ট্যাক্স দেওয়া সঞ্চয়ের ওপর আবগারি শুল্ক অনৈতিক

দেশের অর্থনীতি যত বড় হচ্ছে, সরকার তার আয় বাড়ানোর জন্য বিভিন্ন পথ বিভিন্ন সময় সৃষ্টি করছে। তবে এর মধ্যে সরকার অদ্ভুত কিছু পদক্ষেপ নিয়েছে তার আয় বাড়ানোর জন্য। এর একটি হচ্ছে ব্যাংকে আমাদের সঞ্চয়ী হিসাবে জমানো টাকার ওপর আবগারি শুল্ক। এটা এতদিন নীরবে সরকার চালিয়ে যাচ্ছিলো। আপনার যদি এক লক্ষ টাকার ওপর জমা থাকে, এতদিন এখান থেকে সরকার নীরবে ৫০০ টাকা করে কাটতো; এবারের বাজেট অনুযায়ী এক লক্ষ টাকার ওপর সরকার ৮০০ টাকা আবগারি শুল্ক কাটবে।

এর মানে হচ্ছে, আপনি যদি এক লক্ষ টাকা ব্যাংকে রাখেন-- প্রতি তিন মাস অন্তর আপনি যদি সর্বোচ্চ পাঁচ শতাংশ সুদ পান; আপনি ১২৫০ টাকা পাওয়ার কথা। কিন্তু সরকার এর থেকে আবগারি শুল্ক কেটে নেওয়ার পর আপনার কাছে আসবে ৪৫০ টাকা; সেই টাকা থেকে আবার আয়কর কাটবে ১৮৭ টাকা আর ব্যাংক কাটবে ৩০০ টাকা সার্ভিস চার্জ। অর্থাৎ তিন মাস পর, আসলে আপনি আপনার জমানো টাকা থেকে সরকার এবং ব্যাংকে আরো ৩৭ টাকা দিবেন।

বিষয়টা কতটুকু যুক্তিসঙ্গত, কতটুকু আইনসংগত এবং কতটুকু নৈতিক-- এটা নিয়ে এর আগে কখনো বিতর্ক হয়নি।

আবগারি শুল্ক বা Excise Duty আসলে কি? এটা এক ধরণের শুল্ক যেটা কোনো কিছু উৎপাদনের ওপর কিংবা উৎপাদিত পণ্য বিক্রয়ের ওপর নির্ধারিত হয়; কিংবা কোনো কোম্পানির আয়ের ওপর নির্ধারিত ট্যাক্স; কিংবা কোনো পেশার কার্যক্রমের ওপর নির্ধারিত লাইসেন্স ফি হিসেবে নির্ধারিত হয়।

আবগারি শুল্ক কেন জমানো টাকার ওপর নির্ধারিত হবে?

আমি সরকারকে আয়কর দিয়েছি; তারপর অল্প করে কিছু টাকা জমাচ্ছি। আমি সরকারি চাকুরে না। যখন চাকরি থেকে অবসর নেবো-- তখন কেউ আমাকে পেনশন দেবে না। আমি আমার জমানো টাকায় চলবো। আমার জমানো টাকা আয়কর দেওয়ার পর হয়েছে। এখানে আবগারি শুল্কের বিষয় আসে কিভাবে? এটা কি নৈতিক না আইনসিদ্ধ? এক টাকার ওপর দুবার কিভাবে সরকার ট্যাক্স নেয়?

এই বিষয়টা নিয়ে যদি মামলা হয়-- সরকার কি সেই মামলায় জিততে পারবে? কী যুক্তিতে?

সরকারের টাকার দরকার দেশ চালানোর জন্য; এইজন্য সরকার অনেক ক্ষমতার অধিকারী। সরকার সেই ক্ষমতা দিয়ে যারা ব্যাংক ঋণের নামে হাজার হাজার কোটি টাকা লুট করেছে তাদের এ পর্যন্ত কী শাস্তি দিয়েছে? তাদের থেকে টাকা আদায়ে কী পদক্ষেপ নিয়েছে?

গ্লোবাল ফিনান্সিয়াল ইন্টিগ্রিটি নামক একটি গবেষণা সংস্থা কিছুদিন আগে রিপোর্ট করেছে যে বাংলাদেশ থেকে ২০০৫ থেকে ২০১৫র মধ্যে ৬৩ বিলিয়ন ডলার বিদেশে পাচার হয়েছে।

কিভাবে এতো টাকা পাচার হয়ে গেলো? কে পাচার করলো? তাদের ব্যাপারে সরকার কী করলো? কিছুই না।

বড় বড় পাচারকারী কিংবা ব্যাংক লুটেরাদের নিয়ে সরকারের মাথাব্যথা নেই; মাথাব্যথা হচ্ছে ছোটোখাটো খেটে খাওয়া মানুষ-- যাদের সহজে ধরা যায়; মাথাব্যথা হচ্ছে অবসরে যাওয়া মানুষ-- যার একমাত্র জীবন ধারণের উপায় ব্যাংকে গচ্ছিত টাকা; মাথাব্যথা বুড়ো মাকে নিয়ে-- কারণ উনি কী বা করবেন সরকারের বিরুদ্ধে।

মানুষ ব্যাংকে টাকা রাখতো দুই কারণে: নিরাপত্তা আর সুদ। প্রতি বছর মুদ্রাস্ফীতির কারণে টাকার মূল্য কমে। ব্যাংকের সুদ আমাদের জমানো টাকার অবমূল্যায়নকে অনেকটাই ঠেকাত। কিন্তু সেটা এখন ইতিহাস; কারণ বর্তমানে জমানো টাকার ওপর সুদ পাঁচ শতাংশের নিচে; কোথাও কোথাও দুই শতাংশ সুদ দেয়। কিন্তু মুদ্রাস্ফীতির হার পাঁচ শতাংশের থেকে বেশি।

আমরা এখন অনেকেই সরকারকে ট্যাক্স দেই; তবে দেশের জনসংখ্যার তুলনায় ট্যাক্স দেওয়া মানুষের সংখ্যা কম-- মাত্র ৮ থেকে ৯ লক্ষ লোক ট্যাক্স দেয়। ট্যাক্স না দিলে সরকার দেশের উন্নয়ন করবে কি করে? দেশে নিশ্চয় ৮-৯ লক্ষ থেকে বেশি মানুষ ট্যাক্স দেওয়ার ক্ষমতা রাখে; আর এই লোকগুলোকে খুঁজে বের করার দায়িত্ব সরকারেরই। সেই দায়িত্ব পালন না করে যারা ট্যাক্স দেয়, যারা বিভিন্ন ভাবে সরকারকে ভ্যাট দেয়-- তাদের শাস্তি দেওয়া সরকারের কাজ না।

এসব পদক্ষেপের বদলে সরকার যদি দুর্নীতি আর টাকা পাচার থামাতে পারে-- কিংবা কমাতে পারে, প্রকল্প ব্যয় যুক্তিসঙ্গত করতে পারে-- সরকারের আয় এমনি বেড়ে যাবে!

Comments

The Daily Star  | English

Govt decides to ban activities of AL until completion of ICT trial

Law Adviser Prof Asif Nazrul said this at a press briefing after a special meeting of the advisory council tonight

2h ago