে এগিয়ে ছিলেন। কিন্তু দ্বিতীয় রাউন্ডের নির্বাচনে তিনি অল্প ব্যবধানে আশরাফ গনির কাছে হেরে যান। যুক্তরাষ্ট্র এবং জাতিসংঘের মধ্যস্থতায় তখন দেশটির 'চিফ এক্সিকিউটিভ' নামে একটি নতুন পদ সৃষ্টি করে তাকে সেখানে অধিষ্ঠিত করা হয়। সে সময়ে অনেকেই মনে করেছিলেন প্রেসিডেন্ট শাসিত সরকার ব্যবস্থার একটা দেশে প্রেসিডেন্ট পদের সমান্তরাল 'চিফ এক্সিকিউটিভ' পদ সৃষ্টি বিদ্যমান সংকটকে সমাধান করার পরিবর্তে ঘনীভূতই করবে বেশি। বাস্তবেও তা-ই হয়েছে। 

এদিকে আফগানিস্তানের জাতীয় নিরাপত্তা বিভাগের সাবেক প্রধান ও আশরাফ গনির প্রথম ডেপুটি আমরুল্লাহ সালেহ প্রেসিডেন্ট আশরাফ গণির দেশ ত্যাগের সঙ্গে সঙ্গে নিজেকে ভারপ্রাপ্ত প্রেসিডেন্ট ঘোষণা দিয়ে তালেবানদের প্রতিরোধ করার প্রত্যয় ব্যক্ত করেছেন। তার সঙ্গে রয়েছেন 'পাঞ্জশীরের সিংহ' বলে খ্যাত আহমাদ শাহ মাসুদের ছেলে আহমাদ মাসুদ। দুজনই পাঞ্জশীরি। তারা তালেবানের বিরুদ্ধে একটা সংঘবদ্ধ প্রতিরোধ গড়ে তুলতে সারা দেশের সাবেক নর্দার্ন এলায়েন্সের সব 'মুজাহিদিনদের' আহ্বান জানিয়েছেন। এ অবস্থায় সবাই ভেবেছিল দেশটিতে আরেকটি রক্তক্ষয়ী সংঘাত আসন্ন। কিন্তু গত দুদিনে আহমাদ মাসুদের স্বর অনেকটাই নরম হয়ে এসেছে। প্রথম দিকে মাসুদ তালেবান কর্তৃত্বকে সম্পূর্ণভাবে অস্বীকার করলেও এখন বলছেন 'ইনক্লুসিভ' সরকারের কথা। হামিদ কারজাই এবং ডা. আব্দুল্লাহও 'ইনক্লুসিভ' সরকারের কথা বলেছেন। শোনা যাচ্ছে তালেবানও ইঙ্গিত দিয়েছে 'ইনক্লুসিভ' সরকারের বিষয়ে।

