মৈত্রী দিবস: বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের ৫০ বছর

বাংলাদেশ ও ভারত দক্ষিণ এশিয়ার দুটি প্রতিবেশী রাষ্ট্র হলেও এই ২ দেশের মধ্যে ঐতিহাসিকভাবে অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বিদ্যমান।

বাংলাদেশ ও ভারত দক্ষিণ এশিয়ার দুটি প্রতিবেশী রাষ্ট্র হলেও এই ২ দেশের মধ্যে ঐতিহাসিকভাবে অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বিদ্যমান।

১৯৪৭ সালে ভারত-পাকিস্তান বিভক্ত হয়ে যাওয়ার পরে বাংলাদেশ পূর্ব পাকিস্তান হিসেবে পাকিস্তান প্রজাতন্ত্রের অংশ ছিল। পশ্চিম পাকিস্তানি সামরিক শাসনের নিষ্পেষণে পূর্ব বাংলার মানুষ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে যখন পশ্চিম পাকিস্তানের বিরুদ্ধে স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে তখন ভারতের প্রয়াত প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধি ও তার সরকার যে সহায়তা করেছিল তা বাংলার মানুষ কখনো ভুলবে না।

প্রায় ১ কোটি পূর্ব পাকিস্তানের শরণার্থীকে আশ্রয় দেওয়া এবং সামরিক সহায়তা প্রদানসহ আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে মিসেস গান্ধী যে ভূমিকা রেখেছিলেন তা বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনকে ত্বরান্বিত করেছিল। বঙ্গবন্ধুর অনুরোধে স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশ থেকে খুব অল্প সময়ের মধ্যে ভারতীয় মিত্রবাহিনীকে ফেরত নিয়ে যাওয়ার মধ্য দিয়ে মিসেস গান্ধী যে উদারতা দেখিয়েছিলেন, তা নব্য স্বাধীনতাপ্রাপ্ত দেশের ক্ষেত্রে খুব কমই দেখা যায়।

স্বাধীনতার সময় থেকে ২টি দেশ যে ঐক্যের ভিত্তিতে নিজেদের সম্পর্ক এগিয়ে নিয়ে চলেছে তা আজ পর্যন্ত বিদ্যমান রয়েছে। তবে মাঝে কিছুটা সময় বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে খানিকটা নেতিবাচক সম্পর্ক বিরাজমান থাকলেও গত ১২ বছরে ২টি দেশের সম্পর্ক বিশেষ উচ্চতায় পৌঁছেছে। ছিটমহলসহ অনেক গুরুত্বপূর্ণ সমস্যার সমাধান এসেছে গত ১২ বছরে। বাংলাদেশ বর্তমানে ভারতের ৫টি সর্ববৃহৎ রপ্তানিকৃত দেশের তালিকায় রয়েছে। এ ছাড়াও বিভিন্ন প্রকল্পে ভারতের সহায়তা প্রদানের মাধ্যমে ২ দেশের সম্পর্ক আরও শক্তিশালী হয়েছে।

বার্ষিকভিত্তিতে বাংলাদেশে ভারতের রপ্তানি ৪৬ শতাংশ বেড়েছে। ২০২১ সালের জানুয়ারি থেকে মার্চের হিসাব অনুযায়ী, বাংলাদেশে ভারতের মোট রপ্তানির পরিমাণ ছিল ৩ দশমিক ১৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। অর্থাৎ এই সময়কালে বহির্বিশ্বে ভারতীয় রপ্তানির দেশের তালিকায় বাংলাদেশের অবস্থান ছিল চতুর্থ। বাংলাদেশের আগে ছিল যুক্তরাষ্ট্র (১৫ দশমিক ৪০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার), চীন (৫ দশমিক ৯২ বিলিয়ন মার্কিন ডলার) এবং সংযুক্ত আরব আমিরাত (৫ দশমিক ৩৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলার)। এই পরিসংখ্যান থেকে যে বিষয়টি পরিষ্কার তা হলো, ২ দেশের বাণিজ্যের ক্ষেত্রে ব্যাপক উন্নতি সাধিত হয়েছে। তবে ভারত থেকে বাংলাদেশে রপ্তানি বাড়লেও বাংলাদেশ থেকে ভারতে রপ্তানির ক্ষেত্রে এখনও কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য অর্জিত হয়নি।

