টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ ২০১২: ওয়েস্ট ইন্ডিজের দানবীয় প্রত্যাবর্তন

টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটের জন্মলগ্নে সবাই ধরেই নিয়েছিল এই ফরম্যাটে রাজত্ব করবে ওয়েস্ট ইন্ডিজ। তবে ২০০৭ এর প্রথম আসর থেকেই হতাশা ও আক্ষেপ সঙ্গী ক্যারিবীয়দের। শেষ পর্যন্ত ভক্তদের সকল আক্ষেপ দূর করে ২০১২ তে এসে স্বপ্নপূরণ হয় উইন্ডিজের। ৩৩ বছরের বিশ্ব আসরে শিরোপা খরা ঘুচিয়ে ক্রিস গেইল, ডোয়াইন ব্রাভো, কাইরন পোলার্ডদের গ্যাংনাম নৃত্যে মেতে উঠার দৃশ্য আজও চোখে ভাসে ক্রিকেটপ্রেমীদের।

তবে শুরুর পথটা মসৃণ ছিল না ড্যারেন সামির দলের। দুর্ভাগ্য সঙ্গী করে ২০১২ টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ শুরু করেছিল ওয়েস্ট ইন্ডিজ। ডাকওয়ার্থ লুইসের মারম্যাচে প্রথম ম্যাচেই অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে বরণ করতে হয় ১৭ রানের হার। আগে ব্যাট করে গেইল-স্যামুয়েলসের জোড়া ফিফটিতে ১৯১ রানের বিশাল সংগ্রহ গড়ে ক্যারিবীয়রা। জবাবে অজিরা ৯.১ ওভারে ১ উইকেটে ১০০ রান তুলতেই হানা দেয় বৃষ্টি। পরে আর ম্যাচটি মাঠে না গড়ালে রান রেটে এগিয়ে থাকা অজিদের জয়ী ঘোষণা করা হয়।

এরপর আয়ারল্যান্ডের বিপক্ষেও বৃষ্টি পিছু ছাড়েনি গেইল, পোলার্ডদের। ১৯ ওভারে নেমে আসা ম্যাচটিতে আইরিশদের মাত্র ১২৯ রানে বেধে ফেললেও ব্যাট হাতে আর নামা হয়নি ক্যারিবিয়ানদের। ফলে নেট রান রেটে এগিয়ে থেকে ভাগ্যের জোরে সুপার এইট নিশ্চিত হয় উইন্ডিজের। 

এর আগে বিশ্বকাপের উদ্বোধনী ম্যাচে জিম্বাবুয়েকে ৮২ রানে উড়িয়ে দিয়ে আসর শুরু করে স্বাগতিক শ্রীলঙ্কা। লঙ্কানরা দক্ষিণ আফ্রিকায় বধ হলেও জিম্বাবুয়ের দুই হারে শেষ আটে নাম লেখায় মাহেলা জয়াবর্ধনের দল। এদিকে গ্রুপ পর্বের সবগুলো ম্যাচ জিতে দাপটের সঙ্গে সুপার এইটে পা রাখে ভারত, অস্ট্রেলিয়া, দক্ষিণ আফ্রিকা ও পাকিস্তান।

২০০৯ ও ২০১০ এর মতো এই আসরেও সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয় বাংলাদেশ। নিউজিল্যান্ড ও পাকিস্তানের কাছে হেরে গ্রুপ পর্বেই ছিটকে যায় মুশফিকুর রহিমের দল। বাংলাদেশের মতোই খালি হাতে বিদায় নেয় আয়ারল্যান্ড, আফগানিস্তান ও জিম্বাবুয়ে।

সুপার এইটের সবচেয়ে দুর্ভাগা দল ছিল মাহেন্দ্র সিং ধোনির ভারত। গোটা আসরে কেবল একটি ম্যাচ হারই কাল হয়েছিল কোহলি-শেবাগদের। অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে ৯ উইকেটের হারে নেট রান রেটে বেশ পিছিয়ে পড়ে ভারত। ফলে সুপার এইটের শেষ ম্যাচে দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে ১ উইকেটের নাটকীয় জয়ও রক্ষা করতে পারেনি তাদের। সমান পয়েন্ট নিয়েও রান রেটে এগিয়ে থেকে সেমিতে পা রাখে মোহাম্মদ হাফিজের পাকিস্তান।

তবে ২০১২ বিশ্বকাপের উত্তেজনার ঘাটতি কিছুটা পূরণ করেছিল ভারত-দক্ষিণ আফ্রিকা ম্যাচ। আগে ব্যাট করে প্রোটিয়াদের ১৫৩ রানের লক্ষ্য দিয়েছিল ভারত। শেষ ওভারে ১৪ রান দরকার ছিল এবিডি ভিলিয়ার্সের দলের। একটি করে ছক্কা হাঁকিয়ে লড়াই জমিয়ে তোলেন মরকেল ভাতৃদ্বয় এলবি ও মরনে। শেষ দুই বলে দুই রান দরকার যখন তখনই লক্ষ্মিপতি বালাজি বোল্ড করে দেন মরনেকে, একই সঙ্গে শেষ হয়ে যায় প্রোটিয়াদের জয়ের স্বপ্ন। সুপার এইটের সব ম্যাচ হেরে নিজেদের 'চোকার' অপবাদ ঘুচাতে আরও একবার ব্যর্থ হয় দক্ষিণ আফ্রিকা।

