বশীর আলহেলাল: স্মরণের সরণিতে

বশীর আলহেলালের জন্ম অবিভক্ত ভারতে। তার পিতৃপুরুষের ভিটে ভারতের পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিদাবাদ জেলার কান্দি মহকুমার অন্তর্গত তালিবপুর গ্রামে। পল্লিগীতির সুখ্যাত শিল্পী আবদুল আলীম ও ভাষাশহিদ আবুল বরকত এই গ্রামেরই সন্তান।

বশীর আলহেলালের জন্ম অবিভক্ত ভারতে। তার পিতৃপুরুষের ভিটে ভারতের পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিদাবাদ জেলার কান্দি মহকুমার অন্তর্গত তালিবপুর গ্রামে। পল্লিগীতির সুখ্যাত শিল্পী আবদুল আলীম ও ভাষাশহিদ আবুল বরকত এই গ্রামেরই সন্তান।

আমাদের দেশে সাহিত্যকর্মকে মোটাদাগে সৃজনশীল ও মননশীল দুই ভাগে ভাগ করা হয়। দুই ধারায়ই বশীর আলহেলালের অবদান স্বীকার্য। গল্পকার ও ঔপন্যাসিক বশীর আলহেলাল সমালোচকের সমাদর লাভ করেছেন; গবেষক-ইতিহাসবিদ বশীর আলহেলালের যথার্থ মূল্যায়ন এখনো হয়নি।

ভাষা-আন্দোলন বাংলাদেশের ইতিহাসের এক বড় বাঁকবদল। বাঙালি জাতীয়তাবাদী সংগ্রামে এই আন্দোলন বিরাট ভূমিকা পালন করেছে। বশীর আলহেলাল ভাষা-আন্দোলনের ইতিহাস লিখেছেন; 'বাঙালির জাতিসত্তা ও মননশীলতার প্রতীক' বাংলা একাডেমির ইতিহাসও লিপিবদ্ধ করে গেছেন, যেখানে তিনি দীর্ঘ দুই যুগ কর্মরত ছিলেন। বাংলা একাডেমি, বস্তুত, রাষ্ট্রভাষা-আন্দোলনেরই ফসল। বশীর আলহেলাল দুয়েরই ইতিহাস প্রণয়ন করেছেন। তার 'বাংলা একাডেমীর ইতিহাস' ও 'ভাষা-আন্দোলনের ইতিহাস' গ্রন্থ দুটিকে 'যুগলগ্রন্থ' হিসেবে গণ্য করা যেতে পারে।

বাঙালির ভাষার সংগ্রাম সুদীর্ঘকালের। ১৯৫২ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারি প্রতিবাদ, বিক্ষোভ ও আত্মাহুতির মধ্য দিয়ে তা চূড়ান্ত পরিণতি লাভ করে। রাষ্ট্রভাষার দাবিতে সেদিন বাঙালি তার স্বভাষাপ্রেমের রক্তছাপ রেখেছিল। বদরুদ্দীন উমর, আবদুল হক, আহমদ রফিক, আবদুল মতিন, রফিকুল ইসলাম প্রমুখ অনেকেই ভাষা-আন্দোলনের ইতিহাস লিখেছেন। শেখ মুজিবুর রহমানের 'অসমাপ্ত আত্মজীবনী' ও 'কারাগারের রোজনামচা' এবং তাজউদ্দীন আহমদের ডায়েরিগুলো পাঠ করলেও এ বিষয়ে অনেক কিছু জানা যায়। আছে অলি আহাদের বইটিও। বশীর আলহেলালের 'ভাষা-আন্দোলনের ইতিহাস' একটি আকরগ্রন্থ। কোনো সন্দেহ নেই যে তার বইটি সংশ্লিষ্ট বিষয়ের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য গ্রন্থগুলোর অন্যতম।

বশীর আলহেলালের দুই অগ্রজ নেয়ামাল ওয়াকিল ও নেয়ামাল বাসির দুজনই ভাষা-আন্দোলনের প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণকারী। অগ্রজদের অভিজ্ঞতা অনুজকে প্রেরণা জুগিয়েছিল নিশ্চয়ই। 'ভাষা-আন্দোলনের ইতিহাস' গ্রন্থের ভূমিকায় বশীর আলহেলাল তার সর্বাগ্রজ নেয়ামাল ওয়াকিলের কাছে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছেন তার ব্যক্তিগত সংগ্রহের পত্রিকা, পুস্তিকা, প্রচারপত্র, দলিল প্রভৃতি অকাতরে ব্যবহার করার জন্য। কীটদষ্ট হয়ে নষ্ট হওয়ার ফলে বেশকিছু উপকরণ তিনি কাজে লাগাতে পারেননি। বশীর আলহেলালের বইটি দশটি অধ্যায়ে বিভক্ত। তার প্রণীত ইতিহাস তথ্যবহুল ও নিরাসক্ত। প্রচুর তথ্য-উপাত্তের ভিত্তিতে রচিত তার গ্রন্থে ব্যক্তিবিশেষের মূল্যাবধারণে কোনো অতিরঞ্জন নেই। কাউকে অতি বড় করে দেখানো, কাউকে অন্যায্যভাবে খাটো করা তার মধ্যে পরিলক্ষিত হয় না। বশীর আলহেলাল ছিলেন সৎ, সত্যসন্ধ গবেষক। ঢাকার বাইরের, মফস্বলের ভাষা-আন্দোলনের ইতিহাস তার বইয়ে স্থান পায়নি বলে তিনি এর অসম্পূর্ণতার বিষয়ে সচেতন ছিলেন এবং আশা করেছেন ভাবীকালের কোনো গবেষক এ ক্ষেত্রে উদ্যোগী হবেন।

