ধর্ষণের শিকার নারী ও শিশুর চরিত্র নিয়ে কোনো প্রশ্ন নয়

rape
স্টার অনলাইন গ্রাফিক্স

বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া একজন ছেলে যখন তার ফেসবুক স্ট্যাটাসে বুক ফুলিয়ে লিখতে পারে, “একটা ছেলের পক্ষে একা একটা মেয়েকে ধর্ষণ করা সম্ভব নয় যদি না মেয়েটির ক্ষেত্রে সেক্সুয়াল আপিল কাজ না করে”, তখন বুঝতে হবে এই সমাজ কীভাবে পেছনে হাঁটছে। এর চাইতেও দুঃখজনক ব্যাপার হল, যে ছেলেটি এই কুৎসিত স্ট্যাটাসটি দিয়েছে, তার আর আমার মিউচুয়াল ফ্রেন্ড সংখ্যা নয় জন। কারো কারো সাথে তার এই মিউচুয়াল ফ্রেন্ডের সংখ্যা ৬০/৭০ জন।

এর মানে এই স্ট্যাটাসটি যে অসভ্য ছেলেটি দিয়েছে, সে আমাদের কারো না কারো বন্ধু। এই বন্ধুদের তালিকায় লেখক, কবি, সাংবাদিক, নাট্যকার, শিক্ষক, চিকিৎসক, পিএইচডি ডিগ্রিধারী সবাই আছেন। ব্যাপারটা ভেবেই আমার গা-হাত-পা শিউরে উঠলো। আমি বেশ বুঝতে পারলাম শুধু সমাজের চিহ্নিত কিছু অসুর ধর্ষণের মত জঘন্য এই অপরাধটি ঘটাচ্ছে না, আমাদের পরিচিত, শিক্ষিত ছেলেরাও এই কাজ করছে বা এই কাজকে সমর্থন করছে অবলীলায়।

আরও অবাক করা ব্যাপার হল—ধর্ষণ, গণধর্ষণ ও মেয়েদের নিয়ে অসংখ্য অশ্লীল কমেন্ট করেছে তারই বন্ধুরা। যেমন “চল দোস্ত একটা দল গঠন করি, যেন ভালোভাবে ধর্ষণ করা যায়,” এই টাইপের মন্তব্য করেছে তারা। যদিও এখন সে ফেসবুক থেকে সরে আছে চেহারা লুকানোর জন্য।

সেদিন একজন বলছিল ফেসবুকটা কিন্তু আসলেই মনের আয়না। যদিও মানুষ অনেককিছু রেখে ঢেকে এখানে স্ট্যাটাস দেয় বা কমেন্ট করে। অথবা চেষ্টা করে নিজের ভাল দিকটি ফুটিয়ে তুলতে বা সুন্দর কিছু তুলে ধরতে। কিন্তু এর পুরোটা সবসময় গোপন করা যায় না। কোনো না কোনো ঘটনায় ব্যক্তির প্রকৃত চেহারাটি প্রকাশ হয়ে পড়ে। ঠিক যেমনটি হয়েছে “সেক্সুাল আপিল” কাজ করা ওই শয়তানটার ক্ষেত্রে।

কিছুদিন আগে বনানীতে যখন দুটি মেয়ে তাদের ছেলে বন্ধুদের দ্বারা ধর্ষিত হল, তখন অনেকেই দায়ী করেছে মেয়ে দুটিকে। বলেছে, এরা কোন পরিবারের মেয়ে, যে, বন্ধুদের সাথে রাতে হোটেলে আসে জন্মদিন করতে? আমি যদি ধরেও নেই মেয়ে দুটির দোষ যে তারা রাত-বিরাতে হোটেলে এসেছিল, তাই তাদের এই নির্যাতনের শিকার হতে হয়েছিল। তাহলে বাসে করে বাড়ি ফেরার পথে বাসের কন্ডাকটার, ড্রাইভার যে মেয়েটিকে ধর্ষণের পর হত্যা করে ঘাড় মটকে মধুপুরের জঙ্গলে ফেলে দিলো, তার দায় কার? কেন দুই বা চার বছরের মেয়ে ধর্ষণের শিকার হচ্ছে বারবার। তাদের ক্ষেত্রেও কি “সেক্সুয়াল আপিল কাজ ” করে?

