প্রতিবাদ ও প্রতিরোধের প্রতীক থেকে বিশ্ব ঐতিহ্য

বাঁশ-কাঠ-কাগজের তৈরি হাতি, ঘোড়া, বাঘ, সিংহ, প্যাঁচা, ময়ূরসহ নানা ধরনের মুখোশ পরে অংশ নেওয়া হয় নতুন বছরকে বরণ করে নেওয়ার মঙ্গল শোভাযাত্রায়। বাংলা নববর্ষ উদযাপনের অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে দাঁড়িয়েছে এ শোভাযাত্রা।
দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের উদ্যোগে মূলত আয়োজন করা হয়ে থাকে এ মঙ্গল শোভাযাত্রার।
যেভাবে শুরু
সময়টা ১৯৮৫ সাল। বাংলা ১৩৯১ সালের শেষভাগ। যশোর ইনস্টিটিউটের সহায়তায় যশোরের 'চারুপীঠ' নামের একটি আর্ট স্কুল প্রথম শুরু করে এই শোভাযাত্রা। তারা ঠিক করেন লোকজ উপাদান নিয়ে এমনভাবে একটি শোভাযাত্রা করবেন, যা ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সব শ্রেণি-পেশার মানুষই পালন করতে পারবেন।
সেই পরিকল্পনা অনুযায়ী তারা বিভিন্ন রকম মুখোশও বানিয়েছিলেন। তবে দানবাকৃতির বা রাক্ষসের মুখের মুখোশও ছিলো প্রতিবাদ ও প্রতিরোধের প্রতীক হিসেবে।

ঢাকায় মঙ্গল শোভাযাত্রা
১৯৮৯ সালে (বাংলা ১৩৯৬) ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা বিভাগের শিক্ষার্থীদের উদ্যোগে চারুপীঠের আদলে 'আনন্দ শোভাযাত্রা' বের করা হয়। এ শোভাযাত্রায় স্বৈরাচারবিরোধী প্রতীক হিসেবে বিভিন্ন ধরনের মুখোশের ব্যবহার ও লোকজ ঐতিহ্যের উপাদান ব্যবহার দেশব্যাপী আলোড়ন সৃষ্টি করে।
১৯৯১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন উপাচার্য মনিরুজ্জামান মিয়া এই শোভাযাত্রায় অংশ নেন। এরপর থেকে ধীরে ধীরে এটি 'মঙ্গল শোভাযাত্রা' নামে পরিচিত পেতে থাকে। পাশাপাশি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর বাংলা নববর্ষ উদযাপনের নিয়মিত একটি উপাদানে পরিণত হয় 'মঙ্গল শোভাযাত্রা।'
শোভাযাত্রার প্রস্তুতি
২০১৬ সালের ৩০ নভেম্বর মঙ্গল শোভাযাত্রা উইনেস্কো কর্তৃক 'বিশ্ব সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের' স্বীকৃতি পেয়েছে। প্রতিবছর বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের শিক্ষার্থীরা এ শোভাযাত্রার আয়োজন করে থাকেন।
এ উপলক্ষে বেশ কয়েক দিন ধরে একটানা কাজ করেন শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা। দিনরাত এক করে কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে তারা শোভাযাত্রার বিভিন্ন মোটিফ তৈরি করেন।
এ প্রসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের ড্রয়িং অ্যান্ড পেইন্টিং বিভাগের ২০২০-২১ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী ওয়াহিদা বিনতে রোকন দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'এবারের আয়োজনের মূল দায়িত্বে আছেন চারুকলার ২২ ও ২৩তম ব্যাচের শিক্ষার্থীরা। মোট ৪টি সেকশন বা বিভাগে নকশা করা হচ্ছে। সেগুলো হলো- কাঠামো, মুখোশ, আর্ট ক্যাম্প ও পাখি ঘর।'
'কাঠামো বলতে মূলত টেপা পুতুল, মাছ, পাখি ইত্যাদি তৈরির ব্যাপারটা বোঝানো হয়। এ বছর সবচেয়ে বড় করে তৈরি করা হয়েছে পাখি। এ ছাড়া তৈরি করা হয়েছে বিভিন্ন ধরনের মুখোশ। বিশেষ করে পেঁচা ও বাঘের মুখোশ বেশি তৈরি করা হয়।'

এর বাইরে আছে আর্ট ক্যাম্প। এখানে সিনিয়র শিল্পীদের আঁকা ছবি বিক্রির জন্য রাখা হয়। পাশাপাশি মাটির সরায় নকশার কাজ করা হয়। পাখি ঘর বলে পরিচিত ঘরটিতে বিভিন্ন রকম পাখির নকশা করা হয়। এর পাশের দেয়ালগুলোতে শিক্ষকদের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী নকশিকাঁথার নকশা চিত্রিত করা হচ্ছে। সব মিলিয়ে কাজ করতে পেরে আমার ভালো লাগছে বলে জানান, ওয়াহিদা।
প্রস্তুতি পর্বে নতুনদের সঙ্গে অংশ নেন পুরান শিক্ষার্থীরাও। ২০১৫-১৬ সেশনের সিরামিক বিভাগের শিক্ষার্থী আবু ইবনে রাফি প্রচণ্ড ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছেন বর্ষবরণের কাজ নিয়ে।
তিনি দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'সারাদিন এই কাজগুলো নিয়েই আছি। এটা আসলে অন্যরকম একটা ভালো লাগার ব্যাপার। একটা দেয়ালকে নতুনভাবে রাঙানো কিংবা একটা পাখি তৈরি করা; এসব নতুন কিছু সৃষ্টির তৃপ্তি দেয়। আর মঙ্গল শোভাযাত্রা ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সব মানুষের উৎসব। কাজেই এর মধ্য দিয়ে খারাপকে প্রতিহত করা ও ভালোকে প্রতিষ্ঠা করার বার্তাই আমরা দিতে চাই।'
নির্মল কর মঙ্গল করে মলিন মর্ম মুছায়ে
এ বছর মঙ্গল শোভাযাত্রার মূল থিম 'নির্মল কর মঙ্গল করে মলিন মর্ম মুছায়ে।' থিমটি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের একটি গানের লাইন থেকে নেওয়া। এর মাধ্যমে করোনামুক্তির বার্তা দেওয়া হয়েছে। কোভিড পরিস্থিতিতে ১৪২৭ ও ১৪২৮ সালের মঙ্গল শোভাযাত্রা খুব সীমিত পরিসরে আয়োজন করা হয়েছিল।
চারুকলা অনুষদের প্রাচ্যকলা বিভাগের শিক্ষার্থী সুদীপ্ত বসাক অর্ণব ডেইলি স্টারকে বলেন, 'করোনার এই ২ বছরে আমরা জীবন ও বাস্তবতাকে নতুনভাবে দেখেছি, বুঝেছি। এই সময়টা আমাদের কারও জন্যই তেমন ভালো যায়নি। মঙ্গল শোভাযাত্রায় আমরা তাই মলিনতা মুছে মঙ্গল বা ভালোর দিকে যাওয়ার প্রত্যাশা করি। তাই এবারের প্রতিপাদ্য করোনার এই সময়টা পেরিয়ে জীবন নিয়ে নতুন করে আশাবাদী হওয়া।'
মঙ্গল শোভাযাত্রার ভেতর ধর্মবিরোধিতা না খুঁজে বা একে বিশেষ কোনো নেতিবাচক পন্থায় চিহ্নিত না করে ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে এই উৎসবমুখর শোভাযাত্রার অংশ হওয়ার আহ্বান আয়োজনকারীদের।
Comments