বশীর আলহেলালের 'ভাষা-আন্দোলনের ইতিহাস' প্রথম প্রকাশিত হয় ১৯৮৫ সালে বাংলা একাডেমি থেকে। জীবদ্দশায় তিনি বইটির সংশোধিত, পরিবর্ধিত সংস্করণ প্রকাশ করে গেছেন, আগামী প্রকাশনী থেকে ২০০৩ সালে তা বের হয়।

বশীর আলহেলাল ছিলেন সাহিত্যের ছাত্র। তার জীবন আবর্তিত হয়েছে ভাষা ও সাহিত্যকে কেন্দ্র করেই। একজন সৃষ্টিশীল সাহিত্যিক হিসেবে তিনি যেমন স্বীকৃতি পেয়েছিলেন, তেমনি একজন প্রাবন্ধিক-সমালোচক হিসেবেও তিনি ছিলেন সফল। গবেষক হিসেবে তার পরিশ্রম, নিষ্ঠা, অনুসন্ধিৎসা শ্রদ্ধেয় ও অনুসরণীয়। বাংলা ভাষার একজন সাহিত্যিক হিসেবে এই ভাষাটিকেও বড় ভালোবাসতেন তিনি। বাংলা ভাষার বানান, উচ্চারণ, ভাষিক প্রয়োগ-অপপ্রয়োগ, ব্যাকরণের নানা খুঁটিনাটি বিষয়ে তিনি ভাবতেন। এ বিষয়ে একেবারে কম লেখেননি তিনি। 'আদর্শ বাংলা বানান: নিয়ম ও শব্দকোষ', 'বাংলা ভাষার নানান বিবেচনা', 'বাংলা উচ্চারণ' বইগুলো তার ভাষাভাবনা ও ভাষাসংবেদনার স্মারক হয়ে থাকবে। 'কিশোর বাংলা উচ্চারণ মঞ্জরি' বইটি কেবল কিশোর-কিশোরীদেরই জন্যে রচিত হলেও বয়স্ক পাঠক-পাঠিকাদেরও পাঠ্য হতে পারে এ গ্রন্থ।

বাংলা ভাষা, বাংলা সাহিত্য, ভাষা-আন্দোলন, বাংলা একাডেমি বশীর আলহেলালের জীবনচর্যার অংশ ছিল। এতেই বোঝা যায় মানুষটির চারিত্র। এই মানুষটির সঙ্গে আমা-হেন নামগোত্রহীনের সাক্ষাৎ হয়েছিল পনেরো বছর আগে। তার মোহাম্মদপুরের বাসায় দুবার গিয়েছিলাম কৈশোর-উত্তীর্ণ সদ্য ঢাকা শহরে আগত আমি। তারপর জীবনসংগ্রামে ব্যস্ত হয়ে পড়েছিলাম। তবে মনে-মনে তাকে আমি অনুভব করতাম। তার স্নেহের স্পর্শ ও সৌজন্যের সৌরভ এখনো গায়ে মেখে আছে। 'ভাষা-আন্দোলনের ইতিহাস'সহ তার অনেক বইই তিনি আমাকে স্বাক্ষরসমেত উপহার দিয়েছিলেন। ২০২১ সালের ৩১শে আগস্ট বশীর আলহেলাল আমাদের ছেড়ে যান। কাল তার সাতাশিতম জন্মদিনে বিনম্র শ্রদ্ধায় স্মরণ করি তাকে। একইসঙ্গে একটি দাবি করি যে বশীর আলহেলালের জীবনী ও রচনাবলি তার দীর্ঘদিনের কর্মস্থল বাংলা একাডেমি থেকে প্রকাশিত হোক; তাহলেই তার প্রতি আমাদের প্রকৃত শ্রদ্ধা নিবেদিত হবে।

এহসানুল হাবিব: গবেষক

Comments

The Daily Star  | English
digital security act

Press freedom index: Bangladesh falls 2 spots, only Afghanistan worse in South Asia

The country was ranked 165th among 180 nations, placing it only above Afghanistan among South Asian countries

1h ago