পদ্মা নদীর গভীরতার পার্থক্য পাওয়ায় সেতুর নকশা নতুন করে প্রণয়ন করতে হয়েছে: প্রধানমন্ত্রী

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশের বিভিন্ন এলাকার প্রকৃতিগত পার্থক্যের উল্লেখ করে অঞ্চলভিত্তিক যথাযথ উন্নয়ন পরিকল্পনা গ্রহণের নির্দেশ দিয়েছেন।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ফাইল ছবি

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশের বিভিন্ন এলাকার প্রকৃতিগত পার্থক্যের উল্লেখ করে অঞ্চলভিত্তিক যথাযথ উন্নয়ন পরিকল্পনা গ্রহণের নির্দেশ দিয়েছেন।

তিনি বলেন, 'বাংলাদেশের কিন্তু একেক এলাকা একেক রকম এটাও মাথায় রাখতে হবে। যে কোনো উন্নয়ন প্রকল্পের জন্য বাংলাদেশকে আরও ভালো করে চিনতে হবে, জানতে হবে।'

প্রধানমন্ত্রী আজ সকালে তার কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত 'ডেল্টা গভর্নেন্স কাউন্সিলের প্রথম সভায় দেয়া ভাষণে একথা বলেন।

শেখ হাসিনা বলেন, সরকার এই ব-দ্বীপের জনগণকে নিরাপদ করতে এবং জনগণকে উন্নত জীবন দিতে 'ডেল্টা প্ল্যান-২১০০' গ্রহণ করেছে।

এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, দেশের অর্জিত বিশাল সমুদ্র এলাকা ডেল্টা প্ল্যানে অন্তর্ভুক্ত করা হবে।

শেখ হাসিনা বলেন, যমুনা সেতু নির্মাণের সময় যমুনা নদীর প্রশস্থতা বিবেচনায় না এনে নদীর ওপর মাত্র ৪ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের সেতু নির্মাণ করা ছিল ভুল সিদ্ধান্ত। যা পদ্মা সেতুতে করা হয়নি। ফলে, সেতুটি দীর্ঘ হয়েছে।

তিনি বলেন, 'আমি পদ্মা সেতু ছোট করতে দেইনি। আমরা নদীর সাথে বাফার জোন রেখে সেতু নির্মাণ করেছি। সুতরাং, সেতুটি (দেশের) দীর্ঘতম সেতু হয়ে উঠেছে।'

'কিন্তু, আমি মনে করি, যমুনার উপর সেতুকে ৪ কিলোমিটারে নামিয়ে আনা একটি ভুল সিদ্ধান্ত ছিল। যেহেতু এর নকশা এবং পরিকল্পনা আগে করা হয়েছিল, তাই সেখানে আমাদের আর কিছু করার ছিল না। আমি কেবল এতে রেললাইন অন্তর্ভুক্ত করতে পারি,' বলেন তিনি।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যখন জাপান সফরে গিয়েছিলেন, তখন তিনি যমুনা নদীর ওপর সেতু নির্মাণের বিষয়ে জাপান সরকারের সঙ্গে আলোচনা করেন এবং তারপরে জাপান একটি সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের জন্য একটি দল পাঠায়। সম্ভাব্যতা যাচাই সমীক্ষা ১৯৭৪ সালে শুরু হয়েছিল।

সুতরাং, যমুনা নদীর উপর বাংলাদেশের একটি সুনির্দিষ্ট সম্ভাব্যতা প্রতিবেদন রয়েছে, তিনি বলেন, পদ্মা সেতু নির্মাণের সময় তার সরকার পদ্মা নদীর উপর একটি সম্ভাব্যতা সমীক্ষা চালিয়েছিল।

সরকার প্রধান বলেন, যে সম্ভাব্যতা প্রতিবেদনে সেতু প্রকল্প সাইটের বিভিন্ন স্থানে শক্তিশালী পদ্মা নদীর গভীরতার পার্থক্য পাওয়ায় তিনি সেতুর নকশা নতুন করে প্রণয়ন করান।

তিনি বলেন, 'নতুনভাবে আমি নকশা করিয়েছি। আমি এখানে কোনো গোঁজামিল দিতে  দেইনি। যদিও এটি সময় নিয়েছে, তারপরেও নকশা পাল্টে যেখানে যতটুকু ওজন নিতে পারবে সেভাবেই নকশা করেই এটা করা।'

তিনি বলেন, দেশের প্রতিটি বর্ষা মৌসুমে যমুনা ও পদ্মাসহ নদীর প্রবাহ ও তলদেশের মাটির চরিত্র পরিবর্তন হয়। যেহেতু এখানে বাংলাদেশের পরিস্থিতি অন্যান্য দেশের মতো নয়, তাই এই পার্থক্য মাথায় রেখে সঠিকভাবে পরিকল্পনা নিতে হবে।