ইনক্লুসিভ শব্দটির আভিধানিক অর্থ যা-ই হোক না কেন—আফগান বাস্তবতায় এর অর্থ হলো ভাগাভাগির সরকার। অর্থাৎ 'কিছু তুমি নাও, কিছু আমাকে দাও'। আসলে এই ইনক্লুসিভ সরকারের কথাটি প্রথম শোনা যায় ২০০১ সালে তালেবান সরকারের পতনের পর। একটা যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশে সবার অংশগ্রহণে এবং সবাইকে সম্পৃক্ত করে সরকার পরিচালনার জন্যই তখন এই ইনক্লুসিভ ধারনার কথা বলা হয়েছিল। কিন্তু বাস্তবে এটি হয়ে দাঁড়াল আফগান সমাজের ওয়ার লর্ডদের পুনর্বাসনের একটি প্রকল্প। ২০ বছরেও এ থেকে বেরিয়ে আসতে পারেনি আফগানিস্তান। গত শতাব্দীর আশির দশকে যে সব ওয়ার লর্ড তদানীন্তন সোভিয়েত ইউনিয়নের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে সামিল হয়েছিলেন তারা সবাই সরকারের অংশ হতে চায়। এদেরকে বাদ দিয়ে সরকার পরিচালনা আসলেই কঠিন। কারণ আফগান সমাজে এরা প্রায় সার্বভৌম। এরা সরকার নিয়ে যত কথাই বলুক না কেন এদের প্রথম আনুগত্য স্বার্থের প্রতি। দ্বিতীয় আনুগত্য তার নিজের গোত্রের প্রতি। স্বার্থের সামান্য হেরফের হলে এরা আনুগত্য পরিবর্তনে মোটেও দ্বিধা করে না। এর প্রকৃষ্ট প্রমাণ উজবেক ওয়ার লর্ড জেনারেল আব্দুর রশিদ দোস্তাম। শুরুতে কমিউনিস্ট সরকারের সমর্থক হলেও হঠাৎ করেই হাত মিলান আহমাদ শাহ মাসুদের সঙ্গে। অতঃপর তালেবানের বিরুদ্ধে ভয়ংকর মূর্তি ধারণ করে যুদ্ধে লিপ্ত হন। কিন্তু অভিযোগ আছে গোপনে নাকি তালেবানের সহায়তাও করেছেন। এমন আরও আছে। এইসব ওয়ার লর্ডরা তাদের স্বার্থসিদ্ধির জন্য তাদের নিজ নিজ গোত্রকে ব্যবহার করেন। এদের বেশির ভাগেরই রয়েছে প্রতিবেশী দেশের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ ব্যক্তিগত সম্পর্ক। সম্পর্ক গড়তে গিয়ে এদের অনেকেই প্রতিবেশী দেশে বিয়ে পর্যন্ত করেছেন। অবশ্য এদের অনেকের একাধিক স্ত্রী রয়েছে। এদের প্রত্যেকেরই ঐসব দেশে আছে দ্বিতীয় আবাস—যাতে খারাপ সময়ে তারা ওখানে আশ্রয় নিতে পারেন। যারাই ক্ষমতায় আসুক—এই ওয়ার লর্ডদের এড়িয়ে রাষ্ট্র পরিচালনা সম্ভব না। হামিদ কারজাইও এদের সঙ্গে সমন্বয় করেই কাজ করেছেন। আশরাফ গনিও করেছেন। তালেবান কী করবে—এই প্রশ্ন যখন ঘুরপাক খাচ্ছে, তখনই সিআইএ পরিচালক কাবুলে তালেবানের সঙ্গে আলোচনায় মিলিত হয়েছেন। অবশ্য, তার মাত্র দুদিন আগেই পাকিস্তানের গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআইর প্রধানও তালেবানের সঙ্গে সভা করেছেন বলে জানা গেছে। কিন্তু সিআইএ কিংবা আইএসআই প্রধানরা তালেবানের সঙ্গে কী বিষয়ে আলোচনা করেছেন তা জানা যায়নি। তবে প্রশ্ন থেকেই যায় সিআইএ কিংবা আইএসআইর প্রধানদের এই সফর 'ইনক্লুসিভ' প্রশাসনের নামে দেশটিতে প্রায় তিন দশক ধরে চলে আসা ভাগাভাগির রাজনীতির ধারাবাহিকতা রক্ষার আরেকটি প্রয়াস নয়তো?

মোশতাক আহমেদ: সাবেক জাতিসংঘ কর্মকর্তা, পলিটিক্যাল অ্যাফেয়ার্স অফিসার, আফগানিস্তান

[email protected]

(দ্য ডেইলি স্টারের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির আইনগত, মতামত বা বিশ্লেষণের দায়ভার সম্পূর্ণরূপে লেখকের, দ্য ডেইলি স্টার কর্তৃপক্ষের নয়। লেখকের নিজস্ব মতামতের কোনো প্রকার দায়ভার দ্য ডেইলি স্টার নিবে না।)

Comments

The Daily Star  | English

Horrors inside the Gaza genocide: Through a survivor’s eyes

This is an eye-witness account, the story of a Palestinian in Gaza, a human being, a 24-year-old medical student, his real human life of love and loss, and a human testimony of war crimes perpetrated by the Israeli government and the military in the deadliest campaign of bombings and mass killings in recent history.

8h ago