অস্ট্রেলিয়ার মসজিদে ১২৭ বছরের পুরনো বাংলা পুঁথি

২০০৯ সালে অস্ট্রেলিয়ার মরু অঞ্চল ব্রোকেনহিলের এক আদিবাসী গ্রামের একটি মসজিদে পাওয়া গিয়েছিল ‘কাসাসুল আম্বিয়া’ নামের একটি বাংলা পুঁথি। প্রায় ১২৭ বছর আগে কলকাতার বটতলা প্রকাশনী থেকে গ্রন্থটি প্রকাশিত হয়েছিল। প্রকাশকাল ১৮৯৪। প্রকাশক কাজী সফিউদ্দিন আরবি ‘কাসাসুল আম্বিয়া’ থেকে পুঁথির ছন্দে বাংলায় গ্রন্থটি অনুবাদ করেছিলেন।
অস্ট্রেলিয়ার মরু অঞ্চল ব্রোকেনহিলের আদিবাসী গ্রামের এক মসজিদে পাওয়া ‘কাসাসুল আম্বিয়া’ বাংলা পুঁথি। ছবি: সংগৃহীত

২০০৯ সালে অস্ট্রেলিয়ার মরু অঞ্চল ব্রোকেনহিলের এক আদিবাসী গ্রামের একটি মসজিদে পাওয়া গিয়েছিল 'কাসাসুল আম্বিয়া' নামের একটি বাংলা পুঁথি। প্রায় ১২৭ বছর আগে কলকাতার বটতলা প্রকাশনী থেকে গ্রন্থটি প্রকাশিত হয়েছিল। প্রকাশকাল ১৮৯৪। প্রকাশক কাজী সফিউদ্দিন আরবি 'কাসাসুল আম্বিয়া' থেকে পুঁথির ছন্দে বাংলায় গ্রন্থটি অনুবাদ করেছিলেন।

ব্রোকেনহিল মসজিদ। ছবি: সংগৃহীত

যে মসজিদে ওই গ্রন্থ পাওয়া গিয়েছিল সেটি ছিল আফগান উট চালকদের নির্মিত। ১৮৮০ সালে ব্রোকেনহিলে প্রচুর খনিজ সম্পদ পাওয়া যায়। তা পরিবহনের জন্য ব্রোকেনহিল থেকে পিরি বন্দর পর্যন্ত প্রায় ৫০০ কিলোমিটার রেলপথ নির্মিত হচ্ছিল। বিপুল পরিমাণ নির্মাণ সামগ্রী বহন করতে ব্রিটিশ নির্মাণ সংস্থা বর্তমান আফগানিস্তান, পাকিস্তান ও ভারত থেকে প্রচুর সংখ্যক উট নিয়ে আসে। ওই উটের অধিকাংশ চালকই ছিলেন মুসলমান। তারাই নির্মাণ করেছিলেন আদিবাসী গ্রামের মসজিদটি।

ব্রোকেনহিল প্রোপ্রাইটর লিমিটেড রেললাইনের কাঁচামাল আমদানির কাজ পায়। তারা কলকাতা বন্দরকেন্দ্রিক ব্রিটিশ কোম্পানি 'পি এন্ড ও' এবং 'এস এন'র মাধ্যমে পণ্য পরিবহন শুরু করে। ভারী সিলভার ও অন্যান্য মালামাল স্থানান্তরের জন্যে তখন অনেক উটের প্রয়োজন হয়।

পাকিস্তানের খানজাদা ও ভারতের খাজা মোহাম্মদ বক্স উটের ব্যবসায়ী হিসেবে ১৮ শতকে অস্ট্রেলিয়ায় খ্যাতি অর্জন করেন। তারা ২ জনই তৎকালীন পূর্ব বাংলার চট্টগ্রাম বন্দরকেন্দ্রিক 'এস এস বেঙ্গল' নামের একটি জাহাজ ভাড়া করে নিয়মিতভাবে অস্ট্রেলিয়ায় উট নিয়ে আসতেন। ওই জাহাজের সব নাবিক ও কর্মচারী ছিলেন পূর্ব বঙ্গের বাঙালি।

ব্যবসায়ী খানজাদা ও খাজা মোহাম্মদ বক্স বাঙালিদের সমুদ্র বন্দর থেকে শহরে পালিয়ে যেতে সাহায্য করতেন। ধারণা করা হয়, ওই বাঙালিদেরই কেউ একজন 'কাসাসুল আম্বিয়া' নামের বাংলা পুঁথিটি নিয়ে যান সেখানে। তখন অস্ট্রেলিয়া ছিল ব্রিটিশ অধ্যুষিত একটি উপনিবেশ।

