শাহপরীর দ্বীপ: যেখানে এসে মিশেছে সাগর, নদী, পাহাড়, জঙ্গল

শাহপরীর দ্বীপ, বাংলাদেশের একেবারের দক্ষিণ সীমান্তের নাম। এরপর আর কিছু নেই, শুধু বিস্তৃত জলরাশি। চারপাশে বঙ্গোপসাগরের উত্তাল ঢেউ। অনেক দূরে চোখ রাখলে দেখা যাবে জেলেদের নৌকা সাগরে মাছ ধরছে। আর কোথাও কিছু নেই, কেউ নেই। ঠিক যেন ভূপেন হাজারিকার গানের মত “মেঘ থম থম করে, কেউ নেই, কিছু নেই” । আমরা যখন শাহপরীর দ্বীপের কাঠের লম্বা সাঁকোটার উপর দাঁড়িয়ে ছিলাম, তখন বারবার ঘুরেফিরে এই গানটির কথাগুলোই মনের ভেতর অনুরণিত হচ্ছিল।

অনেকটা সময় ওখানে থেকে আমরা গল্প করলাম। গায়ে মাখলাম সাগরের নোনা জল। অবশ্য আমরা থাকতে থাকতেই চারিদিক কালো হয়ে এলো, শুরু হল হালকা ঝড়ো বাতাস। আকাশ ভেঙে বৃষ্টি নামার আগেই আমরা ছুট লাগালাম নেটং এর দিকে। একবার ভাবলাম এখানে বসেই সাগরের বর্ষা উপভোগ করি। পরে সেই আইডিয়া বাদ দিলাম। এর চেয়ে ঢের বেশি আরামের হবে নাফ নদীর পাশে বাংলোতে বসে বৃষ্টি দেখা।

নেটং টেকনাফের একটি জায়গা, যেখানে আছে বনবিভাগের ডাকবাংলো, পর্যটন মোটেল এবং সড়ক ও জনপথ বিভাগের বাংলো। আমাদের দলটি বড় ছিল বলে ভাগ করে থাকতে হয়েছিল। এখানেই আছে সেন্টমার্টিনে যাওয়ার ফেরিঘাট। অনেকে কক্সবাজার থেকে এসে বা ঢাকা থেকে সরাসরি বাসে করে এসে এখান থেকে সেন্টমার্টিন যান। কিন্তু একবার পরিকল্পনা করে এসে নেটংয়ে দু-এক রাত কাটিয়ে যেতে পারেন। আগে থেকে ব্যবস্থা করে এলে দু’তিনটি বাংলোর যেকোনোটাতেই থাকা যায়, সবগুলোই সুন্দর লোকেশনে। সবগুলো বাংলোই নাফ নদীর পাড়ে। পেছনে জঙ্গলে ঘেরা পাহাড়, সামনে নদী। আর একটু আঁকাবাঁকা পাহাড়ি পথ বেয়ে এগুলেই দেখা যাবে সামনে সমুদ্র।

শাহপরীর দ্বীপ থেকে ফেরার পথে নেমে যেতে পারেন টেকনাফ বাজারে। ওই এলাকায় আমরা যে কয়দিন ছিলাম প্রতিদিনই গিয়েছি টেকনাফ বাজারে। বাজারটি খুব ইন্টারেস্টিং, কারণ অনেক ধরনের পসরা আছে সেখানে। টেকনাফ বাজার না বলে ওটাকে ছোটখাটো বার্মিজ মার্কেটও বলা যায়। বার্মিজ পণ্য আসে নাফ নদী দিয়ে। আরও আছে মাছ, মুরগি, শুটকি, সবজী, শাড়ি-কাপড়, বাসন-কোসনসহ নানারকম জিনিস। আমরা প্রায় প্রতিদিনই কিছু না কিছু কিনতাম। শুধু কি এটা-সেটা কেনা, ওই বাজার থেকে বড় দেশি মোরগ বা সাগরের তাজা মাছ কিনে এনে বাংলোর কুককে দিয়ে রান্না করিয়ে নিতে পারলে ব্যাপারটা আরও যে জম্পেশ হবে, সে বিষয়ে আমি নিশ্চিত। একটু উদ্যোগ নিলে দেশি মোরগ রান্না করে ঢাকাতেও নিয়ে আসা যায়। তবে বিস্তর হাঙ্গামা করতে হয়।

টেকনাফ বাজারের সামনেই রয়েছে মাথিনের কূপ। এই কূপকে ঘিরে প্রচলিত আছে মাথিন নামে একটি মেয়ের ভালবাসা ও দুঃখের কাহিনী। অনেকেই আসে এই কূপটি দেখতে।

টেকনাফ সাগর সৈকতটি কক্সবাজার সৈকতের মত তেমন কোলাহলমুখর নয়। মানুষের ভিড় অনেকটাই কম। নানাধরনের, নানারঙের মাছ ধরার নৌকা আছে, জেলেরা মাছ ধরছে, কেউ শুটকি শুকাচ্ছে, কেউ নৌকায় রং লাগাচ্ছে। সেখানেও বেশ কিছু দোকানপাট আছে। বসে খেয়ে নিতে পারেন ডাব বা নারকেল। আছে গরম চা-সিঙ্গারার দোকানও। তবে টেকনাফে নানা ধরনের মানুষ আছে, সাবধানে এদের সাথে চলতে হয়। কেউ কেউ সুযোগ পেলে পর্যটকদের বিপদে ফেলে।

