শেয়ার কারসাজি: এনআরবি ব্যাংকের লোকসান ১০৩ কোটি টাকা

পুঁজিবাজারে শেয়ার কারসাজিকারীদের সুবিধা দিতে উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে ১০৩ কোটি টাকা লোকসান করেছে এনআরবি ব্যাংক। ব্যাংকটির এই অনৈতিক চর্চা একদিকে যেমন ব্যাংকটির আর্থিক অবস্থাকে দুর্বল করে তুলেছে, তেমনি আমানতকারীদের অর্থও ঝুঁকির মুখে ফেলে দিয়েছে।

পুঁজিবাজারে শেয়ার কারসাজিকারীদের সুবিধা দিতে উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে ১০৩ কোটি টাকা লোকসান করেছে এনআরবি ব্যাংক। ব্যাংকটির এই অনৈতিক চর্চা একদিকে যেমন ব্যাংকটির আর্থিক অবস্থাকে দুর্বল করে তুলেছে, তেমনি আমানতকারীদের অর্থও ঝুঁকির মুখে ফেলে দিয়েছে।

চলতি মাসে পরিচালিত এই বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংকটির একটি বিশেষ অভ্যন্তরীণ নিরীক্ষা (অডিট) অনুসারে, এ বছরের জানুয়ারি থেকে আগস্ট মাসের মধ্যে এই অনৈতিক ব্যবসায়িক কর্মকাণ্ডটি সংঘটিত হয়। যার মাধ্যমে ব্যাংকটি বেশি দামে শেয়ার কিনে তা কম দামে বিক্রির মাধ্যমে শেয়ার বাজারে কারসাজিকারীদের অবৈধ সুবিধা দেয়।

যদিও ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মামুন মাহমুদ শাহ বলছেন, প্রকৃতপক্ষে ব্যাংকটি লোকসান করেছে ৩১ কোটি টাকা। এই অনিয়মের জন্য ব্যাংকের কিছু কর্মীকে দায়ী করেন তিনি।

বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তাদের ভাষ্য, আমাতনকারীদের অর্থের ওপর এই অবৈধ ব্যবসায়িক কার্যক্রমের একটা বিরূপ প্রভাব আছে। কারণ ব্যাংকটি শেয়ারবাজারে বিনিয়োগের নামে তাদের তহবিলের অপব্যবহার করেছে।

নিরীক্ষা প্রতিবেদনে বলা হয়, 'এ সময়ের মধ্যে প্রায় সব শেয়ারই আলোচনা ও চুক্তির ভিত্তিতে ক্রয়-বিক্রয় হয়।'

প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, কারসাজিকারীদের মুনাফা করার সুযোগ তৈরি করে দেওয়ার জন্য এনআরবি ব্যাংক তুলনামূলক বেশি দামে শেয়ার কিনে তা গড় বাজারমূল্যের চেয়ে কম দামে বিক্রি করে।

উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, ২০ থেকে ২২ শতাংশ কমে কেনার সুযোগ থাকলেও ব্যাংকটি প্যারামাউন্ট ইনস্যুরেন্সের শেয়ার উচ্চ দামে কিনেছিল।

এ ছাড়া আইন লঙ্ঘন করে ঋণদাতা এই প্রতিষ্ঠানটি পাইওনিয়ার ইনস্যুরেন্সে তার বিনিয়োগযোগ্য তহবিলের প্রায় ৫৮ শতাংশ বিনিয়োগ করে।

এনআরবি ব্যাংক ৪৫৪ কোটি টাকায় এই বীমা প্রতিষ্ঠানের ২৭ লাখ ৩৬ হাজার শেয়ার কেনে। যদিও নিয়ন্ত্রক সংস্থার শর্ত মানতে পরবর্তীতে তারা ১৯ লাখ শেয়ার লোকসানে বিক্রি করতে বাধ্য হয়।

ব্যাংক কোম্পানি আইন-১৯৯১ অনুসারে, শেয়ার প্রিমিয়াম ও সিঙ্গেল স্টকে রিটেইন্ড আর্নিংসের ক্ষেত্রে একটি ব্যাংক তার মোট মূলধনের ৫ শতাংশের বেশি বিনিয়োগ করতে পারবে না।