কৃষিমন্ত্রী মুহাম্মদ আব্দুর রাজ্জাক, খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদার, ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী, পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রী মো. শাহাব উদ্দিন, প্রধানমন্ত্রীর বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিষয়ক উপদেষ্টা ড. তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরী, নৌ-পরিবহন প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী, পানি সম্পদ প্রতিমন্ত্রী জাহিদ ফারুক, প্রধান সমন্বয়ক (এসডিজি বিষয়ক) জুয়েনা আজিজ এবং প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সিনিয়র সচিব মো. তোফাজ্জেল হোসেন মিয়া  বৈঠকে অন্যান্যের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন।

যে কোনো সেতু নির্মাণে নদীর চরিত্র বিবেচনায় পরিকল্পনা করতে হবে উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী  যমুনা সেতুর সঙ্গে পদ্মা সেতু নির্মাণের তুলনামূলক চিত্র তুলে ধরেন এবং নদীর নব্যতা ধরে রাখার ওপরও গুরুত্বারোপ করেন। প্রধানমন্ত্রী বলেন, প্রথমে ক্যাপিটাল ড্রেজিং করে সেগুলোর নাব্যতা বাড়াতে হবে, পাশাপাশি প্রতিবছর সেগুলো রক্ষণাবেক্ষনের জন্য ড্রেজিং করাসহ নদীগুলো যেন মরে না যায়, সে ব্যবস্থা নিতে হবে। তিনি বলেন, ব-দ্বীপটাকে রক্ষা করা এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য একটা উন্নত জীবন দেওয়া আমাদের জন্য সবচেয়ে বেশি দরকার।

দেশের উন্নয়ন ও অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি অর্জনে সমুদ্রে থাকা বিশাল মৎস্য ও খনিজ সম্পদ কাজে লাগানোর ওপর গুরুত্বারোপ করে এজন্য একটি পরিকল্পনা গ্রহণ করারও নির্দেশ দেন প্রধানমন্ত্রী। তিনি বলেন, আমি মনে করি আজকের যে বিশাল সমুদ্র রাশি আমরা পেয়েছি 'ডেল্টা প্ল্যান'র সাথে এই একে আমাদের অর্থনৈতিক কার্যক্রমে কাজে লাগাতে হবে। এই ক্ষেত্রে আমরা 'ব্লু ইকোনোমি' ঘোষণা দিয়েছি। অর্থাৎ সমুদ্র সম্পদকে আমাদের দেশের উন্নয়নের কাজে লাগাতে হবে। সেক্ষেত্রে সীমিত আকারে হলেও কিছু কিছু গবেষণাধর্মী কাজ ইতোমধ্যে শুরু হয়েছে এবং বাংলাদেশের কক্সবাজারে তার সরকার একটি মেরিন রিসার্চ ইনস্টিটিউট স্থাপন করেছে বলেও তিনি উল্লেখ করেন।

সমুদ্র সম্পদ কাজে লাগাতে একটি পরিকল্পনা গ্রহণের বিষয়ে তিনি বলেন, সমুদ্র সম্পদ নিয়ে আমাদের একটা পরিকল্পনা থাকা উচিত। সেখানে আমরা কতটুকু কি কি করতে পারি। তেল-গ্যাস উত্তোলন ছাড়াও যে সামুদ্রিক সম্পদগুলো আমাদের দৈনন্দিন জীবনে কাজে লাগে এবং বিভিন্ন ভাবে খাদ্য নিরাপত্তায় কাজে লাগতে পারে, মৎস্যসহ সেসবের এক বিশাল ভান্ডার রয়েছে এখানে। এটাকে আমরা অর্থনৈতিক অঙ্গনে কিভাবে কাজে লাগাবো, এটা আমাদের দেখা দরকার। এই সম্পদ আমরা হেলায় হারাতে পারি না বলেও তিনি উল্লেখ করেন।

'যোগাযোগের ক্ষেত্র' হিসেবে আমাদের বঙ্গোপসাগরের গুরুত্ব তুলে ধরতে গিয়ে শেখ হাসিনা বলেন, আদিকাল থেকে এই বঙ্গোপোসাগর দিয়ে সারা বিশ্বের ব্যবসা বাণিজ্যটা চলে আসছে। দুই পাশে দুটো মহাসাগর। এক মহাসাগর থেকে আরেকটাতে যেতে গেলে এই বঙ্গোপোসাগরের ওপর দিয়েই কিন্তু চলাচলটা হয়। সেদিক থেকে বঙ্গোপোসাগরের গুরুত্ব কিন্তু অনেক বেশি। কাজেই এ রকম একটা গুরুত্বপূর্ণ সম্পদ ভান্ডারকে আমরা কিভাবে আমাদের অর্থনৈতিক কাজে ব্যবহার করতে পারি, সেটাও আমাদের চিন্তা করতে হবে।