২০১১ সাল থেকে ২৫টি পণ্য ব্যতীত বাংলাদেশের পণ্য ভারতীয় বাজারে শুল্কমুক্ত বাণিজ্য সুবিধা দেওয়ার ভারত সরকারের সিদ্ধান্তের ফলে ২ দেশের বাণিজ্য ঘাটতি কিছুটা হলেও কমেছে। তারপরেও সম্পর্ক উন্নয়নে ২ দেশের সরকার প্রধানের উচিত এই বাণিজ্য ঘাটতি কমিয়ে নিয়ে আসার জন্য ঐক্যমতে পৌঁছানো।

সাংস্কৃতিক দিক থেকে ২ দেশের মধ্যে অত্যন্ত বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক বিদ্যমান।  বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক দল যেমন ভারতে তাদের কার্যক্রম প্রদর্শন করে, তেমনি ভারতীয় সাংস্কৃতিক দলও বাংলাদেশে তাদের কার্যক্রম উপস্থাপন করে। এর মাধ্যমে ২ দেশের সাংস্কৃতিক অঙ্গনের একটি শক্তিশালী সেতুবন্ধন রচিত হয়েছে।

এখানে বলে রাখা ভালো, যে বাংলাদেশ ও ভারত উপমহাদেশের ২টি রাষ্ট্র হওয়ায় ২ দেশের সাংস্কৃতিক জগতের মধ্যে অনেক মিল রয়েছে। এ কারণে আবহমান কাল থেকে উভয় দেশ সাংস্কৃতিক দিক থেকে অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ ভাবে সম্পর্কিত।

২ দেশের সম্পর্ককে আরও এগিয়ে নেওয়ার জন্য ভারত সরকার বিভিন্ন ক্ষেত্রে বাংলাদেশের শিক্ষার্থীদের জন্য যে বৃত্তি চালু করেছে তা ২ দেশের সম্পর্কের ক্ষেত্রে ইতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। ইন্ডিয়ান কাউন্সিল ফর কালচারাল রিলেশনসের আওতায় বৃত্তির সঙ্গে সঙ্গে আরও বেশ কয়েকটি খাতে ভারত সরকার বৃত্তি চালু করেছে বাংলাদেশি শিক্ষার্থীদের জন্য। এর মধ্যে মৈত্রী বৃত্তি, মুক্তিযোদ্ধাদের সন্তানদের জন্য বৃত্তি এবং বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী উপলক্ষে বঙ্গবন্ধু চেয়ার বৃত্তি গুরুত্বপূর্ণ।

বাংলাদেশ থেকে বিপুল সংখ্যক মানুষ প্রতিবছর চিকিৎসার জন্য ভারতে যাওয়া ২ দেশের সম্পর্কের ক্ষেত্রে একটি ইতিবাচক বার্তা দেয়।

এ ছাড়াও আঞ্চলিক আন্তঃদেশীয় সড়ক যোগাযোগ চালু করার বিষয়টি উভয় দেশের সরকার গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করছে। এই যোগাযোগ শুরু হলে ২ দেশের ব্যবসা-বাণিজ্যে সম্প্রসারণে ব্যাপক সম্ভাবনা তৈরি হবে। এটি চালু হলে শুধুমাত্র ভারত নয়, আমাদের আশেপাশের দেশগুলোর সঙ্গেও বাংলাদেশের বাণিজ্যের নতুন দ্বার উন্মোচিত হবে বলে ধারণা করা হয়। অনেকে আন্তঃদেশীয় সড়ক যোগাযোগকে নেতিবাচকভাবে দেখার চেষ্টা করেন। তাদের যুক্তি, বাংলাদেশ তাহলে ভারতের করিডর হয়ে যাবে। এই ধরণের যুক্তি সম্পূর্ণ উদ্দেশ্য প্রণোদিত। কারণ, বিশ্বায়নের যুগে এই ধরনের প্রচেষ্টা যদি সার্থক হয় তাহলে তা উভয় দেশের জন্যই সুফল বয়ে আনবে। এই যোগাযোগের সঙ্গে শুল্কমুক্ত বাণিজ্য এবং ভিসামুক্ত ভ্রমণ সুবিধা প্রদান করা হলে উভয় দেশ যেমন লাভবান হবে, একই সঙ্গে ২ দেশের জনগণের মধ্যে সম্পর্ক আরও শক্তিশালী হবে। যেমনটি ইউরোপে দেখা যায়, সেনজেন ভিসার আওতায় ইউরোপের অনেক দেশে প্রবেশ করা যায়।