একইভাবে প্যারামাউন্ট ইনস্যুরেন্স লিমিটেডের শেয়ারও কেনে ব্যাংকটি।

নিরীক্ষা প্রতিবেদনে বলা হয়, ১২ জানুয়ারি এনআরবি ব্যাংক প্রতিটি ১৪৪ টাকা ৩০ পয়সা মূল্যে প্যারামাউন্ট ইনস্যুরেন্সের এক লাখ শেয়ার কিনতে শুরু করে। এই দাম ছিল সেদিনের সর্বোচ্চ এবং আগের দিনের তুলনায় ২২ দশমিক ১৭ শতাংশ বেশি।

পরের দিন থেকে ওই শেয়ারের দাম কমতে শুরু করে এবং ১৭ জানুয়ারি প্রতিটি শেয়ারের দাম দাঁড়ায় ১২২ টাকা ৮০ পয়সায়। কিন্তু সে সময় এনআরবি ব্যাংক কোনো শেয়ার কেনেনি।

অন্যদিকে জানুয়ারির ২০ তারিখে যখন শেয়ারের দাম ঊর্ধ্বমুখী হতে শুরু করে তখন এনআরবি ব্যাংক প্রতিটি ১৪৮ টাকা ৭৯ পয়সা মূল্যে এক লাখ শেয়ার কেনে। ১৭ জানুয়ারিতে থাকা দামের তুলনায় যা ছিল ২৭ দশমিক ১৬ শতাংশ বেশি।

২৪ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ব্যাংকটি গড়ে ১২০ টাকা ৭৫ পয়সা মূল্যে প্যারামাউন্ট ইনস্যুরেন্সের ৫ লাখ ৮৮ হাজার শেয়ার কিনেছে।

জিবিবি পাওয়ার কোম্পানি, এসকে ট্রিমসের মতো আরও অনেক প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রেও এনআরবি ব্যাংক একই ধরনের ক্রয় কার্যক্রম অব্যাহত রাখে।

একইসঙ্গে পুঁজিবাজারে তহবিল বিনিয়োগের ক্ষেত্রেও এই বেসরকারি ঋণদাতা প্রতিষ্ঠানটি নিয়ম ভেঙেছে।

উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের একটি প্যাকেজের আওতায় এনআরবি ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ পুঁজিবাজারে বিশেষ তহবিলের (স্পেশাল পারপাস ফান্ড) সর্বোচ্চ ৫০ কোটি টাকা বিনিয়োগের অনুমোদন দিয়েছে।

অথচ নিরীক্ষা দল দেখতে পায় যে, বিনিয়োগের এই সীমা ৬ কোটি টাকা ছাড়িয়ে গেছে, যা একটা দণ্ডযোগ্য অপরাধ।

এ ছাড়া নিজেদের নিয়মও ভেঙেছে এনআরবি ব্যাংক।

ব্যাংকের সিদ্ধান্ত ছিল, একটা নির্দিষ্ট শিল্পে সর্বাধিক বিনিয়োগ কোনোক্রমেই মোট তহবিলের ৩০ শতাংশের বেশি হবে না। যদিও ব্যাংকটি বীমা খাতে মোট তহবিলের ৬২ দশমিক ৫ শতাংশ বিনিয়োগ করেছে।

গত ১৬ সেপ্টেম্বর কেন্দ্রীয় ব্যাংক বিনিয়োগের সীমার বাইরে গিয়ে শেয়ার কিনে সিকিউরিটিজ আইন ভাঙার জন্য এনআরবি ব্যাংককে ৪৯ লাখ ৫০ হাজার টাকা জরিমানা করে।

পুঁজিবাজার বিশ্লেষক অধ্যাপক আবু আহমেদ বলেন, 'যখন সব বিশ্লেষক বলছেন যে বীমা খাত অতিমূল্যায়িত হয়ে উঠেছে, তখন ব্যাংকটি এই খাতে বিনিয়োগ করেছে। এটা স্পষ্ট যে ব্যাংকটি অন্যদের সুবিধা দেওয়ার চেষ্টা করছে। এটা এদিক-ওদিক (ম্যানিপুলেশন) করার একটা অংশ।'

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের সাবেক এই চেয়ারম্যানের ভাষ্য, খারাপ ব্যাপারটি হচ্ছে ব্যাংকটি আমাতনকারীদের অর্থ নষ্ট করেছে। তিনি বলেন, 'কেন্দ্রীয় ব্যাংক এই ব্যাংকটিকে জরিমানা করেছে। কিন্তু আমানতকারীদের অর্থের ক্ষতির জন্য দায়ীরা শাস্তির মুখোমুখি হননি।'