মৎস্য ও খনিজ সম্পদ আহরণসহ সমুদ্র গবেষণা বাড়ানো এবং বঙ্গোপোসাগরকে দূষণ মুক্ত রাখার নির্দেশনা দিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, নেদারল্যান্ড'সে তিনি 'সাউথ সী'র দূষণ দেখেছেন। সেখানে পানিতে শুধু তেল ভাসে। কাজেই আমাদের বঙ্গোপোসাগরটা যেন সে রকম দূষিত না হয়, সেদিকে আমাদের দৃষ্টি দিতে হবে। পাশাপাশি এই সম্পদ আমরা কিভাবে কাজে লাগাবো, সেটাও আমাদের চিন্তা করতে হবে।

দেশের নদ-নদীগুলোকেও দূষণ থেকে রক্ষা করার নির্দেশ দিয়ে শেখ হাসিনা বলেন, আমাদের এটা মাথায় রাখতে হবে বাংলাদেশটা নদী মাতৃক। একটা মানুষের শরীরে যেমন শিরা-উপশিরা থাকে তেমনি নদীগুলোও আমাদের দেশের জন্য শিরা-উপশিরা। কাজেই নদী-খাল সচল রাখার পাশাপাশি দূষণমুক্ত রাখতে হবে। যত্রতত্র শিল্প কারখানা যেন না হয়, সে জন্য সরকার পদক্ষেপ নিয়েছে জানিয়ে এক্ষেত্রে ১শ' বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠার পদক্ষেপ নেয়ার কথা বলেন তিনি। 

জলবায়ু পরিবর্তনে বাংলাদেশের কোনো দায় নেই উল্লেখ করে তিনি বলেন, উন্নত দেশগুলোর কারণে জলবায়ু পরিবর্তন ঘটলেও এর প্রভাব পড়ছে বাংলাদেশের ওপর। ডেল্টা প্ল্যান বাস্তবায়নের জন্য ইতিমধ্যে বাংলাদেশ ও নেদারল্যান্ডসের মধ্যে যে সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হয়েছে, তার উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ২১০০ সাল পর্যন্ত এই পরিকল্পনার প্রয়োজনে সময়ে সময়ে কিছু পরিবর্তন ও পরিমার্জন করা যেতে পারে। তিনি বলেন, প্রাকৃতিক পানির প্রবাহ বজায় রাখতে হাওর, বিল ও অন্যান্য জলাশয়ের ওপর দিয়ে উঁচু সড়ক নির্মাণের নির্দেশনা দিয়েছেন তিনি। পানিপ্রবাহ যাতে বাধাগ্রস্ত না হয়, সেজন্য সড়কে পর্যাপ্ত কালভার্ট ও সেতু নির্মাণের ওপর গুরুত্বারোপ করেন শেখ হাসিনা।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমাদের ডেল্টা প্ল্যান করার লক্ষ্যটা হলো- আমাদের ভবিষ্যৎ করণীয় সুনির্দিষ্ট করা। সেটা আমরা করে ফেলেছি। ২০২০ এর মধ্যে আমাদের রূপকল্প বাস্তবায়ন করে '২১ সালে এসে আমরা স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী পালন করেছি। পরিকল্পনা আরেকটা নিয়েছি, সেটা হলো- '২১ থেকে '৪১ পর্যন্ত আমাদের প্রেক্ষিত পরিকল্পনা। প্রেক্ষিত পরিকল্পনা হচ্ছে  একটা কাঠামো। এই কাঠামোর ওপর ভিত্তি করেই আমাদের পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা। তারই পাশাপাশি, ২১০০ সালের বাংলাদেশের কথা মাথায় রেখেই আমাদের এই ডেল্টা প্ল্যান।

শেখ হাসিনা বলেন, বদ্বীপটাকে রক্ষা করা এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য একটা উন্নত জীবন দেয়াটাই আমাদের জন্য সবথেকে বেশি প্রয়োজন। আসলে পরিকল্পিতভাবে পদক্ষেপ নিতে পারলে যেকোন কঠিন কাজ সমাধান করা যায় এবং সেরকম পদক্ষেপই আমি নেই। সময়ের বিবর্তনে সেগুলি সংশোধন করার এই মানসিকতাও থাকতে হবে।  আমরা সেইভাবেই পদক্ষেপগুলি নিয়েছি ও বাস্তবায়ন করেছি। যার ফলে আমরা কিন্তু সাফল্য অর্জন করতে পেরেছি।

Comments

The Daily Star  | English

Transport strike in Ctg: Passengers suffer amid heatwave

Sidratul Muntaha, a student, went to the port city's Natunpara bus stand area this morning in order to catch a bus to Chawkbazar, where she was scheduled to attend class at a coaching centre

16m ago