সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়: দেখা হয় নাই চক্ষু মেলিয়া

স্টার ফাইল ফটো

সন্তানের শিক্ষার প্রয়োজনে আপনি হয়তো শহরে থাকেন। শহরের কোনো কিন্ডারগার্টেনে আপনার ৩, ৪ বা ৫ বছর বয়সী সন্তানকে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার জন্য ভর্তি করেছেন। প্রতিদিন যথাসময়ে শিশুকে স্কুলে পৌঁছে দেওয়া, টিফিন ও বাড়ির কাজ রেডি করে দেওয়া, আর্টের ক্লাস, স্কুলের নানা প্রতিযোগিতায় এগিয়ে থাকার জন্য আরও নানা রকম ক্লাস ও কোচিং, বাসায় প্রাইভেট টিউটর ইত্যাদি নিয়ে আপনার ব্যস্ততার শেষ নেই।

আয়োজনে কোথাও আপনার সামান্য কমতি নেই। চাওয়া একটাই, আপনার সন্তান যেনো অন্যদের থেকে এগিয়ে থাকতে পারে, প্রতিযোগিতায় যেন জয়ী হয়।

চমৎকার হাতের লেখা, প্রশ্নোত্তর (যেখানে শিশু নিজের প্রশ্নের কোনো জবাব মেলে না) সব মুখস্থ, বাংলা-ইংরেজি ২ ভাষাতেই অনর্গল মুখস্থ বলে যেতে পারে অনেক কিছু। ভালো ছবি আঁকে, একদম আর্টের টিচারের মতো। ভালো ছড়া বলে, একদম ম্যাম যেভাবে শিখিয়ে দিয়েছেন। কিন্তু ওর কোনো খেলার সাথী নেই, শৈশবের দুরন্তপনা নেই, প্রকৃতি নেই, নদী, মাঠ, বন-জঙ্গল, পুকুর, প্রতিবেশী, পারিবারিক নানা সম্পর্কের স্বজন নেই। অনেকের নেই কোনো ভাই-বোনও। কেবল মা-বাবার সঙ্গে শিশু নিজেকে এক ভিন্ন গ্রহের প্রাণী হিসেবে কল্পনা করে নেয়, যেখানে মা-বাবা তাকে লালন-পালনের দায়িত্বে নিয়োজিত, আর তার কাজ কেবল প্রতিযোগিতা করে সামনে এগিয়ে যাওয়া।

অন্যকে ল্যাং মেরে হলেও তাকে জয়ী হতে হবে। শহরের এক প্রকোষ্ঠে চলে তার লালন-পালন, আরেক প্রকোষ্ঠে তার প্রতিযোগিতার প্রস্তুতি। তাকে অতি যত্নে সকল মলিন পরিপার্শ্ব থেকে দৃষ্টি বাঁচিয়ে কেবল চকচকে জীবনের দিকে ধাবিত হওয়ার জন্য উৎসাহ যোগানো হয় প্রতিক্ষণে। কর্মক্লান্ত ঘর্মাক্ত মুখশ্রী, কর্মীর রুক্ষ হাতের সৌন্দর্য্য তার কাছে বিশ্রী। একসময় প্রিয় বাবা-মাও তার কাছে বোঝা মনে হয় প্রতিযোগিতার প্রয়োজনে। তার পরিপাটি জীবনে একসময় মা-বাবার বিবর্ণ শ্রমক্লান্ত অবয়বও অস্বস্তির উদ্রেক করে।

আপনি তাকে নিকটবর্তী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পাঠাননি। কারণ, ওখানে সমাজের নিম্নবিত্ত, খেটে খাওয়া মানুষের সন্তানরা এসে ভিড় বাড়ায়, যাদের জীবনপ্রণালী ও ভাষা শালীন নয়। আপনার সন্তান যাতে ওসব অশালীন ভাষা শিখে না ফেলে, সেজন্য আপনি সজাগ থেকেছেন।

এসব সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়ালেখা কম, তাই খেলার সময় পায় শিশুরা। পাড়া-মহল্লার শিশুদের একত্রে হুল্লোড় করার মতো যথেষ্ট সময় ও সুযোগ থাকে এসব বিদ্যালয়ে। তাই তারা পরস্পরের সঙ্গে ভাব-বিনিময় করে অবাধে। কেবল প্রতিযোগিতা নয়, সহযোগিতাও যে জীবনের একান্ত প্রয়োজন তা এসব নিম্নবিত্ত মানুষের সংগ্রামী জীবন থেকে সহজেই বুঝে নেয় শিশুরা।