বাংলাদেশ ব্যাংকের একজন কর্মকর্তার বক্তব্য, অনৈতিক বাণিজ্যচর্চায় জড়িত হওয়ার মাধ্যমে ব্যাংকটি আমানতকারীদের তহবিল অপব্যবহার করেছে। সুতরাং কেন্দ্রীয় ব্যাংক শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিয়েছে।

এনআরবি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মামুন মাহমুদ শাহ জানান, এই অপকর্মে জড়িত থাকার অভিযোগে ব্যাংকের প্রধান অর্থ কর্মকর্তা মো. কামরুল হাসানসহ চার কর্মীকে বরখাস্ত করা হয়েছে।

নিরীক্ষা প্রতিবেদনে এই কেলেঙ্কারির জন্য মূলত হাসানকেই দায়ী করা হয়। যিনি চলতি বছরের শুরুতে ব্যাংকটিতে যোগ দেন।

অনিয়ম রোধে ব্যাংকের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা কেন ব্যর্থ হলেন— জানতে চাইলে মাহমুদ শাহ জানান, বেশিরভাগ অনিয়ম সংঘটিত হয়েছে জুন মাসের ১৪ দিনের মধ্যে।

যদিও নিরীক্ষা প্রতিবেদন বলছে, জুন পর্যন্ত ছয় মাসের ভেতরেই অসঙ্গতিগুলো ঘটেছে।

মাহমুদ শাহ বলেন, 'আমরা বিষয়টাকে অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে নিয়েছি। আর জড়িতদের বিরুদ্ধে আরও শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হবে।'

নিরীক্ষা প্রতিবেদনে বলা হয়, বিনিয়োগ ব্যাংকিং ইউনিটের সব কার্যক্রম পর্যালোচনা করার পর এটা সহজেই উপলব্ধি করা যায় যে, ব্যাংকের অভ্যন্তরীণ নীতি ও নিয়ন্ত্রক সংস্থার পলিসি না মেনেই শেয়ারে বিনিয়োগ করা হয়েছে।

এতে আরও বলা হয়, বিনিয়োগ কমিটি কার্যকর থাকলেও তা কামরুল হাসানের ওপর বেশিমাত্রায় নির্ভরশীল ছিল।

এ বিষয়ে মন্তব্যের জন্য কামরুল হাসানের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলেও তাকে পাওয়া যায়নি।

নিরীক্ষা প্রতিবেদনে বলা হয়, ব্যাংকের বিনিয়োগ কমিটির এক সভায় কামরুল হাসান জানান যে, মুনাফা বাড়াতে তিনি একদল ক্রেতা ও বিক্রেতাকে ব্যবহার করেছেন।

বিষয়টি নিয়ে দ্য ডেইলি স্টার অন্যান্য বাণিজ্যিক ব্যাংকের আরও কয়েক জন কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলেছে। তাদের ভাষ্য, এ জন্য অল্প কিছু কর্মকর্তার ওপর দোষ চাপানোর কোনো সুযোগ নেই।

ওই কর্মকর্তারা বলেন, সাধারণত পুঁজিবাজারে বিনিয়োগের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয় ব্যাংকের শীর্ষ ব্যবস্থাপনা। এ ক্ষেত্রে তাদের পাশ কাটিয়ে যদি কেবল প্রধান অর্থ কর্মকর্তা ও জুনিয়র কর্মকর্তারা এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেন, তাহলে ওই ব্যাংকে করপোরেট সুশাসনের অভাব আছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুসারে, সাম্প্রতিক মাসগুলোতে এনআরবি ব্যাংকের সার্বিক অর্থনৈতিক অবস্থা খারাপ হয়েছে। গত জুন পর্যন্ত এর খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ২৮৭ কোটি টাকায়। গত বছরের তুলনায় যা ৯৩ শতাংশ বেশি।

পুঁজিবাজারে কীভাবে বিনিয়োগ করা হয়, তা নিয়মিত পর্যবেক্ষণের জন্য ব্যাংকগুলোর শীর্ষ কর্মকর্তাদের প্রতি আহ্বান জানান অধ্যাপক আবু আহমেদ। কারণ এতে আমানতকারীদের অর্থ ঝুঁকিতে থাকে।

অনুবাদ করেছেন মামুনুর রশীদ

Comments