আমরা সবসময় বলছি ধর্ষণের পক্ষে কোন কারণ কাজ করবে না, করতে পারে না। এই অপরাধ ও অপরাধীর প্রতি জিরো টলারেন্স দেখাতে হবে। প্রয়োজনে ধর্ষককে নপুংসক করারও দাবি জানানো হচ্ছে। শুধু নারীরা নয়, পুরুষরাও আজ এ দাবির সাথে একমত। ধর্ষকদের যদি যথাযথ শাস্তি দেওয়া না হয়, তাহলে এমন দিন আসবে, যেদিন প্রতিটি পরিবারের একজন নারীও ধর্ষকদের হাত থেকে রেহাই পাবে না। কারণ মেয়েরা যে নিজ গৃহেই নির্যাতিত।

মেয়েদের পোশাক, সৌন্দর্য, সাজগোজ, চলাফেরা, বয়স, বন্ধুত্ব, আচরণ যদি ধর্ষণের কারণ হয়ে থাকে, তাহলে কেন শিশু ধর্ষণের হার বছর বছর বাড়ছে? প্রথম আলোর একটি প্রতিবেদনে আছে, ২০১৬ সালে ৩০০ এরও বেশি শিশু ধর্ষিত হয়েছে। এদের মধ্যে অর্ধেকেরই বয়স ১২ এর নীচে। কারো কারো বয়স তো ছয় বছরেরও কম। এ বছর এই সংখ্যা আরও বেশি হবে। এর মধ্যে ছেলে শিশুও আছে। কাজেই নারীর পোশাক এবং চলাফেরার দোষ দিয়ে ধর্ষণ করাকে আর জায়েজ করা যায় কি? হিজাব ও বোরকা পরেও তো নারী রক্ষা পাচ্ছে না ধর্ষকদের হাত, যৌন হয়রানি কিংবা সহিংসতা থেকে।

শুধু ধর্ষণ নয়, শিশু ধর্ষণের পরিসংখ্যান দেখে ভয়ে আমাদের বুকের রক্ত হিম হয়ে যাচ্ছে। কীভাবে নরাধমরা শিশুদের ব্যবহার করছে, তাদের লালসা চরিতার্থ করতে। বাংলাদেশ শিশু অধিকার ফোরাম বলেছে ধর্ষণের শিকার শিশুর সংখ্যা চারশোরও বেশি। এরমধ্যে ৬৪ জন শিশু গণধর্ষণের শিকার হয়েছে, যাদের বয়স চার থেকে নয় বছর। এরকম ঘটনার কথা বিশ্বাস করাও কঠিন, কিন্তু ঘটছে অবিরত। শুধু বাইরে নয়, শিশু তার গৃহেই যৌন হয়রানি ও ধর্ষণের শিকার হচ্ছে। শিশুর জন্য নিরাপদ জায়গা বলে আর কিছু নেই।

আমি বিচলিত সেইসব অমানুষদের নিয়ে, যারা সমাজে ভদ্র চেহারার মুখোশ পরে ঘুরে বেড়াচ্ছে আর দিনরাত চোখমুখ দিয়ে নারী-শিশুদের ধর্ষণ করছে। সুযোগ পেলে এরাই একদিন ঝাঁপিয়ে পড়ছে তার পরিবারের বা বাইরের কোন নারী-শিশুর উপর।

আমাদের চারপাশে ধর্ষকদের সংখ্যা দিনে দিনে বাড়ছে। অনেকে সরাসরি ধর্ষণ না করলেও নানাভাবে ধর্ষকদের পক্ষে থাকছে। যৌন হয়রানির তো সীমা-পরিসীমা নেই। এক শ্রেণির লম্পট খুব সহজেই এই কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। কেন ধর্ষণের হার এত বাড়ল? কেন শিশুরা ধর্ষকদের অন্যতম মূল লক্ষ্যে পরিণত হল? ধর্ষকরা কি আদৌ শাস্তির আওতায় আসছে? আর সবচেয়ে বড় কথা সমাজ ধর্ষকদের একঘরে করছে কি?

আমরা জানি, না, করছে না। বরং সমাজ জোটবদ্ধভাবে ধর্ষিতাকে একঘরে করে। তাকেই জবাবদিহি করতে হয় কেন সে ধর্ষিত হল? আইনের সামনে তাকেই প্রমাণপত্র হাজির করতে হয় যে সে ধর্ষিতা। কিন্তু একজন শিশু? তার ক্ষেত্রে কী হতে পারে? ধর্ষণের পর যখন শিশুটি মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়ে কিংবা ভয়ে কাঁপতে থাকে, তখন ধর্ষণের প্রমাণ হাজির করার মানসিকতা কয়জন অভিভাবকের থাকে? আর দরিদ্র পরিবারের পক্ষে তো এ লড়াই চালিয়ে যাওয়া রীতিমত অসম্ভব।

কিছুদিন আগে এক সভায় আলোচকরা বলেছেন, ১৮৭২ সালের সাক্ষ্য আইনের ১৫৫ ধারার ৪ উপধারার ভিত্তিতে ধর্ষণের অভিযোগ প্রমাণ করা হচ্ছে। এতে ধর্ষণের শিকার নারীর চরিত্র এবং অতীত ইতিহাস নিয়ে প্রশ্ন তোলা যায়। আসামিপক্ষের আইনজীবী ধর্ষণের শিকার নারীর নৈতিক চরিত্র হরণ করে, এমন সব প্রশ্ন করে, তা আরেকবার ধর্ষণের শামিল। আলোচকরা বলেন, ধর্ষণের ক্ষেত্রে যিনি অভিযোগকারী, তার চরিত্র নিয়ে প্রশ্ন তোলা হচ্ছে। অথচ অন্য কোনো আইনে এ ধরনের কোনো নজির নেই। তাই এই আইনের উপধারা বাতিল করার জন্য আইন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বারবার আবেদন জানিয়েছেন।

