এমন গল্প দেখার মানসিকতা আমাদের তৈরি হয়েছে কি?

নয়নতারা (ভাবনা) বাসা থেকে পালিয়ে এসে পুরনো ঢাকার একটা আবাসিক হোটেলে উঠেন। হোটেলের কাজের মানুষ মুকু (পরমব্রত চট্টোপাধ্যায়) তাঁর দেখাশোনা করেন। ধীরে ধীরে তাঁদের মধ্যে একটি নির্ভরতা তৈরি হয়। হোটেলে একজন মাস্তান নয়নতারার সঙ্গে খারাপ আচরণ করতে চাইলে সেখান থেকে বাঁচিয়ে মুকু তাঁকে একটি বস্তিতে নিয়ে আসেন।
Bhayankar Sundar
“ভয়ংকর সুন্দর” চলচ্চিত্রের একটি দৃশ্য। ছবি: সংগৃহীত

চলচ্চিত্র: ভয়ংকর সুন্দর

পরিচালনা: অনিমেষ আইচ

অভিনয়: আশনা হাবিব ভাবনা, পরমব্রত চট্টোপাধ্যায়, খাইরুল আলম সবুজ, ফারুক আহমেদ, দিহান

আবহ সংগীত: ইমন সাহা

গল্প: নয়নতারা (ভাবনা) বাসা থেকে পালিয়ে এসে পুরনো ঢাকার একটা আবাসিক হোটেলে উঠেন। হোটেলের কাজের মানুষ মুকু (পরমব্রত চট্টোপাধ্যায়) তাঁর দেখাশোনা করেন। ধীরে ধীরে তাঁদের মধ্যে একটি নির্ভরতা তৈরি হয়। হোটেলে একজন মাস্তান নয়নতারার সঙ্গে খারাপ আচরণ করতে চাইলে সেখান থেকে বাঁচিয়ে মুকু তাঁকে একটি বস্তিতে নিয়ে আসেন।

দুজনের এই নির্ভরতা এক সময় বিয়েতে গড়ায়। বস্তিতে দুজন বাসা নেন। হঠাৎ করে দুদিন পানি সরবরাহ বন্ধ থাকে। পানির জন্য হাহাকার তৈরি হয়। নয়নতারা একটু পানি খাওয়ার জন্য বস্তির অনেকের কাছে অনুরোধ করেন। কেউই পানি দেয় না তাঁকে। পাশের বস্তিতে পানি নিতে গেলে ঝগড়া হয়। বেদম মার খান নয়নতারা। ভেতরে ভেতরে প্রচণ্ড জেদি হয়ে উঠে তিনি। এরপর, নিজে থেকেই পানি জমাতে থাকেন। কিছুদিন পর আবার পানির সংকট হয়। এবার সেখানকার অনেকেই পানি নিতে আসে। সবাইকে ফিরিয়ে দেন নয়নতারা; প্রতিশোধ পরায়ণ হয়ে উঠেন তিনি। সব মিলিয়ে একটি মৌলিক গল্পের সিনেমা “ভয়ংকর সুন্দর”।

বিষয়বস্তু হিসেবে নতুনত্ব ছড়িয়ে রয়েছে সিনেমাটির গল্পের পরতে পরতে। সাহিত্যিক মতি নন্দীর “বকবক শব্দ” ও “জলের ঘূর্ণি” গল্পের মিশেলে সমসাময়িক সময়ের পটভূমিতে কাহিনীর বুনন পেয়েছে “ভয়ংকর সুন্দর”।

আখতারুজ্জামান ইলিয়াস, হাসান আজিজুল হক, শহীদুল জহিরের গল্প যেমন সব শ্রেণির পাঠকের মননের গভীরে প্রবেশ করে না বা সবাইকে ছুঁতে পারে না, তেমনি এ ছবির গল্পের বিষয়েও এমন কিছু একটি হতে পারে। এমন ছবির গল্প দেখার মতো মানসিকতা কি আমাদের তৈরি হয়েছে? এর কারণ আমরা তো এখনো সস্তা বিনোদন খুঁজি। তামিল-হিন্দি ছবির কপি সিনেমা না দেখলে আমাদের ভালো লাগেনা। না লাগারই কথা। কারণ তামিল-হিন্দির কপিটিই আমাদের অনেকের কাছে মৌলিক হয়ে গেছে।

“ভয়ংকর সুন্দর” ছবির কাহিনীতে ঢাকা শহরের এক অংশের প্রতিদিনের জীবনচিত্র উঠে এসেছে। খুব সহজেই এ গল্পের কাছাকাছি চলে যাওয়া যায়। যাদের অহেতুক গল্প, চরিত্র, অযথা মারামারি ও আইটেম গান দেখার অভ্যেস তাঁদের কাছে হয়তো ভালো লাগবেনা।

