যাঁরা আছেন নয়নে নয়নে

তাঁরা সবাই চোখের আড়ালে চলে গেছেন। কাউকে আর দেখা যাবে না কখনই। কিন্তু, আমাদের মধ্যে রয়ে গেছে তাঁদের কীর্তি। তাঁরা থাকবেন আমাদের অন্তরজুড়ে। তাঁদের কাজ, সৃষ্টি আমাদের অনুপ্রেরণা দিয়ে যাবে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে। চলে যাওয়া সেই ব্যক্তিদের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে দ্য ডেইলি স্টার অনলাইনের এই আয়োজন।
নায়করাজ রাজ্জাক
২০১৭ সালের ২১ আগস্ট শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন বাংলা চলচ্চিত্রের কিংবদন্তি অভিনেতা নায়করাজ রাজ্জাক। রাজধানীর একটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান তিনি। নায়করাজের মৃত্যুর খবরে গোটা চলচ্চিত্রপাড়ায় শোকের ছায়া নেমে আসে। ২৩ আগস্ট দুপুরে তাঁকে বনানী কবরস্থানে দাফন করা হয়। ১৯৪২ সালের ২৩ জানুয়ারি কলকাতায় জন্মগ্রহণ করেন রাজ্জাক। ঢাকায় ১৯৬৬ সালে ‘১৩ নম্বর ফেকু ওস্তাগার লেন’-এ একটি ছোট চরিত্রে অভিনয়ের মাধ্যমে চলচ্চিত্রে তাঁর অভিষেক হয়। জহির রায়হান পরিচালিত ‘বেহুলা’-য় অভিনয়ের মাধ্যমে জনপ্রিয় হয়ে উঠেন তিনি। ‘আগুন নিয়ে খেলা’, ‘এতটুকু আশা’, ‘নীল আকাশের নীচে’, ‘জীবন থেকে নেয়া’, ‘ওরা ১১ জন’, ‘অবুঝ মন’, ‘রংবাজ’, ‘আলোর মিছিল’, ‘অশিক্ষিত’, ‘ছুটির ঘণ্টা’ এবং ‘বড় ভালো লোক’-সহ অসংখ্য চলচ্চিত্রে অভিনয় করেছেন তিনি।
২০১৫ সালে স্বাধীনতা পুরস্কারে ভূষিত হন রাজ্জাক। তিনি মোট পাঁচবার শ্রেষ্ঠ অভিনেতার জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার লাভ করেন। ২০১৩ সালের জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারে তাঁকে আজীবন সম্মাননা দেওয়া হয়।
লাকী আখন্দ
‘আগে যদি জানতাম’-খ্যাত সুরকার, সংগীতপরিচালক ও গায়ক লাকী আখন্দ ২০১৭ সালের ২১ এপ্রিল ৬১ বছর বয়সে পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করে চলে যান। মিরপুর শহীদ বুদ্ধিজীবী কবরস্থানে তাঁকে দাফন করা হয়। দীর্ঘদিন ধরে তিনি ক্যান্সারে ভুগছিলেন। লাকী আখন্দ একজন মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। তিনি ১৯৫৬ সালের ৭ জুন পুরনো ঢাকায় জন্মগ্রহণ করেন। ১৯৮৪ সালে সরগমের ব্যানারে লাকী আখন্দের প্রথম একক অ্যালবাম প্রকাশিত হয়। তিনি ব্যান্ড দল ‘হ্যাপী টাচ’-এর সদস্য ছিলেন। তাঁর বিখ্যাত গানের মধ্যে রয়েছে- ‘আবার এলো যে সন্ধ্যা’, ‘কে বাঁশি বাজায় রে’, ‘স্বাধীনতা তোমাকে নিয়ে’, ‘এই নীল মনিহার’, ‘আগে যদি জানতাম’, ‘আমায় ডেকো না’ ও ‘মামুনিয়া’।
আবদুল জব্বার
গত ৩০ আগস্ট ৭৯ বছর বয়সে রাজধানীর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র-খ্যাত আবদুল জব্বার। ৩১ আগস্ট বুদ্ধিজীবী কবরস্থানে চিরনিদ্রায় শায়িত হন এই বিশিষ্ট সংগীতশিল্পী। তিনি ১৯৩৮ সালের ৭ নভেম্বর কুষ্টিয়া জেলায় জন্মগ্রহণ করেন।
তাঁর গাওয়া ‘তুমি কি দেখেছ কভু জীবনের পরাজয়’, ‘সালাম সালাম হাজার সালাম’ এবং ‘জয় বাংলা বাংলার জয়’ গান তিনটি ২০০৬ সালের বিবিসি বাংলার শ্রোতাদের বিচারে সর্বকালের শ্রেষ্ঠ ২০টি বাংলা গানের তালিকায় স্থান করে নেয়। তিনি ১৯৮০ সালে একুশে পদক এবং ১৯৯৬ সালে স্বাধীনতা পুরস্কারে ভূষিত হন। তাঁর গাওয়া আরো উল্লেখযোগ্য গানের মধ্যে রয়েছে- ‘ওরে নীল দরিয়া’, ‘পিচঢালা এই পথ’, ‘বিদায় দাও গো বন্ধু তোমরা’ ইত্যাদি।
