খুনিরা প্রশিক্ষিত, টার্গেট ছিলেন কাউন্সিলর

হত্যাকারীদের টার্গেট ছিল পরিস্কার: কুমিল্লা সিটি করপোরেশনের ওয়ার্ড কাউন্সিলর সৈয়দ আহমেদ সোহেলকে গুলি করা এবং ঘটনাস্থলেই তার মৃত্যু নিশ্চিত করা।
সৈয়দ আহমেদ সোহেল ও হরিপদ দাস। ছবি: সংগৃহীত

হত্যাকারীদের টার্গেট ছিল পরিস্কার: কুমিল্লা সিটি করপোরেশনের ওয়ার্ড কাউন্সিলর সৈয়দ আহমেদ সোহেলকে গুলি করা এবং ঘটনাস্থলেই তার মৃত্যু সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া।

তবে সোমবারের হত্যাকাণ্ডের পেছনের কারণ কী তা এখনও জানা যায়নি।

বন্দুকধারীরা কুমিল্লা শহরের পাথুরিয়া পাড়া এলাকায় কাউন্সিলরের কার্যালয়ে হামলা চালায়। সোহেলকে গুলি করার পর আরও ২০ মিনিট তারা সেখানে অবস্থান করে, যাতে কেউ তাকে শিগগির হাসপাতালে না নিতে পারেন। এই তথ্য জানিয়েছেন তার সহযোগী ও নিকটবর্তী দালানের বাসিন্দারা।

আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সদস্যরা জানান, আক্রমণকারীদের কারো মুখে মুখোস এবং কেউ কেউ হেলমেট পরা ছিলেন। তারা কার্যালয়ের ভেতরে ও বাইরে অন্যদের পায়ে গুলি করেন, যা ইঙ্গিত করছে তারা পেশাদার ঘাতক। 

ঘটনাচক্রে কাউন্সিলরের ঘনিষ্ঠ সহযোগী হরিপদ দাসের মৃত্যু হয়েছে বলে মত প্রকাশ করেন তারা।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে জোড়া খুনের ঘটনার তদন্তের সঙ্গে জড়িত একজন পুলিশ কর্মকর্তা বলেন, 'আমরা বিশ্বাস করি এই খুনের পরিকল্পনা অনেক আগেই করা হয়েছে।'

আক্রমণে আরও ৫ জন গুলিবিদ্ধ হন, তারা হচ্ছেন রাসেল (২৯), আওয়াল হোসেন রিজু (২৩), মাজেদুল হক বাদল (৩৯), জুয়েল (৪০) ও সোহেল চৌধুরী (৪৩)। তারা কুমিল্লা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন।

আহতরা সবাই কাউন্সিলরের সহযোগী বলে জানিয়েছেন স্থানীয়রা।

ইতোমধ্যে, ১৭ নং ওয়ার্ডের কাউন্সিলর ও কুমিল্লা সিটি করপোরেশনের প্যানেল মেয়র সোহেলের পরিবারের সদস্যরা এই ঘটনাকে রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড হিসেবে অভিহিত করেছেন।

সোহেলের বড় ভাই সৈয়দ মোহাম্মদ আলমগীর দ্য ডেইলি স্টারকে গতকাল বলেন, 'রাজনৈতিক প্রতিপক্ষরা এই হত্যাকাণ্ডের পেছনে দায়ী। আমরা ন্যায়বিচার চাই।'

কাউন্সিলরের স্ত্রী শাহনাজ আখতার বলেন, 'আমার স্বামী শুধুমাত্র এলাকাতেই জনপ্রিয় ছিলেন না, তিনি পুরো কুমিল্লা শহরে জনপ্রিয় ছিলেন। তারা তাকে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করেছে।'

কাউন্সিলর সোহেল একইসঙ্গে ১৭ নং ওয়ার্ডের আওয়ামী লীগ সভাপতি হিসেবেও দায়িত্ব পালন করছিলেন। তাকে ৯ বার গুলি করা হয়। ৮টি গুলি তার দেহ ভেদ করে যায়। হরিপদ ছিলেন ১৭ নং ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সদস্য।

