নির্বাচনের বছরে আমলাতন্ত্র: শীর্ষ পদে নিয়োগে নানা সমীকরণে সরকার

জাতীয় নির্বাচনের আগে আগামী এক বছরে আমলাতন্ত্রের গুরুত্বপূর্ণ পদগুলোতে ব্যাপক রদবদল অপেক্ষা করছে।

জাতীয় নির্বাচনের আগে আগামী এক বছরে আমলাতন্ত্রের গুরুত্বপূর্ণ পদগুলোতে ব্যাপক রদবদল অপেক্ষা করছে।

এই রদবদলের অপেক্ষায় আছে প্রশাসনের শীর্ষ ৩ পদ- মন্ত্রীপরিষদ সচিব, প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব ও প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সচিব পদও।

এ ছাড়া, ২০২৪ সালের প্রথম দিকে জাতীয় নির্বাচনের আগে ৭৮ জন সচিবের মধ্যে ৩৫ জন অবসরে যাবেন।

সচিবালয়ের অভ্যন্তরীণ সূত্রের মতে, সরকার এই পদগুলো পূরণে গুরুতর চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে পারে। কেননা, ১৯৯১ থেকে ১৯৯৬ সালের মধ্যে বিএনপি-জামায়াত শাসনামলে নিয়োগপ্রাপ্ত ১১ ও ১৩তম বিসিএসে যারা নিয়োগ পেয়েছেন তারাই এখন সচিব পদে পদোন্নতি পেতে পারেন।

একই পরিস্থিতি তৈরি হতে পারে জেলা প্রশাসক বাছাইয়ের ক্ষেত্রেও। কেননা, বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে অনুষ্ঠিত ২১, ২২ ও ২৪তম বিসিএসে উত্তীর্ণদের মেধ্য থেকে বেছে নিতে হতে পারে জেলা প্রশাসক।

ব্যাপকভাবে এই ধারণা প্রচলিত আছে যে ক্ষমতাসীন দলের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট আবেদনকারীরা সিভিল সার্ভিসে নিয়োগে অগ্রাধিকার পায় এবং নিয়োগের পর এই সরকারি কর্মকর্তারা সেই দলের প্রতি অনুগত থাকে।

সরকারি সূত্র জানিয়েছে, এই রদবদলের অংশ হিসেবে বর্তমান মন্ত্রীপরিষদ সচিব খন্দকার আনোয়ারুল ইসলামের সঙ্গে ৩ বছরের চুক্তির মেয়াদ আগামী ১৫ ডিসেম্বর শেষ হলে পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব কবির বিন আনোয়ারকে এই পদে নিয়োগ দেওয়া হতে পারে।

কবির বিন আনোয়ার ১৮ ডিসেম্বর মন্ত্রীপরিষদ সচিব হিসেবে যোগদান করলে চাকরির বয়স অনুযায়ী মাত্র ১৩ কার্যদিবস অফিস করার সুযোগ পাবেন। আগামী ৩ জানুয়ারি তার অবসর পরবর্তী ছুটিতে (পিআরএল) যাওয়ার কথা রয়েছে। সেক্ষেত্রে সরকার তার চাকরির মেয়াদ বাড়াতে পারে।

২০১৯ সালের ২৮ অক্টোবর সরকার যখন খন্দকার আনোয়ারুল ইসলামকে মন্ত্রীপরিষদ সচিব হিসেবে নিয়োগ দেয়, তখন তার পিআরএলে যাওয়ার জন্য সময় বাকি ছিল মাত্র ২ সপ্তাহ। এরপর থেকে তার চাকরির মেয়াদ ২ বার বাড়ানো হয়েছে।

প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সিনিয়র সচিব তোফাজ্জল হোসেন মিয়া প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব হতে পারেন। কারণ বর্তমান মুখ্য সচিব ডক্টর আহমদ কায়কাউসের চুক্তির মেয়াদ আগামী ৩১ ডিসেম্বর শেষ হচ্ছে।