বারী সিদ্দিকী
উপমহাদেশের প্রখ্যাত সুরকার, গীতিকার, বংশীবাদক ও সংগীতশিল্পী বারী সিদ্দিকী রাজধানীর একটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান গত ২৪ নভেম্বর। এর একদিন পর নেত্রকোনার চল্লিশা বাজারের বাউল বাড়িতে তাঁকে দাফন করা হয়। বারী সিদ্দিকী ১৯৫৪ সালের ১৫ নভেম্বর বাংলাদেশের নেত্রকোনা জেলায় এক সঙ্গীতজ্ঞ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। মাত্র ১২ বছর বয়সেই নেত্রকোনার শিল্পী ওস্তাদ গোপাল দত্তের অধীনে তাঁর আনুষ্ঠানিক প্রশিক্ষণ শুরু হয়। তিনি ওস্তাদ আমিনুর রহমান, দবির খান, পান্নালাল ঘোষসহ অসংখ্য গুণিশিল্পীর সরাসরি সান্নিধ্য লাভ করেন। ‘শুয়াচান পাখি’, ‘রজনী’, ‘আমার গায়ে যত দুঃখ সয়’, ‘আমি এক জিন্দা লাশ’, ‘মনের দুঃখ মনে রইল রে’, ‘সরলা’, ‘পূবালী বাতাসে’, ‘আমার মন্দ স্বভাব জেনেও’, ‘আমার অনেক বাঁশের বাঁশি আছে’ ইত্যাদি বারী সিদ্দিকীর উল্লেখযোগ্য গান।
মিজু আহমেদ
চলতি বছরের ২৭ মার্চ শুটিং করতে ঢাকা থেকে দিনাজপুরে যাত্রাপথে ট্রেনে হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে মারা যান চলচ্চিত্রের গুণী অভিনেতা মিজু আহমেদ। তিনি আহমেদ ইলিয়াস ভূঁইয়ার পরিচালনায় ‘মানুষ কেন অমানুষ’ ছবির শুটিং করতে দিনাজপুর যাচ্ছিলেন। কুষ্টিয়া জেলার কোটপাড়ায় নিজ গ্রামে তাঁকে দাফন করা হয়। মিজু আহমেদ ১৯৫৩ সালের ১৭ নভেম্বর কুষ্টিয়ায় জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর অভিনীত উল্লেখযোগ্য চলচ্চিত্রের মধ্যে রয়েছে ‘দাঙ্গা’, ‘ত্যাগ’, ‘দেশপ্রেমিক’, ‘খলনায়ক’, ‘হাঙর নদী গ্রেনেড’ ও ‘আম্মাজান’ । এছাড়াও, ‘ত্রাস’ ও ‘ওরা আমাকে ভাল হতে দিল না’ চলচ্চিত্রে অভিনয়ের জন্য জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার লাভ করেন।
নাজমুল হুদা বাচ্চু
চলচ্চিত্র ও নাটকের প্রবীণ অভিনেতা নাজমুল হুদা বাচ্চু মারা গেছেন গত ২৮ জুন। তাঁর বয়স হয়েছিল ৭৮ বছর। নাজমুল হুদা বাচ্চু বহু চলচ্চিত্র ও নাটকে অভিনয় করেছেন। তাঁর হাত ধরেই অভিনয়ে অভিষেক হয়েছিল বুলবুল আহমেদ, উজ্জ্বলের মতো অনেক চলচ্চিত্র তারকার।
আনিসুল হক
গত ৩০ নভেম্বর লন্ডনের একটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ৬৫ বছর বয়সে মারা যান আনিসুল হক। ২০১৫ সালে ঢাকা উত্তরের মেয়র নির্বাচিত হয়ে দেশবাসীর কাছে তুমুল জনপ্রিয় হয়ে উঠেন। এছাড়াও, তিনি ছিলেন নন্দিত উপস্থাপক ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব। একজন ব্যবসায়ী এই মানুষটি চিরকাল সংস্কৃতির চর্চা করে গেছেন। ১৯৫২ সালের ২৭ অক্টোবর নোয়াখালী জেলায় আনিসুল হকের জন্ম। ২০০৫ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত তিনি বিজিএমই-এর সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন এবং ২০০৮ সালে ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইর সভাপতি নির্বাচিত হন।
জটিলেশ্বর মুখোপাধ্যায়