কুমিল্লা মেডিকেল কলেজ মর্গে ময়নাতদন্ত শেষ হওয়ার পর একজন সূত্র জানান, 'হত্যাকারীরা ঘটনাস্থলেই মৃত্যু নিশ্চিত করতে চেয়েছিলেন। আমরা এত বেশি গুলির আঘাতসহ মরদেহ খুব কমই পাই।'

সোমবার বিকেল ৪টায় এই নারকীয় জোড়া হত্যাকাণ্ড ঘটার পর এ বিষয়ে একটি মামলা করা হয়েছে। বুধবার মধ্যরাত সোয়া ১২টার দিকে ১১ জনের নাম উল্লেখ করে সোহেলের ছোট ভাই সৈয়দ মো. রুমন মামলাটি করেন।  

বিষয়টি নিশ্চিত করে কুমিল্লা কোতোয়ালি মডেল থানার পরিদর্শক (তদন্ত) কমল কৃষ্ণ ধর বলেন, 'রাত সোয়া ১২টার দিকে মামলাটি রেকর্ড করা হয়। মামলায় শাহ আলমকে প্রধান আসামি করে জেল সোহেল, সাব্বির, রকি, শাহ আলমের ভাতিজা সুমনসহ মোট ১১ জনের নাম উল্লেখ করা হয়েছে। এ ছাড়াও অজ্ঞাতপরিচয় আসামি করা হয়েছে ১০ থেকে ১২ জনকে।'

পরবর্তীতে হত্যা মামলার অন্যতম আসামি সুমনকে গ্রেপ্তার করেছে র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র‌্যাব)। আজ বুধবার কুমিল্লা মেডিকেল কলেজ থেকে তাকে গ্রেপ্তার করা হয় বলে দ্য ডেইলি স্টারকে নিশ্চিত করেন র‌্যাবের লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইংয়ের অ্যাসিট্যান্ট ডিরেক্টর আ ন ম ইমরান খান।

এছাড়াও পুলিশ ঘটনাস্থল থেকে ৫০০ মিটার দূরে সংরাইশ এলাকা থেকে হত্যাকারীদের ফেলে যাওয়া ৩টি দেশীয় অস্ত্র, ১১ রাউন্ড গুলি, হাত বোমা, ২টি কালো ট্র‍্যাকস্যুট উদ্ধার করেছে।

কোতোয়ালি মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আনোয়ারুল আজীম জানান, অপরাধীরা সম্ভবত এগুলো ফেলে গেছে।

খুনিদের চিহ্নিত করার জন্য পুলিশ একাধিক সিসিটিভি ক্যামেরা থেকে ফুটেজ নিয়েছে। এর মধ্যে ৩টি ক্যামেরা কার্যালয়ের সামনে বসানো ছিল।

সোহেলের ব্যক্তিগত সহকারী মাজেদুল হক বাদলের পায়ে গুলি লেগেছিল। তিনি বলেন, 'ঘাতকরা দ্রুত অফিসে ঢুকে পড়ে। তারা চিৎকার করে নিজেদেরকে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সদস্য হিসেবে দাবি করতে থাকে। সে সময় কাউন্সিলরের সঙ্গে ৬-৭ জন ব্যক্তি বসেছিলেন।'

তিনি যোগ করেন, ঘাতকদের ছোঁড়া এলোপাতারি গুলিতে প্রথমেই গুলিবিদ্ধ হন হরিপদ। তিনি আরও জানান, যদিও ঘাতকরা মাস্ক পরে ছিলেন, তবুও তাদের কন্ঠস্বর শুনে ও শারীরিক গঠন দেখে তিনি ২ জনের পরিচয় সম্পর্কে নিশ্চিত হন।

বাদল শাহ আলম ও সোহেল ওরফে 'জেল সোহেলের'নাম বলেন, যারা উভয়ই স্থানীয় অপরাধী। শাহ আলমের সঙ্গে স্থানীয় কিছু বিষয় নিয়ে কাউন্সিলরের পূর্ব শত্রুতা ছিল বলে দাবি করেন বাদল।