প্রথম সেমিফাইনালে অল্প পুঁজি নিয়েও নিয়ন্ত্রিত বোলিংয়ে পাকিস্তানকে ছিটকে দেয় লঙ্কান বাহিনী। সেমির দ্বিতীয় ম্যাচে ভক্তদের ধুমধাড়াক্কা ব্যাটিং উপহার দেয় ওয়েস্ট ইন্ডিজ। ৪১ বলে ৭৫ রান করে এই তাণ্ডবের নেতৃত্ব দেন গেইল। ব্রাভো (৩৭) ও পোলার্ডের (৩৮) কাছ থেকেও সমর্থন পেয়েছিলেন ইউনিভার্স বস, এই ত্রয়ীর দারুণ ব্যাটিংয়ে ২০৫ রানের বিশাল সংগ্রহ পায় ক্যারিবীয়রা।

জবাবে বল হাতে জ্বলে উঠেন উইন্ডিজ বোলাররাও। রবি রামপল, সুনিল নারাইন ও স্যামুয়েল বদ্রির নিয়ন্ত্রিত ও ক্ষুরধার বোলিংয়ে ১৩১ রানেই গুটিয়ে যায় অস্ট্রেলিয়া। অধিনায়ক জর্জ বেইলি মাত্র ২৯ বলে ৬৩ রানের ইনিংস খেলে চেষ্টার কমতি রাখেননি। তবে দিনশেষে সেটা তার জন্য ছিল নিছক সান্ত্বনা। ৭৪ রানে হেরে বিদায় নেয় ক্যাঙ্গারুরা।

তবে ফাইনালে রোমাঞ্চের কোন কমতি রাখেনি ক্যারিবীয় বোলাররা। ১৩৮ রানের মামুলি লক্ষ্যকে লঙ্কানদের জন্য পাহাড়সম বানান সে সময় সাড়া জাগানো মিস্ট্রি স্পিনার সুনিল নারাইন। ফাইনালে মাত্র ২.৪৫ ইকোনমি রেটে বল করেন এই উইন্ডিজ স্পিনার, তুলে নেন তিনটি মূল্যবান উইকেট। অধিনায়ক ড্যারেন সামিও জ্বলে উঠেছিলেন সেই ম্যাচে। ২ ওভারে মাত্র ৬ রান দিয়ে ২ উইকেট শিকার করেন তিনি। তাদের দুর্দান্ত বোলিংয়ে মাত্র ১০১ রানে অলআউট হয়ে যায় শ্রীলঙ্কা।

ম্যাচশেষে ক্যারিবীয় ক্রিকেটারদের উদ্দাম নৃত্য ও উল্লাস চোখের জলে ভাসায় লঙ্কান ভক্তদের। এদিকে ওয়েস্ট ইন্ডিজের হাতে শিরোপা ওঠায় যেন সার্থক হয় টি-টোয়েন্টির জন্ম। ব্যাট হাতে ৭৮ রান ও বল হাতে ১ উইকেট নিয়ে ফাইনালের ম্যান অফ দ্য ম্যাচ হন স্যামুয়েলস। অন্যদিকে ব্যাট হাতে ২৪৯ রান ও বল হাতে ১১ উইকেট শিকার অজি অলরাউন্ডার শেন ওয়াটসনকে দেয় আসরের সেরা খেলোয়াড়ের স্বীকৃতি।    

সেমিতে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে উইন্ডিজের করা ২০৫ রানই ছিল আসরের সর্বোচ্চ দলীয় সংগ্রহ। ব্যাটিংয়ে ওয়াটসনের ২৪৯ রান টপকাতে পারেনি কেউই। ফলে অজি ক্রিকেটারই বনে যান আসরের সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহক। ২০১২ বিশ্বকাপে কেবল একটি সেঞ্চুরি দেখার সৌভাগ্য হয়েছিল দর্শকদের। বাংলাদেশের বিপক্ষে মাত্র ৫৮ বলে ১২৩ রান করেছিলেন ব্রেন্ডন ম্যাককালাম। সেটিই হয়ে আসে আসরের সর্বোচ্চ ব্যক্তিগত সংগ্রহ।

বল হাতে গোটা আসরেই বাজিমাত করেছিলেন লঙ্কান স্পিনার অজন্তা মেন্ডিস। ১৫ উইকেট নিয়ে আসরের সর্বোচ্চ উইকেট শিকারি হন তিনি। বিশ্বকাপের প্রথম ম্যাচেই জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে মাত্র ৮ রান খরচায় ৬ উইকেট নিয়েছিলেন মেন্ডিস। আসরজুড়ে ধরে রেখেছিলেন সেই ধারাবাহিকতা। তবে দিনশেষে শিরোপা ছুঁয়ে দেখার সৌভাগ্য হয়নি তার। এভাবেই অনেক হাসি-কান্নার পর ইতি ঘটে আরও একটি টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের।

Comments

The Daily Star  | English

Life insurers mired in irregularities

One-fourth of the life insurance firms in the country are plagued with financial irregularities and mismanagement that have put the entire industry in danger.

6h ago