সর্বোপরি যে সমাজ-রাষ্ট্রে শিশুর জন্ম, সেখানকার বাস্তবতাকে উপলব্ধি করার সুযোগ পায় সে অনায়াসে। এসব বিদ্যালয়ে শিক্ষক হিসেবে যারা নিয়োজিত, তাদের নুন্যতম শিশুশিক্ষার বিষয়ে প্রশিক্ষণ দেওয়ার ব্যবস্থা আছে, যাতে করে তারা শিশুদের প্রতি সঠিক আচরণটি দেখাতে পারেন। সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় রাষ্ট্র নির্ধারিত শিক্ষাক্রম অনুসরণ করে পরিচালিত হয়। সব শিশুর বিকাশের উপযোগী পরিবেশ নিশ্চিত করতে শিশুর পরিবারের সঙ্গে নিবিড় যোগাযোগ গড়ে তোলার উদ্যোগ নেওয়া হয়। বাংলাদেশ সরকার সব শিশুর জন্য বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষা নিশ্চিত করতে বিনামূল্যে এই সেবা প্রদানে অঙ্গীকারাবদ্ধ। সেজন্য উন্মুক্ত প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার মাধ্যমে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে মেধাবীদের শিক্ষক হিসেবে নেওয়া হচ্ছে, যদিও বেতন কাঠামো নিয়ে অসন্তোষ রয়েছে। তবু বড় বড় বিশ্ববিদ্যালয়ের গণ্ডি পেরোনো মেধাবীরা এখানে নিয়োগ পাচ্ছেন। এমনকি বিসিএসের মাধ্যমে নন-ক্যাডার পোস্টে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক হচ্ছেন অনেকে। নিয়োগ লাভের পরই ১৮ মাসের প্রশিক্ষণ দিয়ে তাদেরকে তৈরি করা হচ্ছে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পাঠদানের জন্য।

তবুও এসব বিনামূল্যের সরকারি ব্যবস্থায় আপনার আস্থা নেই। আপনার আস্থা ওইসব ব্যবসানির্ভর কিন্ডারগার্টেনের ওপর, যাদের নিজস্ব বিদ্যালয় ভবন নেই, খেলার মাঠ নেই, শিক্ষকদের ন্যূনতম কোনো প্রশিক্ষণ নেই। শিক্ষাক্রম কী বস্তু, তাও জানেন না এসব বিদ্যালয়ের অনেক শিক্ষক। রাষ্ট্র নির্ধারিত শিক্ষাক্রমকে তোয়াক্কা না করে ইচ্ছামাফিক চাকচিক্যময় বাণিজ্য-সর্বস্ব এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রতিই যখন আপনি সন্তানের ভবিষ্যৎ বিনির্মাণের ভার তুলে দেন, তখন তার পরিণতির জন্যও আপনাকেই প্রস্তুত থাকতে হবে নিজ দায়িত্বে।

আপনি যদি সন্তানকে এ দেশে না রাখতে চান, তাহলে বলার কিছু নেই। কিন্তু এ দেশে থাকতে হলে তো তাকে এ ভূখণ্ডের আর্থ-সামাজিক পরিস্থিতি উপলব্ধি করতে হবে। এ দেশের সিংহভাগ মানুষের মুখের ভাষা, জীবনপ্রণালী তাকে বুঝতে হবে। অন্যথায় সে কীভাবে টিকে থাকবে এখানে?

সন্তানকে ক্রমাগত বিচ্ছিন্ন করে কেবল প্রতিযোগিতায় জয়ী হওয়ার শিক্ষা না দিয়ে, জীবনকে সামগ্রিকভাবে দেখার সুযোগ করে দিলে সে হয়তো একটা নিজস্ব পথ খুঁজে পেত, যে পথে সে নিজেকে নিজের মতো করে বিকশিত করার উৎসাহে এগিয়ে যেতে পারত। আপনি তার শেকড় কেটে, ডালপালা ছেঁটে, আপনার ইচ্ছের ছাঁচে ফেলে যে বনসাই বানানোর চেষ্টা করলেন, তাতে যদি পুরোপুরি সফলও হন, তবু সে বড় জোর আপনার কাঙ্ক্ষিত বনসাই-ই হবে।

অথচ রাষ্ট্র আপনার সন্তানের প্রাথমিক শিক্ষার সুযোগকে আপনার নাগালের মধ্যে নিয়ে গেছে। আপনার বাসস্থানের খুব কাছেই কোথাও দেখতে পাবেন সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। সরকার নির্ধারিত যুগোপযোগী শিক্ষাক্রম, সুদৃশ্য বিদ্যালয় ভবন, সুপরিসর বিদ্যালয় অঙ্গন, সজ্জিত শ্রেণিকক্ষ, প্রশিক্ষিত শিক্ষক, প্রয়োজনীয় শিক্ষা উপকরণ, বিনামূল্যের বই, উপবৃত্তি, ক্ষেত্র বিশেষে খাবারের সরবরাহ, নিয়মিত দেখভালের ব্যবস্থাসহ আরও কত আয়োজন সেখানে।

আর এর সবকিছুই করা হচ্ছে রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনায় সবার জন্য এক বৈষম্যহীন প্রাথমিক শিক্ষার সুযোগ তৈরি করতে। যাতে আগামী প্রজন্ম রাষ্ট্রের কাঙ্ক্ষিত নাগরিক হিসেবে গড়ে ওঠার সুযোগ পায়। কিন্তু এত আয়োজনেও আপনার আস্থা নেই।