তবে এই পত্রিকা তার দাবির স্বপক্ষে কোনো প্রমাণ হাতে পায়নি।

১৬ নং ওয়ার্ডের কাউন্সিলর জাহাঙ্গীর হোসেন বাবুল অভিযোগ করেন, মাদক ব্যবসায়ী হিসেবে পরিচিত শাহ আলমের সঙ্গে কাউন্সিলর সোহেলের বিবাদ ছিল, কারণ তিনি আলমের অবৈধ কার্যক্রমের বিরোধিতা করতেন। 

তিনি দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, ১ সপ্তাহ আগে পাথুরিয়া পাড়া এলাকার স্থানীয়রা শাহ আলমের একজন বন্ধুকে আটক করার চেষ্টা করলে তিনি তাদের ওপর গুলি করেন। অভিযোগ অনুযায়ী, তার বন্ধুটি একজন নারীকে উত্যক্ত করছিলেন।

সোহেল পুলিশকে এ ঘটনা সম্পর্কে অবহিত করেন। নিহত কাউন্সিলরের বন্ধু বাবুল দাবি করেন, এতে শাহ আলম তার ওপর ক্ষিপ্ত হন।

তিনি আরও অভিযোগ করেন, গোলাগুলির পর পুলিশের সদস্যরা ঘটনাস্থলে উপস্থিত হতে প্রায় ১ ঘণ্টা সময় নেন।

কুমিল্লার পুলিশ সুপার ফারুক আহমেদ জানান, হত্যাকাণ্ডের পেছনে অন্যান্য কারণ অনুসন্ধানের পাশাপাশি পুলিশ আলম এবং 'জেল সোহেলের' সম্ভাব্য সংশ্লিষ্টতাও খতিয়ে দেখছে।

ঘটনাস্থলে দেরীতে পৌঁছানোর ব্যাপারে প্রশ্ন করা হলে ফারুক জানান, পুলিশ ঘটনা সম্পর্কে জানার পরই সেখানে যায়।

গতকাল হাসপাতাল থেকে কাউন্সিলর সোহেলের মরদেহ তার বাড়ি ও কাউন্সিলরের কার্যালয়ের সামনে নেওয়া হলে শত শত মানুষ সেখানে জমায়েত হন।

কান্নাজড়িত কণ্ঠে তারা হত্যাকাণ্ডের জন্য ন্যায়বিচার দাবি করেন।

কাউন্সিলরের অফিসের কাছে দাঁড়িয়ে মোমেনা আখতার চিৎকার করে বলছিলেন, 'আমরা ন্যায়বিচার চাই।'

তিনি বলেন, 'কাউন্সিলর আমাদের অভিভাবকের মতো ছিলেন। তিনি সব সময় আমাদের মতো গরীব মানুষদের সাহায্য করতেন।'

স্থানীয় মসজিদে জানাজা পড়ানোর পর সোহেলকে তার পারিবারিক কবরস্থানে দাফন করা হয়। হরিপদকে টিক্কারচর এলাকায় দাহ করা হয়।

জানাজার আগে, সোহেলের একমাত্র সন্তান সৈয়দ মোহাম্মদ নাদিম বলেন, 'আমার চাওয়া একটাই এবং তা হচ্ছে আমার পিতার হত্যাকারীদের ফাঁসি চাই'

সোহেলকে যেখানে হত্যা করা হয়, তা বিবির বাজার স্থল বন্দর থেকে ৪ থেকে ৫ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত।

কিছুদিন আগে দুর্গাপূজার সময় কুমিল্লায় সাম্প্রদায়িক সহিংসতার পরে এলাকায় অসম্ভব জনপ্রিয় মানুষ সোহেলের নাম উঠে আসে।

যার বিরুদ্ধে ১৩ অক্টোবর ভোরে নানুয়া দিঘীর পার পূজামণ্ডপে পবিত্র কোরআন রেখে হামলার উস্কানি দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে, সেই ইকবাল হোসেন পাথুরিয়া পাড়ায় সোহেলের একটি বাড়ির ভাড়াটিয়া ছিলেন।

অনুবাদ করেছেন মোহাম্মদ ইশতিয়াক খান

Comments

The Daily Star  | English
Workers rights vs corporate profits

How some actors gambled with workers’ rights to save corporate profits

The CSDDD is the result of years of campaigning by a large coalition of civil society groups who managed to shift the narrative around corporate abuse.

10h ago