মতামত

টিসিবির ট্রাকের পেছনে দৌড় আর অর্থনৈতিক তথ্যের বৈপরীত্য

ন্যায্যমূল্যে দ্রব্য বিক্রির গাড়ির পেছনে মানুষের দীর্ঘ লাইন, কিংবা তা ধরার জন্য প্রাণপণ দৌড় দেখে কে বলবে, এ দেশে মানুষের মাথাপিছু আয় আড়াই হাজার ডলার ছাড়িয়ে গেছে। দুই সপ্তাহ আগেই সরকার ঘোষণা করলো দেশের বার্ষিক মাথাপিছু আয় এখন ২ হাজার ৫৯১ মার্কিন ডলার। আর দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির ধকলেই খোলস ছেড়ে বেরিয়ে পড়লো মানুষের আয়ের আসল চিত্র। যদি সত্যিই আয় বেড়ে থাকে তাহলে মানুষ কেন দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির চাপ নিতে পারছে না? নাকি নিমিষেই আয় কমে গিয়ে আমরা দরিদ্র হয়ে গেলাম?
রাজধানীর সচিবালয় এলাকায় টিসিবির ট্রাক থেকে নিত্যপণ্য কিনতে মানুষের হুড়োহুড়ি। ছবি: এমরান হোসেন/স্টার ফাইল ছবি

ন্যায্যমূল্যে দ্রব্য বিক্রির গাড়ির পেছনে মানুষের দীর্ঘ লাইন, কিংবা তা ধরার জন্য প্রাণপণ দৌড় দেখে কে বলবে, এ দেশে মানুষের মাথাপিছু আয় আড়াই হাজার ডলার ছাড়িয়ে গেছে। দুই সপ্তাহ আগেই সরকার ঘোষণা করলো দেশের বার্ষিক মাথাপিছু আয় এখন ২ হাজার ৫৯১ মার্কিন ডলার। আর দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির ধকলেই খোলস ছেড়ে বেরিয়ে পড়লো মানুষের আয়ের আসল চিত্র। যদি সত্যিই আয় বেড়ে থাকে তাহলে মানুষ কেন দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির চাপ নিতে পারছে না? নাকি নিমিষেই আয় কমে গিয়ে আমরা দরিদ্র হয়ে গেলাম?

মানছি যে, করোনা পরিস্থিতির কারণে সারাবিশ্বেই মানুষ কিছুটা চাপে পড়েছে, দ্রব্যমূল্যও বেড়েছে। তবে যে কয়েক মাস আগেই ঘোষণা এসেছিল আমরা খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ, সেই তথ্য এখন কি পরিবর্তন হয়ে গেল? নইলে বিশ্ববাজারে খাদ্যের দাম বেড়ে যাওয়ায় আমরা এতটা প্রভাবিত হলাম কেন? সমস্যা আসলে কোথায়?

সমস্যা হলো আমরা প্রচারমুখী ও গড়ভিত্তিক সংখ্যাতত্ত্ব দিয়েই অর্থনীতিকে বিচার করছি। মানুষের আয় ব্যতিরেকে বৈষম্য, ভঙ্গুরতা কিংবা সম্মানবোধকে আমরা গুরুত্ব দিচ্ছি না। একসময় অর্থনীতিতে শুধু সংখ্যার বিচারেই দারিদ্র্য মাপা হতো। নির্দিষ্ট সীমা অতিক্রম করে আয় করতে পারলে ধরা হতো তিনি দরিদ্র নন, নিম্ন-মধ্যবিত্ত বা মধ্যবিত্ত। তবে এখন পরিস্থিতি পরিবর্তন হয়েছে। এখন বিশ্বব্যাপী মানুষের আয়ের পাশাপাশি এ বিষয়গুলোকেও বিবেচনায় নেওয়া হয়।

এ ছাড়া, আমাদের আয় বেড়েছে ঠিকই, তবে তা ওপরের শ্রেণীর। ফলে এই গড় আয় দিয়ে জনগণের প্রকৃত অবস্থা পরিমাপ করা যাচ্ছে না। অথচ গড় ভিত্তিক সংখ্যা নিয়েই তৃপ্তির ঢেঁকুর তুলছে সরকার। ফলে অর্থনৈতিক বাস্তবতা ও সংখ্যাগত তথ্যের বৈপরীত্য ধীরে ধীরে স্পষ্ট হয়ে উঠছে। দৈনিক এক হাজার টাকা উপার্জনকারী আর একশ টাকা উপার্জনকারীর যে গড়, তা দিয়ে দিয়ে একশ টাকা উপার্জনকারীর পরিস্থিতি বিবেচনা করা যেমন বোকামি, আমরাও কী ঠিক সেটিই করছি না? ফলে সরকারের গর্বভরা বক্তব্য কিংবা সিঙ্গাপুর হয়ে যাওয়ার স্বপ্নের আলাপনে সাধারণ মানুষ তাচ্ছিল্যের হাসি হাসছে। সেটি সরকার গোণায় ধরুক আর না ধরুক।