এক্ষেত্রে আসামিপক্ষের আইনজীবীদের কাছে আমার জানতে ইচ্ছা করে, শিশু ধর্ষণের শিকার হলেও কি, তারা সেই শিশুর চরিত্র নিয়ে প্রশ্ন তুলতে পারেন? আর কোনো মেয়ে যদি সত্যিই “খারাপ” হয়, তাহলে কি তাকে ধর্ষণ করাটা জায়েজ হয়ে যায়? একজন যৌনকর্মীকেও ধর্ষণ করার অধিকার কারো নেই।

আলোচনায় আরও উঠে এসেছে, ধর্ষকের চরিত্র নিয়ে কি প্রশ্ন তোলা হয়? না হয়না। তবে আদালত ও বিচারক চাইলে যেকোনো ধরনের হয়রানির হাত থেকে নারীকে বাঁচাতে পারেন। শুধু সাক্ষ্যের উপর ভিত্তি করে আসামিকে শাস্তি দিতে পারেন। বিশ্বের বিভিন্ন দেশ ধর্ষণ প্রমাণের জন্য এ ধরনের ধারা বাতিল করেছে, তাহলে আমাদের অসুবিধা কোথায়?

আজকাল ঘরে ঘরে, শিশু থেকে বুড়ো সবার হাতে টেকনোলজি। প্রযুক্তি ব্যবহারের উপর কারোর কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। ফলে কে যে কী করছে, কী দেখছে, কী শিখছে এর লিখিত-পঠিত কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। ছেলেদের অনেকেই কুরুচিপূর্ণ এসব জিনিষ উৎসাহী হচ্ছে এবং যেকোনো সময়, যেকোনো নারী-শিশুর উপর ঝাঁপিয়ে পড়ছে। কিন্তু তাকে নিজের চরিত্রের কোনো সনদপত্র দিতে হয় না, চট করে বিচারের মুখোমুখি পড়তে হয় না, কোনো পরীক্ষার আওতায়ও আনা হয় না। তাই এ ধরনের জঘন্য অপরাধ ক্রমশ বাড়ছে, আরও বাড়বে।

১৫৫ ধারার ৪ উপধারা ধর্ষকদের রক্ষার অস্ত্র। তবে টিভি টক শোতে এসে একজন আইনজীবী যদি বলেন, “ধর্ষণ কখনও একতরফা হয় না” (সূত্র : বাংলাদেশে ধর্ষণ মামলার বিচারে চারিত্রিক সাক্ষ্যের ব্যবহার শীর্ষক সভা), তাহলে ওই অসভ্য ছেলেটির ফেসবুক স্ট্যাটাসকে একা দায়ী করি কেমন করে? এরকম বিশ্বাস নিয়ে আপনার-আমার চারপাশে অনেকেই ঘুরে বেড়াচ্ছে “ছুপা রুস্তম” সেজে।

কঠিন আইনের পাশাপাশি সমাজকে বুঝতে হবে, মানতে হবে—লজ্জা ধর্ষণের শিকার নারী বা শিশুর নয়, লজ্জা ধর্ষকের। তা না হলে সমাজে ধর্ষণের মত অপরাধ থামানো কঠিন।

পুনশ্চ: আমি লেখাটি শেষ করার ঠিক পরপরই প্রথম আলোতে মনসুরা হোসেনের রিপোর্টটি দেখে খুব ভালো লাগলো। ধর্ষিতার ডাক্তারি পরীক্ষা ও চিকিৎসা বিষয়ে খসড়া নীতিমালা তৈরি হয়েছে। এখন থেকে যৌন সহিংসতার শিকার নারী ও কন্যাশিশুকে বিব্রতকর প্রশ্ন করা যাবে না। এমন কোনো প্রশ্ন করা যাবে না, যাতে সে অপমানিত হয়। যেহেতু ভিকটিমদের সাথে চূড়ান্ত খারাপ ব্যবহার করা হয়, তাই আদালত এই নীতিমালা করার নির্দেশ দিয়েছেন। অক্টোবরে আদালতের চূড়ান্ত শুনানি হওয়ার সম্ভাবনা আছে।

Comments

The Daily Star  | English

Tax-free income limit may rise to Tk 3.75 lakh

The government is planning a series of measures in the upcoming national budget to alleviate the tax pressure on individuals and businesses, including raising the tax-free income threshold and relaxing certain compliance requirements.

12h ago