জঙ্গিদের আটকে রাখার সফল প্রয়াস নেই
গুলশান ট্র্যাজেডির পর বিভিন্ন গণমাধ্যমে যে ১০ নিখোজ যুবকের ছবি দিয়ে বলা হচ্ছে তাদের সন্ধান চায় পরিবার, তাদেরই একজন জুনুন শিকদার। ২০১৩ সালের ২৫ আগস্ট জঙ্গি সংশ্লিষ্টতার অভিযোগে গোয়েন্দারা জুনুনকে গ্রেফতার করেছিল। গোয়েন্দা কার্য্যালয়ে জুনুন সংবাদমাধ্যমকে জানিয়েছিলেন, তিনি শরিয়াভত্তিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে আল-কায়েদার অনুরূপ নীতি ও আদর্শে বিশ্বাস করেন এবং সশস্ত্র জিহাদেও অংশ নিতে চান। জুনুন বলেছিলেন, ইচ্ছা ছিল পাকিস্তান, আফগানিস্তান ও সিরিয়া যাবার। জেল থেকে মুক্তি পেলে তিনি ইচ্ছা পূরণ করবেন বলেও জানিয়েছিলেন। ২০১৪ সালের শেষের দিকে তিনি জামিনে মুক্তি পান। দেশের সবকটি গোয়েন্দা সংস্থা এখন তাকে আবারো খুজছে।
পুলিশ, আইনজীবি এবং ঢাকা চিফ মেট্রোপলিটন মেজিস্ট্রট কোর্ট সূত্র জানায়, জুনুনের মত পাঁচ শতাধিক জঙ্গি গত কয়েক বছরে জামিনে বের হয়ে গেছে। সংবাদপত্রের পাতা উল্টালেই দেখা যায় জামিনে মুক্ত হওয়ার সংবাদ প্রায়ই ছাপা হচ্ছে। বেশকিছুদিন আগে একটি টেলিভিশন টকশোতে স্বরাস্ট্রমন্ত্রীকে জিজ্ঞেস করেছিলাম পুলিশ যে এত জঙ্গি ধরলো তাদের এক তৃতীয়াংশতো জামিনে ছাড়া পেয়ে গেল, এ নিয়ে সরকারের করণীয় কী? তিনি জবাব দিলেন আইনমন্ত্রীকে প্রশ্নটি করুন।
আইনমন্ত্রী ১০ জুলাই সাংবাদিকদের ওইরকম প্রশ্নের মুখোমুখি হয়েছিলেন। জবাবে তিনি দেশের আইন শৃঙ্খলা রক্ষায় বিচার বিভাগের ‘দায়িত্বের কথা মনে রেখে’ জঙ্গিদের জামিন দেওয়ার ক্ষেত্রে ‘কঠোর’ হতে বিচারকদের প্রতি আহ্বান জানান।
বিচারকরা কোন আইনে আইনমন্ত্রীর ওই আহবান শুনবেন? সংসদে দাঁড়িয়ে প্রধানমন্ত্রী স্বয়ং ওই একই আহ্নান জানিয়েছিলেন। গত বছর ১১ নভেম্বর প্রধানমন্ত্রী সংসদ অধিবেশনে তার নির্ধারিত প্রশ্নোত্তর পর্বে জঙ্গিরা যাতে দ্রুত জামিন না পায়, সে বিষয়ে সচেতন থাকার জন্য বিচারকদের প্রতি তিনি আহ্বান জানান।
তিনি আরো স্পস্ট করেই বলেন, অনেক সময় গোয়েন্দা পুলিশ মাসের পর মাস পরিশ্রম করে, অনেক টাকা খরচ করে জঙ্গিদের গ্রেপ্তার করে। ছয় মাস, এক বছর চেষ্টা করে তাদের গ্রেপ্তার করা হলো। তারপর দেখা গেল, ১৫ দিনের মধ্যে জামিন পেয়ে তারা বেরিয়ে যাচ্ছে। এদের সাজা নিশ্চিত করার ব্যাপারে বিচারকেরা যদি মনোযোগী হন, তাহলে দেশকে অনেক ক্রাইমের হাত থেকে বাঁচারকারনো যায়।
দেখা যাচ্ছে সরকারের কারো কথায়ই কোন কাজ হচ্ছে না। জঙ্গিরা একের পর এক জামিন পাচ্ছে আবার নতুন করে একই অপরাধ করছে। তাহলে ফাঁকটা কোথায়? এই প্রশ্নের জবাবও মিলছে না। একজন উচ্চপদস্থ পুলিশ কর্মকর্তা প্রশ্ন করেন, আইনমন্ত্রী আর প্রধানমন্ত্রীর আহ্বানের মাঝের সময়ে শতাধিক জঙ্গি যে জামিনে বের হয়ে সারাদেশে চাপাতির কোপের উৎসব করছে এর দায় কে নিবে?
