জন্মের মাসেই চলে গেলেন বারী সিদ্দিকী

‘শুয়া চান পাখি’ বারী সিদ্দিকী আজ ঘুমিয়ে গেলেন, আর জাগবেন না তিনি। মায়াভরা মুগ্ধ দরদীকণ্ঠে তিনি আর গান শোনাবেন না শ্রোতাদের।
bari siddiqui
বারী সিদ্দিকী (জন্ম: ১৯৫৪, ১৫ নভেম্বর - মৃত্যু: ২০১৭, ২৪ নভেম্বর)

‘শুয়া চান পাখি’ বারী সিদ্দিকী আজ ঘুমিয়ে গেলেন, আর জাগবেন না তিনি। মায়াভরা মুগ্ধ দরদীকণ্ঠে তিনি আর গান শোনাবেন না শ্রোতাদের। হাহাকার ছড়িয়ে দেয়া কণ্ঠে রজনীকে আর অবসান না হওয়ার অনুরোধ করবেন না ‘রজনী হইসনা অবসান, আজ নিশীতে আসতে পারে বন্ধু কালা চাঁন’ বলে। একদিন যেমন গেয়েছিলেন- ‘সুন্দর এই পৃথিবী ছেড়ে একদিন চলে যেতে হবে’; সত্যি সত্যি এই পৃথিবীর মায়া, সব পিছুটান এড়িয়ে ক্ষণজন্মা এই শিল্পী চলে গেলেন জীবনের ওপারে।

বারী সিদ্দিকী ১৯৫৪ সালের ১৫ নভেম্বর বাংলাদেশের নেত্রকোনা জেলায় এক সংগীতজ্ঞ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পুরো নাম আবদুল বারী সিদ্দিকী। শৈশবে পরিবারের কাছে গান শেখার হাতেখড়ি। মাত্র ১২ বছর বয়সেই নেত্রকোনার শিল্পী ওস্তাদ গোপাল দত্তের অধীনে তাঁর আনুষ্ঠানিক প্রশিক্ষণ শুরু হয়। তিনি ওস্তাদ আমিনুর রহমান, দবির খান, পান্নালাল ঘোষসহ অসংখ্য গুণিশিল্পীর সরাসরি সান্নিধ্য লাভ করেন।

ওস্তাদ আমিনুর রহমান একটি অনুষ্ঠানে গান গাওয়ার সময় বারি সিদ্দিকীকে দেখে তাঁকে আরো প্রশিক্ষণ নেওয়ার প্রস্তাব দেন। এরপর, ছয় বছর ওস্তাদ আমিনুর রহমানের অধীনে প্রশিক্ষণ নেন তিনি। সত্তরের দশকে জেলা শিল্পকলা একাডেমির সঙ্গে যুক্ত হন বারী।

এরপর, ওস্তাদ গোপাল দত্তের পরামর্শে ধ্রুপদী সংগীতে পড়াশোনা শুরু করেন বারী সিদ্দিকী। পরবর্তী সময়ে বাঁশির প্রতি বেশি আগ্রহী হয়ে উঠায় তিনি বাঁশির ওপর উচ্চাঙ্গসংগীতের প্রশিক্ষণ নেন। নব্বইয়ের দশকে ভারতের পুনে গিয়ে পণ্ডিত ভিজি কার্নাডের কাছে তালিম নেন। দেশে ফিরে লোকগীতির সাথে ধ্রুপদী সংগীতের সম্মিলনে গান গাওয়া শুরু করেন।

নব্বইয়ের দশকে কথাসাহিত্যিক ও চিত্রনির্মাতা হুমায়ূন আহমেদের সঙ্গে বারী সিদ্দিকীর পরিচয়। হুমায়ূনের নাটক-সিনেমায় গান করায় বারীর পরিচয় আরো ছড়িয়ে পড়ে। সাধারণ মানুষের হৃদয়ে স্থায়ী আসন করে নেন তিনি। এক সাক্ষাৎকারে বারী সিদ্দিকী বলেছিলেন, “হুমায়ূন আহমেদ আমার গাওয়ার পেছনে অনেক উৎসাহ দিয়েছিলেন। মূলত তাঁর সাহস নিয়েই আমি সামনে এগিয়ে যাওয়ার শক্তি পেয়েছি।”

১৯৯৫ সালে হুমায়ূন আহমেদের ‘রঙের বাড়–ই’ নামের একটা ম্যাগাজিন অনুষ্ঠানে প্রথম সংগীত পরিবেশন করেন বারী সিদ্দিকী। এরপর, ১৯৯৯ সালে হুমায়ূন আহমেদের রচনা ও পরিচালনায় ‘শ্রাবণ মেঘের দিন’ চলচ্চিত্রে সাতটি গানে কণ্ঠ দেন তিনি। এর মধ্যে ‘শুয়া চান পাখি’ গানটির জন্য তাঁর পরিচয় ও শ্রোতাপ্রিয়তা ছড়িয়ে পড়ে। তারপর, আর পেছন ফিলে তাকাতে হয়নি তাঁকে।

১৯৯৯ সালে জেনেভায় অনুষ্ঠিত বিশ্ব বাঁশি সম্মেলনে ভারতীয় উপমহাদেশ থেকে একমাত্র প্রতিনিধি হিসেবে তিনি অংশগ্রহণ করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর অর্জন করেন। ১৯৮৫ সালে বাংলাদেশ টেলিভিশনে যোগদান করেন তিনি। বারী সিদ্দিকী বাংলাদেশ টেলিভিশনে সংগীত পরিচালক ও মুখ্য বাদ্যযন্ত্রশিল্পী হিসেবে কর্মরত ছিলেন।

বারী সিদ্দিকীর জনপ্রিয় গানগুলোর মধ্যে রয়েছে ‘শুয়া চান পাখি আমার’, ‘পূবালি বাতাসে’, ‘আমার গায়ে যত দুঃখ সয়’, ‘ওলো ভাবিজান নাউ বাওয়া’, ‘মানুষ ধরো মানুষ ভজো’, ‘রজনী হইস না অবসান’, ‘তুমি থাকো কারাগারে’, ‘সাড়ে তিন হাত কবর’, ‘ঘরেও জ্বালা বাইরেও জ্বালা’, ‘আমার মন্দ স্বভাব জেনেও’, ‘মরার আগে মনটা মরে গেলো’, এই পৃথিবী যেমন আছে’, ‘মাটির দেহ’, ‘অপরাধী হলেও আমি তোর’, ‘একটু মাটি দেনা’, ‘বড়বেশী মন্দ আমি’, ‘মনের দুঃখ মনেই রইলো’, ‘তুমি না থাকলে’, ‘মনটা যদি টাকার মতো’, ‘পাপী আমি’, ‘মাটির দেহ ক্ষয় করিলাম’ এবং ‘আমার অনেক বাঁশের বাঁশী আছে’।

২০১৭ সালের ১৭ নভেম্বর বারী সিদ্দিকী হৃদরোগে আক্রান্ত হন। এরপর তাঁকে হাসপাতালে নিয়ে আসা হয়। ২৪ নভেম্বর তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৬৩ বছর। তিনি স্ত্রী, দুই ছেলে, এক মেয়ে আর অসংখ্য গুণগ্রাহী রেখে গেছেন।

আরো পড়ুন:

‘…আমি ডাকিতাছি তুমি ঘুমাইছ নাকি’

Comments

The Daily Star  | English

Bangladesh Bank to rescue problem banks

The Bangladesh Bank is set to rescue problem banks including some Shariah-based banks controlled by S Alam Group by managing liquidity or merging a few.

4h ago