‘মন্তব্য’ এর নামে এসব কী লিখছে মানুষ?
![মন্তব্য এর নামে ফেসবুকে লেখালিখি মন্তব্য এর নামে ফেসবুকে লেখালিখি](https://tds-images-bn.thedailystar.net/sites/default/files/styles/big_202/public/feature/images/hate_comments.jpg?itok=r-uH-Dsv×tamp=1520496857)
প্রিয় স্বদেশ, প্রিয় জন্মভূমি ছেড়ে চলে গেলেন মুক্তিযোদ্ধা ফেরদৌসি প্রিয়ভাষিণী। আমি বিশ্বাস করি আমাদের মা যেখানেই থাকবেন, শান্তিতে থাকবেন। একজন মুক্তিযোদ্ধার স্থান যে স্বর্গে হবে, সেকথাও আমরা জানি। শুধু ভয়ে ভয়ে ছিলাম ওনার মৃত্যুর খবর সংবাদ মাধ্যমগুলোর অনলাইন সংস্করণে প্রকাশিত হওয়ার পর, সেইসব সংবাদের নীচে মন্তব্যের ঘরে কে কী লিখছে, এই ভেবে। কারণ কদর্য ও রুচিহীন মন্তব্য করার ক্ষেত্রে আমাদের জুড়ি মেলা ভার।
দেখলাম বাদ পড়লেন না, ফেরদৌসি প্রিয়ভাষিণীর মত নির্মল মনের একজন মানুষ, একজন অকুতোভয় মুক্তিযোদ্ধাও। অনেকেই তাঁর মৃত্যুর খবরের নীচে হাসির প্রতীক ব্যবহার করেছে। কেউ লিখেছে, তাকে বাঁশ দিয়ে ঝুলিয়ে রাখতে, যেন কেউ মনে করে একজন ফেরাউনের মৃত্যু হয়েছে। কেউ বলছে “এত কান্দনের কি আছে, হে কি এমন আছিল”, অনেকে লিখেছে, নাস্তিক মহিলা। তাঁর জানাজা কেন পড়া হচ্ছে ইত্যাদি ইত্যাদি। এর চাইতেও জঘন্য সব মন্তব্য করা হয়েছে বেশ কয়েকটি অনলাইন সংস্করণের মন্তব্য বিভাগে। তবে ভালো ভালো সুখকর মন্তব্যও অনেক আছে।
অনেকের হয়তো মনে হতে পারে কেন আমি আলাদা করে খবরের চেয়ে খবরের নীচে মন্তব্যের দিকে দৃষ্টি দিচ্ছি? হ্যাঁ আমি এখন অনেক খবরের বা নিবন্ধের নীচে এই মন্তব্যগুলো দেখি, আর বোঝার চেষ্টা করি আমার চারপাশের মানুষ কিভাবে বিকৃত মন-মানসিকতার ধারক ও বাহক হয়ে যাচ্ছে। কতটা রুচিহীন কথা তারা লিখতে পারে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে, গণমাধ্যমে। যারা এসব লিখছে, তারা কেউ ভিনগ্রহ বা ভিনদেশ থেকে আসেনি। তারা এদেশের মানুষ। আপনার আমার পরিচিত, আত্মীয় বা প্রতিবেশী। এই ধরনের নোংরা মনের মানুষগুলোর সংখ্যা অল্পতো নয়ই, বরং অনেক বেশি। এদের অধিকাংশই ভুল বানানে, আঞ্চলিক ভাষায়, ভুল বা মিসলিডিং তথ্য দিয়ে লিখে যাচ্ছে। যা দেখে সহজেই অনুমান করা যায় এরা অশিক্ষিত ও বেয়াদব।
আমার একজন বন্ধু আমাকে বলল, “বাদ দাও এদের কথা। এরা আর সমাজের কয়টা মানুষ। এদের পাত্তা দেওয়া উচিৎ নয়।” পাত্তা না দিতে পারলে আমার চেয়ে সুখী কেউ হতো না। কিন্তু পারছিনা। জাফর ইকবাল স্যার যেদিন আক্রান্ত হলেন, সেদিনও ঠিক একইভাবে বিভিন্ন কুৎসিত মন্তব্যের ঝড় বয়ে যেতে থাকলো। কেউ লিখল, “হালা মরে নাই কেন? মরার খবরটাই শুনতে চাই, নাস্তিক জাফরের এই শাস্তিই প্রাপ্য ছিল”, কেউ লিখল সবেতো শুরু। একজন স্যারকে উদ্দেশ্য করে লিখেছে “শিক্ষাগরু”। যে ছেলেটি এই হামলা চালিয়েছে, তাকে বীরের মর্যাদা দিচ্ছে কেউ কেউ।