গত ২৮ নভেম্বর মন্ত্রীসভার শেষ বৈঠকে কায়কাউসকে বিদায় জানানো হয়। সর্বশেষ মন্ত্রীপরিষদ সচিব মোহাম্মদ শফিউল আলমের স্থলাভিষিক্ত হয়ে তিনি বিশ্বব্যাংক গ্রুপে বিকল্প নির্বাহী হিসেবে যোগ দিতে যাচ্ছেন বলে সূত্র জানিয়েছে।

অন্যদিকে, প্রধানমন্ত্রীর পিএস-১ (অতিরিক্ত সচিব) মোহাম্মদ সালাহউদ্দিন প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সচিব হিসেবে পদোন্নতি পেতে পারেন।

নিয়োগ, পদোন্নতি ও বেসামরিক আমলাতন্ত্রে যেকোনো পরিবর্তন করা হয় জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে। এই মন্ত্রণালয়েও ইতোমধ্যে পরিবর্তন আনা হয়েছে।

উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, মোহাম্মদ মেজবাহ উদ্দিন চৌধুরী গত ২ নভেম্বর এই মন্ত্রণালয়ে সিনিয়র সচিব হিসেবে যোগদান করেন। তার পূর্বসূরি সিনিয়র সচিব কে এম আলী আজম গত ৩১ অক্টোবর পিআরএলে যান।

পরে সরকার আজমকে বাংলাদেশ পাবলিক সার্ভিস কমিশনের সদস্য পদে নিয়োগ দেয় এবং তার পিআরএল ও সংশ্লিষ্ট সুবিধা স্থগিত করে।

দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচনের আগে ৩৫ বা তারচেয়ে বেশি সচিব পিআরএলে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত। তাদের মধ্যে ১১ জনের পিআরএল শুরু হবে এ মাসের শেষের দিকে, বাকি ২৪ জন যাবেন পরের বছর।

জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটের তথ্য অনুযায়ী, ৭৮ জন সচিব ও ৩৯৯ জন অতিরিক্ত সচিব এখন বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগে কর্মরত আছেন।

১ বছরের ব্যবধানে বিপুল সংখ্যক প্রশাসন কর্মকর্তা অবসর নেওয়ায় সরকারকে এই শূন্যতা পূরণ করতে হবে নির্বাচনের ঠিক আগ মুহূর্তে।

এত অল্প সময়ে এত বড় সংখ্যক সিনিয়র আমলা অবসরে যাওয়ার নজির আর নেই।

নবনিযুক্তদের অধীনেই নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে বলে ইতোমধ্যেই জল্পনা-কল্পনা চলছে নিয়োগের বিষয়ে।

সচিবদের চুক্তিভিত্তিক নিয়োগের বিপক্ষে অবস্থান অধিকাংশ আমলার। সচিবদের মেয়াদ বৃদ্ধি ও চুক্তিভিত্তিক নিয়োগে বঞ্চিত হন তাদের জুনিয়ররা।

এ কারণে অনেক আমলা কবির বিন আনোয়ারকে মন্ত্রীপরিষদ সচিব পদে নিয়োগের বিরোধিতা করছেন। কারণ তাকে নিয়োগ দেওয়া হলে সরকারকে তার মেয়াদ বাড়াতে হতে পারে।

এই বিরোধিতার প্রেক্ষাপটে মন্ত্রীপরিষদ সচিব হতে পারেন জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগের সিনিয়র সচিব মাহবুব হোসেন।

সাবেক মন্ত্রীপরিষদ সচিব আলী ইমাম মজুমদার আমলাতন্ত্রে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগের বিপক্ষে।

তিনি বলেন, 'সিনিয়রদেরকে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দেওয়া হলে অনেক জুনিয়রের সম্ভাবনা নষ্ট হয়ে যায়। আমলাতন্ত্রে সাধারণ পদোন্নতির পদ্ধতি অনুসরণ করা উচিত।'

৩৫ শীর্ষ আমলা অবসরে যাওয়ার বিষয়ে তিনি বলেন, 'এতে কোনো শূন্যতা তৈরি হবে না।'