২০০৯ সালের জুনে অস্ট্রেলিয়ায় বাংলাদেশি শিক্ষার্থী সামিয়া খাতুন তার গবেষণার কাজে ব্রোকেনহিল মসজিদে গিয়ে পুঁথিটি আবিষ্কার করেন।

স্থানীয় কাউন্সিল থেকে তিনি চাবি নিয়ে যখন প্রায় ১৫০ বছর পুরনো মসজিদে প্রবেশ করেন তখনো জানতেন না সেখানে তার জন্য অপেক্ষা করছে 'ঐতিহাসিক হীরকখণ্ড।'

সামিয়া খাতুন এসবিএস রেডিওকে সাক্ষাৎকারে জানিয়েছেন, মসজিদে প্রবেশ করে তিনি একটি টিনের বাক্স দেখতে পান। বছরের পর বছর ওই বাক্সটি অব্যবহৃত থাকায় মরু অঞ্চলের ধুলো বালিতে আচ্ছন্ন ছিল। সামিয়া খাতুন বাক্সটি খুলে দেখতে পান কাপড় দিয়ে মোড়ানো একটি বই। তিনি নিশ্চিত ছিলেন যে ওটা কুরআন শরিফ। কাপড় খুলে রীতিমত চমকে ওঠেন তিনি। গ্রন্থের ওপরে বাংলা অক্ষরে লেখা 'কাসাসুল আম্বিয়া।'

সাক্ষাৎকারে তিনি আবেগময় কণ্ঠে বলেন, 'বাংলা অক্ষরে লেখাটি দেখে আমি "মা" বলে চিৎকার করে উঠি। প্রায় জ্ঞানশূন্য হয়ে যাই। প্রত্যন্ত মরু অঞ্চলের পরিত্যক্ত একটি মসজিদে বাংলা বই আবিষ্কার আমার জীবনের অবিস্মরণীয় ঘটনা।'

ওই দালিলিক গ্রন্থের সূত্রই দেখিয়ে দেয় ইতিহাসের এক দীর্ঘ আলোকিত পথ। খুঁজে পাওয়া যায় প্রশান্ত মহাসাগর পাড়ে বঙ্গোপসাগর পাড়ের বাঙালিদের পদচিহ্ন।

প্রায় ১৫০ বছর আগে এক বাঙালি ব্রোকেনহিল এলাকায় একটি সার্কাস দলের সদস্য হিসেবে খ্যাতি অর্জন করেছিলেন বলে জানা যায়। ব্রোকেনহিলের মসজিদে বাংলা পুঁথি পাওয়ায় ধারণা করা হয় ওই অঞ্চলে তখন অনেক বাঙালির বসতি ছিল। কারণ পুঁথি সাধারণত সম্মিলিতভাবে পাঠ করা হয়ে থাকে। ওই এলাকার অনেক বাঙালি আদিবাসীদের বিয়ে করে মূলস্রোতে মিশেও গিয়েছেন।

অস্ট্রেলিয়ার জাতীয় ইতিহাস সংরক্ষণ কেন্দ্র ও পুলিশ বিভাগের রেকর্ড থেকে জানা যায়, অস্ট্রেলিয়ায় বাঙালিদের শুরুর ইতিহাস।

১৮৮২ সালে মেলবোর্ন শহরে দরবেশ নামের এক বাঙালি ব্যবসায়ীর নাম সেখানকার সিটি কর্পোরেশনের নথিতে আছে। ১৮৯০ সালে ব্রিটিশ কলোনি পোর্ট হেরটল্যান্ডে আব্দুল আজিজ নামের এক রাঁধুনির কথা জানা যায়।

১৯০৪ থেকে ১৯০৫ সালের মধ্যে প্রায় ৩০ জন বাঙালির কথা জানা যায় যারা পার্থ বন্দর নগরীতে কাপড়ের ব্যবসা করতেন।

আকিদুল ইসলাম: অস্ট্রেলিয়া প্রবাসী লেখক, সাংবাদিক

Comments

The Daily Star  | English

Bangladesh Bank has to provide info that people have right to know: Arafat

Bangladesh Bank will have to provide all information that public has a right to know, State Minister for Information and Broadcasting, Mohammad Ali Arafat, said today

29m ago