প্রথমেই নয়নতারা চরিত্রের ভাবনাকে নিয়ে কিছু বলা প্রয়োজন। আহা! নয়নতারা – ফুলের নামে নাম। তিনি একটি অজানা সুবাস ছড়িয়ে দিয়েছেন চারদিকে। প্রথম দৃশ্য থেকে শেষ পর্যন্ত মন খুলে অভিনয় করেছেন তিনি। গল্পের চরিত্র হয়ে উঠেছেন কী সহজে, অনায়াসে, অবলীলায়। কে বলবে এটি তাঁর প্রথম ছবি। এমন সাবলীল-সহজ উপস্থিতি চোখ জুড়িয়ে দেয়, সঙ্গে প্রাণটাও।

নিজের ভেতর থেকে বেরিয়ে কখন যে নয়নতারা হয়ে উঠেছেন সেটি তিনি নিজেও জানেন না। পানির অভাবে সবাই বিপর্যস্ত, পানি আনতে গিয়ে মার খাওয়া ও এক গ্লাস পানির জন্য হাহাকার – এসব দৃশ্য মনের ভেতর দাগ কেটে থাকে। প্রথম ছবিতে এমন সাবলীল অভিনয়, আশা করি, ভাবনাকে অনেক দূর পথের ঠিকানার খোঁজ দেবে।

পরমব্রত চট্টোপাধ্যায় মুকু চরিত্র হয়ে ওঠার আপ্রাণ চেষ্টা করেছেন। গল্পের চরিত্র বনে যাওয়া খুব কঠিন তা কিছুটা টের পেয়েছেন তিনি। অভিনয়ে কিছুটা কমতি ছিলো তবে উতরে যাওয়ার একটি প্রচেষ্টা ছিলো তাঁর মধ্যে।

দিহানের চরিত্রটি বেশ ছোটই বলা যায় কিন্তু যতক্ষণ পর্দায় ছিলেন জ্বলজ্বল করছিলেন অভিনয়ের দ্যুতিতে। খাইরুল আলম সবুজকে বেশ মানানসই লেগেছে রিকশাওয়ালার চরিত্রে।

পুরো সিনেমার কথা বাদ দেওয়া যাক। ভাবনার মার খাওয়ার দৃশ্যেও স্বপ্নের বিভিন্ন মিশেল অনিমেষ আইচ ছাড়া কারো পক্ষে সেলুলয়েডে তুলে ধরা সম্ভব ছিলো কী? সেলুলয়েডে গল্প বলাতে তিনি দক্ষ হয়ে উঠছেন। পরিচালক নিজে যেটা বিশ্বাস করেন সেটিই পর্দায় তুলে ধরেছেন। নিজের প্রতি সৎ থাকার চেষ্টা করেছেন। চিরচেনা গল্প ছেড়ে কিছুটা অচেনা গল্পের রাস্তায় হেঁটে যেতে পছন্দ করেন অনিমেষ। গল্পের চরিত্রদের কাছ থেকে অভিনয় আদায় করতে জুড়ি নেই তাঁর। এটি বোঝা গেছে যে নায়ক-নায়িকা নয়, তিনি গল্পের চরিত্র উপস্থাপন করেন পর্দায়। এমন একটি গল্প এতো সহজে পর্দায় তুলে আনার জন্য তাঁকে অনেক ধন্যবাদ।

আবহসংগীত ছবির একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় – এটি অনেকেই হয়তো অনুভব করেন না। অনেক কিছুর আভাস দেয় আবহসংগীত। “ভয়ংকর সুন্দর” ছবির আবহসংগীত দিয়ে ইমন সাহা ছুঁয়ে গেছেন দর্শকদের। প্রিন্স মাহমুদের সুরে মমতাজের কণ্ঠে “ছেড়ে এলাম ঘর” গানটি একটি হাহাকার তৈরি করে বুকের ভেতর। খায়ের খন্দকারের সিনেমাটোগ্রাফির মধ্যে একটি জাদু রয়েছে। পুরনো ঢাকা, রাতের নদী, স্টিমার! – অনেক চমৎকার লেগেছে দৃশ্যগুলো।

ছবি দেখা শেষে হল থেকে বের হতে হতে দর্শকদের একটুখানি ভাবাবেই। কিছু চরিত্র ঢুকে যাবে নিজের মধ্যে। নিজের মনের ভেতর কিছু গল্প রচিত হবে। কেননা, ছোট গল্পের একটি আবহ রয়েছে “ভয়ংকর সুন্দর” ছবিটির গল্পের মধ্যে। সেইটি মন্দ লাগেনি। নতুন একটি স্বাদের সন্ধান পাওয়া গেছে এতে।

Comments

The Daily Star  | English

The story of Gaza genocide survivor in Bangladesh

In this exclusive interview with The Daily Star, Kamel provides a painful firsthand account of 170 days of carnage.

1d ago