২০১৭ সালের ২১ ডিসেম্বর মারা যান জটিলেশ্বর মুখোপাধ্যায়। আধুনিক বাংলা গানে ‘সব্যসাচী’ হিসেবে তাঁর খ্যাতি রয়েছে। তিনি ১৯৩৪ সালের ১৩ ডিসেম্বর ভারতের পশ্চিমবঙ্গের চুঁচুড়ায় জন্মগ্রহণ করেন। ‘বঁধুয়া আমার চোখে জল এনেছে হায় বিনা কারণে’, ‘এ কোন সকাল রাতের চেয়ে অন্ধকার’-সহ প্রায় ১,৩০০ গানের স্রষ্টা জটিলেশ্বর মুখোপাধ্যায়।
কালিকাপ্রসাদ ভট্টাচার্য
কালিকাপ্রসাদ ভট্টাচার্য মারা যান ২০১৭ সালের ৭ মার্চ। তিনি ছিলেন লোকসংগীত শিল্পী ও লোকসংগীত গবেষক। তিনি ১৯৬১ সালে আসামের শিলচরে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে তুলনামূলক সাহিত্যে অধ্যয়ন করেন। সংগীতে তাঁর অনুপ্রেরণা ছিলেন তাঁর কাকা অনন্ত ভট্টাচার্য। তাঁর শেষ কাজ ছিল বাংলাদেশের ছবি ‘ভুবন মাঝি’ এবং পশ্চিমবঙ্গের ‘বিসর্জন’। ১৯৯৯ সালে তিনি উত্তরবঙ্গ এবং পূর্ববঙ্গের পল্লীগান ও লোকায়ত গানের ঐতিহ্যকে পুনর্জাগরণের উদ্দেশ্যে লোকগানের ব্যান্ড ‘দোহার’ গঠন করেন।
ড. করুণাময় গোস্বামী
দেশের সংগীত গবেষণায় বিশিষ্ট নাম ড. করুণাময় গোস্বামী। নজরুল গবেষক হিসেবেও তিনি ছিলেন অগ্রগণ্য। গত ৩০ জুন ৭৫ বছর বয়সে তিনি দেহত্যাগ করেন। একুশে পদক ও বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কারসহ অসংখ্য পুরস্কারে সম্মানিত হয়েছেন তিনি। করুণাময় গোস্বামীর জন্ম ১৯৪২ সালের ১১ মার্চ ময়মনসিংহের গোসাই চান্দুরা গ্রামে। তাঁর উল্লেখযোগ্য গ্রন্থের মধ্যে রয়েছে ‘সংগীত কোষ’, ‘বাংলা গানের বিবর্তন’-প্রথম খণ্ড, ‘বাংলা গান স্বরলিপি-ইতিহাস’, ‘বুদ্ধদেব বসু ও অন্যান্য’, ‘রবীন্দ্র সংগীত পরিক্রমা’, ‘রবীন্দ্র সংগীত স্বরলিপি’- প্রথম ও দ্বিতীয় খণ্ড, ‘নজরুল গীতি প্রসঙ্গ’, ‘রবীন্দ্র নাট্যসংগীত’, ‘আব্বাসউদ্দিন’, ‘অতুলপ্রসাদের গান’, ‘রবীন্দ্রনাথ হান্টিংটন ও ভারতভাগ’, ‘বাংলাদেশের উচ্চাঙ্গসংগীত চর্চা ও গুণীজন’, ‘বাংলা গানের বর্তমান ও আরো’, ‘ভারত ভাগের অশ্রু কণা’, ‘রবীন্দ্রসংগীতকলা’, ‘কিশোর সংগীত’, ‘বাংলাগানের কথা’, ‘নজরুল সংগীত জনপ্রিয়তার স্বরূপ সন্ধান’, ‘বাংলা কাব্যগীতির ধারায় কাজী নজরুল ইসলামের স্থান’ প্রভৃতি।
অধ্যাপক দ্বিজেন শর্মা
চলতি বছরে আমরা আরো হারিয়েছি বিশিষ্ট প্রকৃতিপ্রেমী ও লেখক অধ্যাপক দ্বিজেন শর্মাকে। বাংলা ভাষাভাষীদের মধ্যে প্রকৃতি তথা গাছ-পালা সম্পর্কে সচেতন ও আগ্রহী করে তুলতে তিনি নিরলস পরিশ্রম করে গেছেন। তিনি ১৯৬২ সাল থেকে ১৯৭৪ সাল পর্যন্ত ঢাকার নটর ডেম কলেজের উদ্ভিদবিজ্ঞান বিভাগে শিক্ষকতা করেছেন। বিশিষ্ট এই প্রকৃতিপ্রেমী গত ১৫ সেপ্টেম্বর ৮৮ বছর বয়সে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। ১৯২৯ সালের ২৯ মে মৌলভীবাজার জেলার বড়লেখা উপজেলায় শিমুলিয়া গ্রামে দ্বিজেন শর্মার জন্ম। বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে অসামান্য অবদানের জন্যে তাঁকে ১৯৮৭ সালে বাংলা একাডেমি এবং ২০১৫ সালে একুশে পদকে ভূষিত করা হয়। তাঁর উল্লেখযোগ্য বইগুলো মধ্যে রয়েছে ‘শ্যামলী নিসর্গ’, ‘সমাজতন্ত্রে বসবাস’, ‘জীবনের শেষ নেই’, ‘ফুলগুলো যেন কথা’, ‘বিজ্ঞানশিক্ষা ও দায়বদ্ধতার নিরিখ’ এবং ‘নিসর্গ নির্মাণ ও নান্দনিক ভাবনা’।
Comments