এখানে অস্বীকার করার উপায় নেই যে, বাংলাদেশ এবং ভারত সরকার স্বাধীনতা-উত্তর কাল থেকে এখন পর্যন্ত বেশ কিছু বিষয়ে ঐকমত্যে পৌঁছেছে। এর মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ ছিল পদ্মার পানি বণ্টন চুক্তি, ছিটমহল সমস্যার সমাধান এবং বাণিজ্য ঘাটতি কমানোর জন্য পণ্যের শুল্কমুক্ত সুবিধা। তবে ২টি দেশের সম্পর্ক অত্যন্ত গভীর হলেও বেশ কয়েকটি বিষয়ে এখন পর্যন্ত ঐক্যমতে পৌঁছানো সম্ভব হয়নি। এর মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে তিস্তার পানি বণ্টন চুক্তি এবং সীমান্ত হত্যা। তিস্তার পানি চুক্তির ব্যাপারে কেন্দ্রীয় সরকারের ইতিবাচক মনোভাব থাকলেও পশ্চিমবঙ্গ সরকারের বিরোধিতার কারণে তা সম্ভব হচ্ছে না মর্মে ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার বিবৃতি দিয়েছে। তবে, আমাদের মনে রাখা উচিত, ২ দেশের সম্পর্ক উন্নত করতে ভারত সরকারের উচিত যেকোনো প্রক্রিয়ায় পশ্চিমবঙ্গ সরকারের মনোভাবের পরিবর্তন ঘটিয়ে এই চুক্তি সম্পন্ন করা। এই চুক্তি হলে শুধুমাত্র ২ দেশের সম্পর্কের ক্ষেত্রে ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে না, তিস্তার পানির অভাবে বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলের জনগণকে যে দুর্ভোগ পোহাতে হয় তা কিছুটা হলেও লাঘব হবে।

সীমান্ত হত্যা শূন্যে নামিয়ে আনার জন্য উচ্চ পর্যায়ে ব্যাপক আলোচনা হলেও সময়ের ব্যবধানে মাঝে মাঝেই এই ধরনের হত্যাকাণ্ড ২টি দেশের সম্পর্ককে নেতিবাচকভাবে প্রভাবিত করে। বিশেষ করে বাংলাদেশের জনগণের মধ্যে ভারত সম্পর্কে এক ধরনের নেতিবাচক প্রভাব দেখা দিতে পারে বিধায় এই হত্যাকাণ্ড কমানো উচিত।

বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক এতটা মজবুত ভিত্তির ওপরে দাঁড়িয়ে আছে যে, পৃথিবীর অনেক দেশ এই সম্পর্ককে ঈর্ষা করতে শুরু করেছে। বিভিন্ন মোড়লরা চেষ্টা করছেন এই সম্পর্কে ফাটল ধরানোর জন্য। উভয় দেশের সরকার প্রধানদের উচিত এই বিষয়টিতে সচেতন থাকা। আমাদের মনে রাখতে হবে, বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের চেয়েও জনগণের সঙ্গে জনগণের সম্পর্কটা অনেক মজবুত ভিত্তির ওপরে দাঁড়িয়ে আছে। সুতরাং, যে সব বিষয়ে এখনও ঐক্যমতে পৌঁছানো সম্ভব হয়নি সে বিষয়গুলোতে ঐক্যমতে পৌঁছানোর মাধ্যমে এই সম্পর্ককে সামনে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার প্রত্যয়ই হতে পারে এবারের মৈত্রী দিবসের মূল প্রতিপাদ্য।

ড. প্রণব কুমার পান্ডে: অধ্যাপক, লোক প্রশাসন বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়

(দ্য ডেইলি স্টারের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির আইনগত, মতামত বা বিশ্লেষণের দায়ভার সম্পূর্ণরূপে লেখকের, দ্য ডেইলি স্টার কর্তৃপক্ষের নয়। লেখকের নিজস্ব মতামতের কোনো প্রকার দায়ভার দ্য ডেইলি স্টার নেবে না।)

Comments

The Daily Star  | English

Journalists who legitimised fascism will not be spared: Nahid

Information Adviser Nahid Islam today said journalists and writers who tried to give legitimacy to fascism and instigated mass killing through their writings will be brought to book

1h ago