দার্জিলিংয়ের আন্দোলনের আগুনে মমতার পানি
মাত্র ১৩ বছরের আন্দোলনে ৩৪ বছরের বামফ্রন্ট সরকারকে প্রায় নিশ্চিহ্ন করে দিয়েছিলেন পশ্চিমবঙ্গের তৃণমূল কংগ্রেসের প্রধান মমতা ব্যানার্জি। তাঁর রাজনীতির কাছে বর্ষীয়ান বাম রাজনীতিবিদ বিমান বসু, বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য, গৌতম দেব পরাস্ত হয়েছিলেন। তাঁরা এই মুহূর্তে পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতেও প্রায় প্রভাবহীন।
ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস ভেঙ্গে মমতা ব্যানার্জি তৃণমূল কংগ্রেস গঠন করেন ১৯৯৮ সালের ১ জানুয়ারি। ২০১১ সালে তৃণমূলের কাছে নির্বাচনে পরাস্ত হয়ে মুখ্যমন্ত্রীত্ব ছাড়তে হয় বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যকে। ১৯৭৭ সাল থেকে পশ্চিমবঙ্গের শাসনভার চালিয়ে যাচ্ছিল বামফ্রন্ট।
মমতা ব্যানার্জির রাজনৈতিক কৌশলে এবার হার মানলো দার্জিলিংয়ে আন্দোলনকারী গোর্খা জনমুক্তি মোর্চা। ১২ জুন পশ্চিমবঙ্গ থেকে পৃথক গোর্খাল্যান্ড রাজ্যের দাবিতে আন্দোলনের পথে রয়েছে দলটি।
প্রায় তিন মাসের মধ্যে আন্দোলনকারীদের মধ্যে চরম দ্বিধা-বিভক্তিই শুধু প্রকাশ পায়নি বরং পশ্চিমবঙ্গের শাসক দল আন্দোলনকারীদের একটি অংশের সমর্থন পেয়ে গিয়েছে। আর সমর্থনের উপহার হিসেবেও তাদের দেওয়া হয়েছে সরকারি উপঢৌকন – গোর্খাল্যান্ড টেরিটোরিয়াল অ্যাডমিনিস্ট্রেশন (জিটিএ) এর শীর্ষতম পদ। এ পদে ছিলেন আন্দোলনকারী গোর্খা জনমুক্তি মোর্চার প্রধান বিমল গুরুং। এই মুহূর্তে রাষ্ট্রদ্রোহিতার মামলায় ফেরারি রয়েছেন এক সময়ের তৃণমূলের সঙ্গে নিবিড় সম্পর্কে থাকা ওই পাহাড়ি নেতা।
এখন সেই পদের মুকুট পড়ানো হচ্ছে তৃণমূলে সরকারের সঙ্গে এই মুহূর্তে সুসম্পর্কে বাধা গোর্খা মুক্তি মোর্চার নেতা বিনয় তমাঙ্গ এবং অনীত থাপার মাথায়। আর এর মধ্য দিয়ে পশ্চিমবঙ্গ ভেঙে পৃথক রাজ্যের দাবিতে চলমান অগ্নিগর্ভ অবস্থা নিরসনে সু-কৌশলে পাহাড়ে সরকারের প্রভাব আরও শক্তিশালী করলেন মমতা ব্যানার্জি।
পাহাড়ের উন্নয়নের জন্য গঠিত স্বায়ত্বশাসিত জিটিএ-র প্রধান হিসেবে রাজ্য সরকার দায়িত্ব দিচ্ছে বিনয় তমাঙ্গকে।
বুধবার (২০ সেপ্টেম্বর) কলকাতায় মুখ্যমন্ত্রী ও রাজ্যটির প্রশাসনিক প্রধান মমতা ব্যানার্জি তাঁর কর্মস্থল নবান্নে নিয়মিত সাংবাদিক ব্রিফিং-এ জিটিএ-র প্রধান হিসেবে বিনয় তমাঙ্গের নাম ঘোষণা করেন এবং উপপ্রধান হিসেবে অনীত থাপার কথা বলেন।
মমতা বলেন, “পাহাড়ে শান্তি ফেরানোই তাঁর প্রধান লক্ষ্য। জিটিএ-র আট সদস্য বোর্ডের সচিব করা হয়েছে বরুণ রায়কে। বাকি সদস্যদের নাম বিজ্ঞপ্তি দিয়ে ঘোষণা করা হবে। জিটিএ আপাতত বিনয় তমাঙ্গের নেতৃত্বেই চলবে।”
গত ১২ জুন থেকে পশ্চিমবঙ্গের শৈল শহর দার্জিলিংয়ে লাগাতার ধর্মঘট চলছে। প্রায় সাড়ে তিন মাস ধরে চলা এই আন্দোলন আগস্ট মাসের শেষ দিকে রক্তক্ষয়ী আকার ধারণ করে। পুলিশ ও আন্দোলনকারীদের মধ্যে দফায় দফায় সংঘর্ষ যেমন হয়েছে, তেমন চলেছে চোরাগুপ্তা গ্রেনেড হামলাও।
এই অবস্থা থেকে উত্তরণের পথ খুঁজতেই সরকার আন্দোলনকারীদের মধ্যে কৌশলে বিভাজন তৈরির চেষ্টা শুরু করেছিল মাস খানেক আগে থেকে। আর সেটি সফল হতেও শুরু করছে। সেই কারণে পাহাড়ে আন্দোলনকারীরা এখনও নীরব। পাহাড়ে দোকানপাট স্বাভাবিকভাবে খুলছে এবং পর্যটকরাও যাচ্ছেন। সরকারি অফিস চলছে। কয়েকটি চা বাগানও খুলে দেওয়া হয়েছে। পুজার ছুটির পর স্কুল-কলেজও খুলে যাবে।
জুলাই মাসের শেষ দিকে থানায় হামলা, পুলিশের গাড়িতে আগুন, পুলিশ পেটানোসহ অস্ত্র আইন এবং দেশদ্রোহী মামলায় মোর্চা প্রধান বিমল গুরুং ও উপপ্রধান রোশন গিরি পাহাড় ছেড়ে পালিয়ে যান। পুলিশের অনুমান তারা নেপালে পালিয়ে গিয়েছেন। অনেকে বলছেন, সিকিম সরকারের আশ্রয়ে রয়েছেন ওই দুই নেতা। যদিও সরকারিভাবে কোনও তথ্য স্বীকার করা হয়নি।
ওই শীর্ষ দুই নেতা ফেরারি থাকায় পাহাড়ের চলমান আন্দোলনের রাশ চলে গিয়েছিল বিনয় তমাঙ্গের মতো মোর্চার দ্বিতীয় সারির নেতৃত্বের হাতে। সরকার বিনয় তমাঙ্গের মতো নেতাদের আলোচনায় ডেকে এনে সম্মানিত করার পরই পার্বত্য অঞ্চলে আস্তে আস্তে শান্তি ফিরে আসতে শুরু করে। তমাঙ্গ ছাড়াও পাহাড়ে অনেক মোর্চা নেতা, নেত্রী এখন তৃণমূল ঘনিষ্ঠ হয়ে উঠছেন।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন, আন্দোলনকারীদের কৌশলে দ্বিখণ্ডিত করে বাংলা ভাগের এই আন্দোলনে আপাতত পানি ঢেলেছেন তৃণমূল নেত্রী মমতা ব্যানার্জি। তবে তা কতদিন পর্যন্ত দার্জিলিংকে শান্ত রাখতে পারে তা অবশ্যই সময় বলতে পারবে বলেও মনে করেন তারা।
Comments