বর্ষা ছাড়াও অন্য সময়ে যাওয়া যায় শাহপরীর দ্বীপ ও টেকনাফে। তবে গরমকালে না যাওয়াই ভালো। শীতে খুব আনন্দ হয়। হালকা ঠান্ডায় খুব আরাম করে চারপাশটা বেড়িয়ে নেওয়া যায়। চাইলে আশেপাশের জঙ্গলেও যাওয়া যায়। আমরা ইচ্ছে করেই বেছে নিয়েছিলাম বর্ষাকালকে। কারণ আমরা চেয়েছিলাম সমুদ্রের পাশে দাঁড়িয়ে আর নাফ নদীর পাশে বসে বৃষ্টি দেখবো, সঙ্গে গরম চা, পিঁয়াজু খেতে খেতে প্রাণ খুলে গল্প করবো। উনুনে রান্না হতে থাকবে খিচুড়ি, হাঁসের মাংস, গরুর ঝোল, বেগুন ভাজি আর মুচমুচে আলুভাজি। দলের অনেকেই দিনের বেলা যে মাছভাজি আর দেশি মোরগের ভুনাটা খেয়েছে সেটা এখনও ভুলতে পারছে না। ব্যাপারটা একবার ভাবুনতো। জিভে জল এসে যাবে।

যারা ঘুরতে ভালবাসেন, যারা নৌকায় করে নদীতে বাতাস খেতে ভালবাসেন, যারা ভালবাসেন পায়ে হেঁটে পাহাড় দেখতে, সমুদ্রে নাইতে, ভালবাসেন কেবলই ঘুমাতে বা বসে গল্প করতে, ভালবাসেন ঘোরাঘুরির ফাঁকে ফাঁকে ছোটখাটো কেনাকাটা করতে, যারা চান মজাদার সব খাবার খেতে—তাদের জন্যই আমার এই লেখা।

নেটং থেকে যেকোনো সময় নৌকা নিয়ে আপনি ঘুরে বেড়াতে পারেন নাফ নদীতে। নাফ নদীর পানির সাথে সাগরের পানির ও স্রোতের অনেক মিল। অনেক বড় বড় নৌকা ও বড় ফেরি চলাচল করে। পাহাড়ের পাশ দিয়ে বয়ে চলা নাফ নদীর পানি খুবই টলটলে। এমনকি এখানে থাকতে থাকতে একদিনের জন্য বেড়িয়ে আসতে পারেন সেন্টমার্টিন থেকেও।

তবে আমরা নেটং-এ থাকতে থাকতেই হঠাৎ খবর পেয়েছিলাম যে চেষ্টা করলে আমরা নাকি বার্মার মংডুতেও যেতে পারবো। ব্যস অমনি সবাই রাজি হয়ে গেল। স্থানীয় সাংবাদিকদের সহায়তায় ৫০০ টাকা দিয়ে একটা অনুমতিপত্র নিয়ে নাফ নদী দিয়ে নৌকা নিয়ে রওনা দিলাম মংডুর দিকে। বাংলাদেশের সবচেয়ে কাছের এলাকা বার্মার এই মংডু। এখান থেকেই বার্মিজ জিনিসপত্র বাংলাদেশের বাজারে আসে। তবে আমরা যাওয়ার অনুমতি পেয়েছিলাম মাত্র ৮ ঘণ্টার জন্য। সকালে ঢুকে সন্ধ্যার মধ্যে ওখান থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। আমরা গুর্খা বাহিনীর চেকআপ শেষ করে মংডুতে ঢুকলাম। সেখানে কোন বাহন নেই। বড় বড় রাস্তাঘাট কিন্তু যানবাহন নেই। আছে কিছু দোকানপাট। সেখানেই আমরা দিনের খাবার খেলাম বার্মিজ রুই মাছ দিয়ে। হেঁটে হেঁটে বিভিন্ন দোকানপাটে ঘুরলাম। সব দোকানই চালাচ্ছে মেয়েরা। এরপর সন্ধ্যার আগেই ফিরে আসতে হল, কারণ মংডুতে সন্ধ্যায় বিদ্যুৎ থাকে না।

এখনও সেই সুযোগটা আছে কিনা আমি জানি না। তবে যদি কেউ নেটং-এ থাকতে যান বা শাহপরীর দ্বীপে যান একবার খোঁজ নিয়ে দেখতেই পারেন, এখনও মংডু ঘুরে আসা যায় কিনা। এক বলে দুই গোল, ব্যাপারটা মন্দ নয়, বরং উত্তেজনাপূর্ণ।

 

(ছবিগুলো লেখকের নিজের তোলা)

Comments

The Daily Star  | English

Govt calls for patience as it discusses AL ban with parties

Taken the initiative to introduce necessary amendments to the ICT Act, says govt

1h ago