'অতিরিক্ত সচিবরা এখন সচিব হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করবেন। তাদের প্রায় ৩০ বছর প্রশাসনে কাজ করার অভিজ্ঞতা রয়েছে। কাজেই নিঃসন্দেহে তারাও তাদের দায়িত্ব সুষ্ঠুভাবে পালন করতে সক্ষম', যোগ করেন আলী ইমাম।

সাধারণত জেলা প্রশাসকরা নির্বাচনে রিটার্নিং কর্মকর্তা হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন এবং ইউএনও সহকারী রিটার্নিং কর্মকর্তার দায়িত্ব পালন করেন।

জেলা প্রশাসক ও ইউএনও উভয়েই জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের অধীনে কাজ করেন।

অন্যদিকে, মন্ত্রীপরিষদ সচিব, প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব ও প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সচিব সরকারের সিদ্ধান্ত গ্রহণে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।

স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অধীন জননিরাপত্তা বিভাগের সিনিয়র সচিবও নির্বাচনের সময়ে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ পদ। কারণ নির্বাচনের সময় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালনকারী পুলিশ, বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ, কোস্ট গার্ড, আনসার ও ভিডিপিরা এই বিভাগের অধীনে থাকে।

এই বিভাগের সিনিয়র সচিব ৮ম ব্যাচের ক্যাডার আমিনুল ইসলাম খানের পিআরএলে যাওয়ার কথা রয়েছে আগামী ৩১ মার্চ। পুলিশ এই বিভাগের অধীনে থাকায় এবং পুলিশের মহাপরিদর্শকের পদকে সিনিয়র পদে উন্নীত করায় আমিনুল ইসলাম খানের স্থলাভিষিক্ত করতে একজন সিনিয়র সচিব পর্যায়ের কর্মকর্তা প্রয়োজন।

সরকারকে ৩৫ জন নতুন সচিব নিয়োগ দিতে হবে বিসিএসের ১১ ও ১৩তম ব্যাচ থেকে। এই ২টি ব্যাচ ১৯৯১ থেকে ১৯৯৬ সালের মধ্যে বিএনপি-জামায়াতের আমলে অনুষ্ঠিত পরীক্ষায় উত্তীর্ণ। এই ২ বিএসসি পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হওয়ার সময় ইয়াজউদ্দিন আহমেদ এবং এসএমএ ফয়েজ পিএসসির চেয়ারম্যান ছিলেন।

বিএনপির শাসনামলে ইয়াজউদ্দিন আহমেদ রাষ্ট্রপতি হন এবং ফয়েজ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হন।

গত মাসেই সরকার ১৮টি জেলায় নতুন জেলা প্রশাসক নিয়োগ করেছে এবং আরও ৫ জেলায় রদবদল করেছে।

তাদের মধ্যে ২১তম বিসিএস থেকে ১৩ জন, ২২তম থেকে ৪ জন এবং ২৪তম বিসিএস থেকে একজন রয়েছেন।

জনপ্রশাসন কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, জাতীয় নির্বাচনকে সামনে রেখে বাকি জেলাগুলোতেও জেলা প্রশাসক পরিবর্তন করবে সরকার। এই জেলা প্রশাসকরা আসতে পারেন ২৪ ও ২৫ তম বিসিএস ব্যাচ থেকে।

সরকারি সূত্র জানায়, যেহেতু সরকারের নীতিনির্ধারকরা এসব ব্যাচ থেকে জেলা প্রশাসক নিয়োগে অস্বস্তি বোধ করছেন, তাই তারা ২৭তম ব্যাচ থেকে বাছাই করতে পারেন। ২৭তম ব্যাচের নিয়োগ হয়েছে ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে।

জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের একজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'জোরালো সম্ভাবনা রয়েছে যে সরকার ২৭তম ব্যাচ থেকে জেলা প্রশাসক বেছে নেবে।'

Comments

The Daily Star  | English
World Press Freedom Day 2024

Has Bangladesh gained anything by a restrictive press?

The latest Bangladesh Bank restriction on journalists is anti-democratic, anti-free press and anti-public interest.

11h ago