বিভিন্ন সময় দেখা গেছে বিষয়টি নিয়ে পুলিশ দোষ দেয় সরকারপক্ষের কৌসুলীদের, কৌসুলিরা দোষ দেয় পুলিশকে, আর বিচারকরা দোষেন সরকারপক্ষের আইনজীবী ও পুলিশ উভয়কে। এই দোষাদোষীর মধ্যেই চলছে গত কয়েকবছর। তারা যেসব কথা এত বছর ধরে বলে আসছেন যেমন সঠিক তদন্ত না হওয়া, মামলার আইনি প্রক্রিয়ায় ভুল থাকা এবং বিলম্বিত বিচারপ্রক্রিয়া এর কোন কারণটি আমাদের জানা নেই? সমস্যা যখন সবাই জানে তবে সমাধান হচ্ছে না কেন?
স্বরাস্ট্র মন্ত্রনালয় থেকে তিন বছর আগেই বলা হয়েছিল একজন যুগ্মসচিবের নেতৃত্বে একটি কমিটি গঠন করা হবে, যে কমিটি দুর্ধর্ষ সন্ত্রাসী ও জঙ্গিদের জামিনের বিষয়টি মনিটর করবে। সেই কমিটি গঠনের কোন উদ্যোগও নেই। কয়েকটি জামিনের ঘটনার উদাহরণ দিলেই বোঝা যাবে জঙ্গিদের জামিন প্রতিরোধের বিষয়টি কতোটা গুরুতর। যেমন: ২০০৫ সালে সারা দেশে একযোগে বোমা হামলার ঘটনায় চট্টগ্রামে গ্রেপ্তার হয়েছিলেন নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠন জামাআতুল মুজাহিদীন বাংলাদেশের (জেএমবি) নেতা তরিকুল ইসলাম। ২০১৩ সালে জামিনে ছাড়া পান তিনি। এরপর ২০১৪ সালের ৫ অক্টোবর রাজধানীর বাড্ডায় পিডিবির সাবেক চেয়ারম্যান ও কথিত পীর খিজির খানকে গলা কেটে হত্যার অভিযোগে আবার গ্রেপ্তার হন তরিকুল। গত ২৫ অক্টোবর আদালতে দেওয়া স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে তিনি নিজ হাতে খিজির খানের গলা কাটার কথা স্বীকার করেন।
২০১৩ সালের ১৪ জানুয়ারি উত্তরায় চাপাতি দিয়ে ব্লগার আসিফ মহিউদ্দীনকে হত্যার চেস্টা করা হয়। আসিফকে হত্যাচেষ্টা মামলায় ওই বছরের ২৬ জানুয়ারি গ্রেপ্তার হন আনসারউল্লা বাংলা টিমের সাদ আল নাহিন, কামাল হোসেন সর্দার, কাওছার হোসেন ও কামাল উদ্দিন নামে চারজন। চার আসামিই আসিফ মহিউদ্দীনকে কুপিয়ে আহত করার দায় স্বীকার করে আদালতে জবানবন্দিও দেন। এরপরেও ২০১৩ সালের ২৮ জুলাই নাহিনকে জামিন দেয় আদালত। নাহিনের জামিনদার ছিলেন তাঁর চাচা শ্রম প্রতিমন্ত্রী মুজিবুল হক। কিছুদিনের মধ্য অপর তিনজনও জামিন পান। গত ৭ আগস্ট খিলগাঁও পূর্ব গোড়ানের ভাড়া বাসায় ব্লগার নীলাদ্রি চ্যাটার্জি ওরফে নিলয়কে হত্যা করে এবিটির সদস্যরা। এ ঘটনায় করা মামলায় সাদ আল নাহিন, কাওসার ও কামাল হোসেন সরদারকে আবারও গ্রেপ্তার করে গোয়েন্দারা।