আমি স্তম্ভিত হয়ে যাচ্ছি মানুষের এই বিবেকহীনতা ও প্রতিক্রিয়াশীলতা দেখে। আতংকিত বোধ করছি এইসব পিশাচ মৌলবাদীদের উত্থান দেখে। একজন একজন করে এবং আমরা পাত্তা না দিতে দিতে এদের সংখ্যা এখন অগণিত। ফেসবুকে ভালো কমেন্টের চেয়ে এদের প্রতিক্রিয়াশীল কমেন্ট অনেক বেশি। বুঝি যে এরা জোট বেঁধে লেখে। বাঁশের কেল্লা টাইপ মানসিকতার লোক এখন ভূরি ভূরি।
যেকোনো মানুষের তার নিজস্ব মত প্রকাশের অধিকার আছে, মন্তব্য করারও অধিকার আছে। জাফর ইকবাল স্যার বা ফেরদৌসি প্রিয়ভাষিণী বা শেখ হাসিনা বা খালেদা জিয়াকে যে সবার ভালো লাগতে হবে, এমন কোনো কথা নেই। না ভালোবাসার অধিকার, না পছন্দের অধিকার, সমালোচনা করার অধিকার সবার আছে। কিন্তু কুৎসিত, কদর্য ভাষায় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ও গণমাধ্যমে গালাগালি করার অধিকার কারো নেই। একথা অন্য যেকোনো নেতা নেত্রী, কবি-সাহিত্যিক, নায়ক-নায়িকা বা সাধারণ মানুষ সবার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। মন্তব্য করার নামে-যা ইচ্ছা তাই লিখবে, নোংরা কথা লিখবে, সাম্প্রদায়িকতা ছড়াবে? নাহ, এ মেনে নেওয়া সত্যিই কষ্টকর। এসব মন্তব্য যারা করে এরা যে ভিতরে ভিতরে কী মন মানসিকতার তা সহজেই বোঝা যাচ্ছে। এরা প্রকাশ্যে হত্যাযজ্ঞ চালাতে পারছে না, সাহস বা সুযোগের অভাবে। কিন্তু মনে মনে জঙ্গি কাজকর্মকে সমর্থন জানিয়ে যাচ্ছে। তাদের এসব ঘৃণ্য মন্তব্য একথাই প্রমাণ করে যে এরাও লুকিয়ে থাকা হামলাকারী। যেকোনো সময় এরা নখর থাবা বসাবে। কাজেই এদের সম্পর্কেও আমাদের সতর্ক হওয়া উচিৎ।
এই শ্রেণির অধমগুলো এতটাই অসহিষ্ণু হয়ে উঠেছে যে সাধারণ মানুষের অসাম্প্রদায়িক, মুক্তমনা, মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের কোন লেখাই তারা সহ্য করতে পারে না। লেখককে মারধরের ভয়ভীতি দেখিয়ে, ম-বর্গীয়, চ-বর্গীয় গালিগালাজ দিয়ে, অজস্র ভুল বানানে ভরা মন্তব্য করে বিনা দ্বিধায়। পারলে মারধোরও করতো বলে মনে হবে, এইসব বাজে মন্তব্য পড়ে।
নরসিংদীতে সনাতন ধর্মাবলম্বীদের বাড়িতে আগুন দেওয়া নিয়ে, একটি অনলাইনে উদ্বেগ প্রকাশ করে লিখেছিলাম বলে ৯০টি মন্তব্য করা হয়েছিল সেই লেখার নীচে। এবং এরমধ্যে মাত্র ৪/৫টি ছিল ইতিবাচক, বাকি সবগুলো নোংরা ও কদর্য এবং ভুলে ভরা নিম্নমানের মন্তব্য। কোনো রাজনৈতিক বা ধর্মীয় চেতনা বিষয়ক লেখা নয়, শুধুমাত্র নিজের উপলব্ধিমূলক লেখা। তাও সবাই হামলে পড়ল।