অর্থনীতিতে আওয়ামী লীগ সরকারের অবদান কম নয়, অতিদরিদ্র কমানোর ক্ষেত্রেও অবদান রয়েছে, এ কথা সত্যি। তবে সিন্ডিকেট ভেঙে দ্রব্যমূল্যকে মানুষের নাগালের মধ্যে রাখার ক্ষেত্রে তেমন কোনো অবদান কি আমরা দেখেছি? এখনো কৃষক ও ভোক্তা পর্যায়ে দ্রব্যমূল্যের বিস্তর ফারাক। একদিকে কৃষকরা অভিযোগ করছেন, তারা ন্যায্যমূল্য পাচ্ছেন না। অন্যদিকে ভোক্তারা উচ্চ দামের কারণে সংসার চালাতে হিমশিম খেয়ে যাচ্ছেন। ব্যবসায়ীরা বলছেন, দামের এ বিস্তর পার্থক্য সিন্ডিকেটের জন্য নয় বরং রাস্তায় চাঁদাবাজির কারণে। পণ্য পরিবহনে পদে পদে উচ্চ হারে চাঁদা দিতে হয়, সেটি কখনো আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে কখনো সরকারদলীয় লোকজনকে। এভাবে চলতে থাকলে সরকারের লাভের গুড় পিঁপড়ায় খাবে। যত ভালো কিছুই করবে, মানুষ তার সুফল পাবে না।

এই যে 'ভালো পোশাক' পরেও মানুষ টিসিবির গাড়ির লাইনে দাঁড়াচ্ছেন, সেটি কেন? যতক্ষণ তিনি লাইনে দাঁড়িয়ে ছিলেন ততক্ষণ তার মনের অবস্থা কী ছিল? বিষয়টি কি সরকারের কেউ ভেবে দেখেছেন? যখন এই লাইনে দাঁড়িয়ে থাকা লোকটির সামনেই সরকারের কোনো মন্ত্রী বাহাদুর সগর্বে কলার টেনে বলবেন- দেশ সিঙ্গাপুর হয়ে যাচ্ছে, তখন তিনি সেটিকে কীভাবে নেবেন? নাকি প্রতিবাদ করলেই ভাববেন তিনি দেশদ্রোহী ও বিরোধীশক্তি?

মাথাপিছু গড় আয় দিয়ে উন্নয়ন মাপা হলে সরকার ভাববে একরকম আর জনসাধারণ অন্যরকম। তাছাড়া উন্নত দেশ হয়ে যাওয়ার পরও খুব সামান্য কারণেই অনেক মানুষ ন্যায্যমূল্যের পণ্য পেতে মরিয়া হয়ে উঠবে। আর সরকারের যতটুকু অর্জন সবটুকুই প্রশ্নের মুখে পড়বে। তাই বিবেচনা করতে হবে বৈষম্য কমলো কিনা? অতিদরিদ্র কমলো কিনা? বৈশ্বিক বা প্রাকৃতিক কোনো ঝুঁকি তৈরি হলে সেক্ষেত্রে মানুষ টিকে থাকতে পারছে কিনা? এসব করতে হলে মানুষের আয় বাড়ানোর প্রক্রিয়া অব্যাহত রাখতে হবে। কর্মসংস্থান বাড়াতে হবে। অর্থনৈতিক নিরাপত্তা বাড়াতে হবে। আবার একইসঙ্গে কালো অর্থনীতিতে মানুষের খরচ কমাতে হবে। প্রশ্ন উঠতে পারে, কালো অর্থনীতিতে খরচ আবার কী? একজন নাগরিক যখন সরকারি অফিসে তার কোনো কাজ করাতে যান, তখন কত টাকার কাজ কত টাকায় করান সেটি চিন্তা করলেই বুঝা যাবে কালো অর্থনীতিতে আমাদের খরচ কতো। এই যে পণ্য পরিবহণে চাঁদার টাকা দিতে গিয়ে দাম বেড়ে যাচ্ছে, সেটিও কিন্তু কালো অর্থনীতিরই উদাহরণ। যার ঘানি টানতে হচ্ছে সাধারণ মানুষকে। সরকারকেও নয় কি?

আহসান হাবীব: সিনিয়র রিপোর্টার, দ্য ডেইলি স্টার

Comments

The Daily Star  | English

Hamas negotiators begin Gaza truce talks; CIA chief also present in Cairo

Hamas negotiators began intensified talks on Saturday on a possible Gaza truce that would see a halt to the fighting and the return to Israel of some hostages, a Hamas official told Reuters, with the CIA director already present in Cairo for the indirect diplomacy

15m ago