ব্লগার ওয়াশিকুর রহমান (বাবু)কে গত বছর ৩০ মার্চ রাজধানী দক্ষিণ বেগুনবাড়ীতে রাস্তার ওপর কুপিয়ে হত্যা করা হয়। ঘটনাস্থল থেকে হিজড়াদের সহযোগিতায় পুলিশ জিকরুল্লাহ ও মো. আরিফুল ইসলাম নামে দুজনকে গ্রেপ্তার করে। তাঁদের মধ্যে আরিফুল ইসলাম নরসিংদী জেলার রায়পুরা থানার সন্ত্রাসবিরোধী আইনের একটি মামলায় ২০১২ সালে গ্রেপ্তার হয়েছিলেন। তিনি জামিনে বের হয়ে আবারও জঙ্গি কার্যক্রমে জড়িয়ে পড়েন।
২০১৩ সালের ২১ ডিসেম্বর রাজধানীর গোপীবাগে এক কথিত পীরের বাসায় ঢুকে ছয়জনকে হত্যা করা হয়। ওই মামলায় ২০১৪ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর পুলিশের ভাষায় জেএমবির সেকেন্ড ইন কমাণ্ড গোলাম সারওয়ার ও মো. আজমীর নামে দুজনকে গ্রেপ্তার করে গোয়েন্দারা। এরপর চলতি বছরের ২৬ এপ্রিল আজমীর এবং ১৪ জুন সেকেন্ড-ইন-কমান্ড গোলাম সারওয়ার হাইকোর্ট থেকে জামিন পেয়েছেন।
আইএসএর সদস্য ও অর্থ জোগানদাতা সন্দেহে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল কাজী সাইফুদ্দিন ইয়াহিয়াকে। উত্তরা এলাকা থেকে গ্রেপ্তার এই আসামির বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ থাকা সত্ত্বেও গত ১৬ জানুয়ারি আদালত তাঁকে জামিন দেয়। ২০১৪ সালে আইএস সংশ্লিষ্টতার অভিযোগে আটক ব্রিটিশ নাগরিক সামিউন রহমান ইবনে হামদান, সাবেক বিচারপতির ছেলে আসিফ আদনান ও সাবেক যুগ্ম সচিবের ছেলে ফজলে এলাহী হাইকোর্ট থেকে জামিন পান।
এছাড়া নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠন হিযবুত তাহ্রীরের প্রধান সমন্বয়ক মহিউদ্দিন আহমেদ ও জ্যেষ্ঠ উপদেষ্টা গোলাম মাওলাসহ প্রায় সবাই জামিনে রয়েছেন।
দেখা যাচ্ছে বিচার আদালত ও উচ্চ আদালত সব জায়গা থেকেই জঙ্গিরা জামিনে বের হচ্ছেন। জামিন পাওয়া যেকোন নাগরিকের মৌলিক অধিকার বটে। তাই বলে একই অপরাধী জামিন পেয়ে যখন আবারো একই অপরাধ ঘটাচ্ছেন তখন বিকল্প কিছু ভাবা যেতেই পারে। প্রয়োজনে নতুন আইনও করা যেতে পারে। যদিও বিশেষ ট্রাইব্যুনালের কথা উড়িয়ে দিয়েছেন আইনমন্ত্রী। তারপরেও বিশেষ কোন উদ্যোগ নিতেই হবে। তবে আর দেরি না করে মামলাগুলোর তদন্তে গতি আনা, তদন্তকারীদের দক্ষতা বাড়ানো, বিচার আদালত থেকে উচ্চ আদালত পর্যন্ত পুলিশ ও প্রসিকিউশনের কাজে ‘সমন্বয় বাড়ানোও জরুরী। নয়তো পুলিশ একদিকে ধরবে আদালত থেকে আরেকদিকে বের হয়ে যাবার ইদুর বিড়াল খেলা চলবেই।
Comments