ভারতীয় নায়িকা শ্রীদেবীর মৃত্যুর পর একটি অনলাইন থেকে আমাকে অনুরোধ করল ভিসিআর যুগের এই নায়িকাকে নিয়ে একটি ভিন্নধর্মী লেখা লিখতে। কারণ শ্রীদেবী যখন টপ নায়িকা, তখন আমাদের দেশে রঙিন টেলিভিশন ও ভিসিআর নামক যন্ত্রটার আগমন ঘটেছিল। সেটা ছিল আমাদের মতো মধ্যবিত্তের কাছে খুব উত্তেজনাকর একটি বিষয়। কাজেই যত ভারতীয় সিনেমা, সেসময় আমরা ভিসিআরে দেখেছি, তার অনেকগুলোই ছিল শ্রীদেবীর। সেই প্রেক্ষিত থেকেই একটি লেখা ছিল সেটি। কিন্তু তাতেও রেহাই পেলাম না। ঐ অভদ্র লোকগুলো বুঝে, না বুঝে যা তা মন্তব্য করল। পারলে এরা আমাকে ভারতের দালাল বলে ভারতে পাঠিয়ে দেয়। সেই সাথে নায়িকা শ্রীদেবীকেও চরম গালিগালাজ করেছে। অথচ আমি নিশ্চিত যে এদের অনেকেই এখনও ভারতীয় সিনেমা দেখে, সিরিয়াল দেখে, নায়ক-নায়িকার অঙ্গভঙ্গি দেখে, চিকিৎসা নেয় ভারতে, বেড়াতে যায়, ভারতীয় গরুর মাংস খায়, পণ্য ব্যবহার করে।
দ্য ডেইলি স্টারে একটি সংবাদে দেখলাম আইন বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, এইধরনের মন্তব্য এক ধরণের অপরাধমূলক কাজ। দেশের বর্তমান আইনের আওতায় এদের শাস্তি দেওয়া যায়। কিন্তু এদের শাস্তির ব্যাপারে কখনো আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীকে তৎপর হতে দেখিনি। অথচ ব্লগার আটকের ব্যাপারে যথেষ্ট সক্রিয় তারা। সত্য মিথ্যা যাচাই না করেই “ নাস্তিকতার” অভিযোগ এনে আটক করা হয়েছে অনেককে। কেউ সরকার বিরোধী কোনো লেখা লিখলে তাকেও আটক করা হয় বা হয়েছে। পুলিশ প্রগতিশীল লেখালেখিকেও মনে করে ধর্মের বিরুদ্ধে আঘাত দেওয়া।
কিন্তু এইসব আজেবাজে মন্তব্যকারীকে তারা কেন আইনের আওতায় আনছে না? এরা ইসলাম ধর্মের দোহাই দিয়ে অন্য যেকোনো মানুষকে ছোট করছে, মানি লোককে অসম্মানিত করছে, সমাজকে দূষিত করছে। আমার পরিচিত একজন পুলিশ কর্মকর্তাকে বিষয়টি নিয়ে জিজ্ঞাসা করাতে উনি বললেন, পুলিশ কাকে ছেড়ে কাকে ধরবে? এইসব লোকে দেশটা ভরে গেছে। অনলাইনগুলো এবং সংবাদপত্রের অনলাইন সংস্করণে যেসব মন্তব্য আসছে, সেগুলোরও এডিটিং ও গেট কিপিং জরুরি হয়ে পড়েছে। জানিনা তারা কী পদ্ধতিতে এটা করবে। কিন্তু করতে হবে। কারণ কিছু দুর্বৃত্তকে যা নয়, তাই লেখার স্বাধীনতা দেওয়া যাবে না। এরা হিংসা ও দ্বেষ ছড়ানোর প্ল্যাটফর্ম হিসেবে ব্যবহার করছে এই মন্তব্যের স্থানটিকে।
আসলে মানুষজন দিনে দিনে সাংঘাতিক রকমের মৌলবাদী হয়ে উঠছে। এদের চিহ্নিত করে শাস্তির আওতায় নিয়ে আসাটা জরুরি। ভয় শুধু একটা, এরা যেদিন সুযোগ পাবে, সেদিন বাংলাদেশের উপর ফণা তুলবে।
শাহানা হুদা রঞ্জনা: যোগাযোগকর্মী
Comments