আপনার অংশগ্রহণে যে বিদ্যালয়টি পূর্ণতা পেতো পারতো, আপনার শিশুর সামগ্রিক বিকাশের কেন্দ্র হিসেবে, সেই বিদ্যালয়টিই আজ আপনার আস্থাহীনতার গ্লানি নিয়ে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে। আর আপনি শিক্ষা ব্যবসায়ীর জৌলুসে মজে নিজ খরচে আপনার শিশু সন্তানকে নিক্ষেপ করছেন এক অপরিকল্পিত শিক্ষা ব্যবস্থার নিগড়ে।

প্রতিটি শিশুই তার নিজস্ব শিখন প্রক্রিয়াকে কাজে লাগিয়ে অতি শৈশবেই পৃথিবীর পরিবেশে নিজেকে অভিযোজিত করে নেয় অবলীলায়। অতঃপর আমরা শিক্ষার নামে, সভ্যতার নামে, আমাদের মনগড়া বিকাশের নামে তার সেই নিজস্ব শিখন প্রক্রিয়াকে ব্যহত করতে থাকি। ফলে শিশুর নিজস্ব শিখন প্রক্রিয়া শাণিত না হয়ে বরং ভোতা হতে শুরু করে। সে তখন অনিচ্ছুক শিক্ষার্থী হয়। কেননা তার ভালো লাগাকে অগ্রাহ্য করে একের পর এক তাকে নানা বিষয় শিখতে বাধ্য করা হয়।

শৈশবের সহজাত প্রবণতাকে রুখে দিয়ে সমাজের নানা বৈরী হাওয়ায় টিকে থাকার কূটকৌশল শেখানোর মহড়া চলে শিশুকে নিয়ে। এভাবে ক্রমাগত চলতে চলতে শিশু তার শেখার সহজাত প্রবণতাগুলো (যেমন: কৌতূহল, জিজ্ঞাসা, মনোযোগ, বিস্ময়বোধ, উদ্যম) হারিয়ে ফেলে। ফলে সে অনেক কিছু শিখলেও সেগুলোকে নিজের মতো করে অনুধাবন কিংবা প্রয়োগ করতে পারে না। নিজের অনুভূতি প্রকাশের ভাষা খুঁজে পায় না। কেবল শেখানো বুলি আওড়াতে থাকে।

আপনার সন্তানকে নিকটস্থ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি করলে কী হতো? ওই বিদ্যালয়ে আপনার অংশগ্রহণ নিশ্চিত হতো। আপনার সন্তান তার পরিচিত পরিবেশ ও বিচিত্র পারিবারিক পরিমণ্ডলে বেড়ে ওঠা একদল সহপাঠীর সান্নিধ্য পেতো, যেটা তার জন্য স্বাভাবিক ও স্বাস্থ্যকর। আপনার মতো অভিভাবক এবং প্রশিক্ষিত শিক্ষকের নিবিড় সহায়তায় আপনার সন্তান এক পরিকল্পিত ও আনন্দময় শিখন পরিবেশ পেত। আপনার সন্তান শেকড়ের স্বাদ পেত। নানা বৈচিত্র্যের মধ্যে নিজের অস্তিত্বের উপলব্ধি পেত। নিজস্ব সংস্কৃতির সঙ্গে তার পরিচয় হতো। মাটি ও মানুষের সঙ্গে, প্রকৃতির সঙ্গে সে নিজেকে একাত্ম করে নিতে পারত। এর সবই শিশুর স্বাভাবিক বিকাশে অত্যন্ত জরুরি।

কিন্তু আপনার হাতের নাগালে থাকা এই সুযোগকে আপনি চোখ মেলে দেখেননি হয়ত। অথবা কোনোরকম দায় নিতে চাননি। প্রতিটি লোকালয়ে নিজেদের সন্তানের শিক্ষার ব্যবস্থা করার জন্য এক সময় সামাজিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে ওঠা এই প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলো আজ সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় আরও সমৃদ্ধি অর্জন করলেও আপনার-আমার মতো অভিভাবকদের অবজ্ঞার শিকার হয়ে কেমন বিবর্ণ। আমাদের করের টাকায় গড়ে ওঠা এমন একটি পরিকল্পিত রাষ্ট্রীয় প্রাথমিক শিক্ষা ব্যবস্থাকে অবজ্ঞায় পাশে ফেলে রেখে নিজের সন্তানের জন্য উচ্চমূল্যে নিম্নমানের শিক্ষা সেবা ক্রয় আমাদের অপরিণামদর্শিতারই নামান্তর।

জগজ্জীবন বিশ্বাস; শিক্ষাকর্মী

[email protected]

(দ্য ডেইলি স্টারের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির আইনগত, মতামত বা বিশ্লেষণের দায়ভার সম্পূর্ণরূপে লেখকের, দ্য ডেইলি স্টার কর্তৃপক্ষের নয়। লেখকের নিজস্ব মতামতের কোনো প্রকার দায়ভার দ্য ডেইলি স্টার নেবে না।)

Comments

The Daily Star  | English

Govt calls for patience as it discusses AL ban with parties

Taken the initiative to introduce necessary amendments to the ICT Act, says govt

1h ago