প্রয়োজনের তুলনায় কম ঘুমাচ্ছে শিশুরা
তিন সদস্যের একটি পরিবারের কথা কল্পনা করা যেতে পারে। মা-বাবা দুজনেই চাকুরিজীবী। তাদের একমাত্র সন্তান স্কুলে যায়। প্রতিদিন সকালে নিজেরা ঘুম থেকে উঠার পর ডেকে তুলেন তাদের সন্তানকে। তারপর, এক সঙ্গে প্রস্তুত হওয়া। এক সঙ্গে নাস্তা সেরে সন্তানকে স্কুলে রেখে নিজ নিজ কর্মস্থলে চলে যান তারা।
স্কুল শেষ হলে সে যায় কোচিংয়ে। রাতে ঘরে ফেরার সময় তাকে কোচিং থেকে নিয়ে আসা হয়। এক সঙ্গে রাতের খাবার সেরে কিছুক্ষণ টেলিভিশন দেখেন মা-বাবা। বাচ্চাটি কিছুক্ষণ ক্লাসের কাজ করে। তারপর সবাই ঘুমাতে যায়।
সাধারণ নাগরিক জীবনে মোটামুটিভাবে এই চিত্রটাই সব জায়গায় দেখা যায়। কিন্তু, আমাদের সন্তানদের জন্যে তা ভালো হচ্ছে কি?
জাতীয় ঘুম ফাউন্ডেশনের মতে, স্কুলগামী ছয় থেকে ১৩ বছর পর্যন্ত শিশুদের নয় থেকে ১১ ঘণ্টা ঘুমের প্রয়োজন। ১৪ থেকে ১৭ বছর বয়সীদের প্রয়োজন আট থেকে ১০ ঘণ্টার ঘুম। আর ১৮ থেকে ৬৪ বছর বয়সীদের সাত থেকে নয় ঘণ্টা এবং ৬৪ বছরের বেশি বয়সীদের সাত থেকে আট ঘণ্টা ঘুমের প্রয়োজন। তাহলে দেখা যাচ্ছে, মা-বাবার চেয়ে তাদের স্কুলগামী সন্তানদের অন্তত দুই ঘণ্টা বেশি ঘুমের প্রয়োজন।
যাহোক, এ গবেষণায় দেখা যায়- বাংলাদেশে ছয় থেকে ১৩ বছর বয়সী স্কুলগামী শিশুরা সুপারিশকৃত ১১ ঘণ্টার চেয়ে কম ঘুমায়।
‘বাংলাদেশের মানুষদের দিনে কত ঘণ্টা ঘুমের প্রয়োজন?’ শিরোনামে ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের রিসার্চ অ্যান্ড ইভ্যুলুশন বিভাগের এক পরিসংখ্যানে দেখা যায় শিশুরা প্রয়োজনের তুলনায় কম ঘুমাচ্ছে এবং বয়স্করা প্রয়োজনের তুলনায় বেশি ঘুমাচ্ছেন।
গবেষণা দলের প্রধান ফকির এম ইউনুস দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, “আমরা বাংলাদেশে এই জরিপটা চালানোর পর কিছু ভয়াবহ চিত্র দেখতে পাই। কর্মজীবী মা-বাবা তাদের সন্তানদের জন্যে একটি ক্ষতিকর জীবনধারা তৈরি করে দিচ্ছেন।”
পরামর্শ মোতাবেক না ঘুমালে বিষয়টিকে ‘ঘুমের সমস্যা’ হিসেবে আখ্যা দেওয়া হয়। কেননা, কম বা বেশি ঘুম দুটিরই ক্ষতিকর দিক রয়েছে।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) ইন্সটিটিউট অব পেডিয়াট্রিক নিউরোডিজওয়ার্ডার অ্যান্ড অটিজম এর চিকিৎসক ডা. চৌধুরী রেহনুমা তাবাচ্ছুম বলেন, “শিশুর ভালো স্বাস্থ্যের জন্যে ঘুম খুবই প্রয়োজন। কোনো শিশু কম ঘুমালে তাঁর শারীরিক বৃদ্ধি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এছাড়াও, তার মধ্যে বিভিন্ন রকমের জটিলতা তৈরি হয়।”
ঘুমের অভাব হলে ছোট-বড় সবাইকে বিভিন্ন ধরনের সমস্যায় পড়তে হয় যা আমরা কল্পনাও করতে পারি না।
বিএসএমএমইউ এর কনসালটেন্ট ডা. এসএম আতিকুর রহমান বলেন, “ঘুমের সমস্যা স্বাস্থ্যের ওপর বাজে প্রভাব ফেলে। তারা কোনো বিষয়ের ওপর মনোযোগ দিতে ব্যর্থ হন। ঘুমের অভাবে তাদের আচরণগত সমস্যাও দেখা দেয়। কর্মস্পৃহা দমে যায়। মানসিক শক্তি কমে যায়। এর ফলে, স্মৃতিশক্তি হ্রাসের ঘটনাও ঘটে।”
পরিসংখ্যানে আরও দেখা যায়, শহরের অধিবাসীরা গ্রামের মানুষদের চেয়ে বেশি ঘুমান। এছাড়াও, কৃষি কাজে নিয়োজিত মানুষেরা অন্য পেশার লোকদের চেয়ে কম ঘুমান।
ঢাকা এবং চট্টগ্রাম ছাড়া দেশের অন্যান্য জেলার লোকজন প্রয়োজনের তুলনায় বেশ কম ঘুমান বলেও পরিসংখ্যানটিতে দেখা যায়।
দিন শেষে যেহেতু আমাদের স্বাস্থ্য, পরিবেশ এবং অন্যান্য পারিপার্শ্বিক বিষয় যথাযথ ঘুমের ওপর নির্ভর করে তাই আমাদেরই দায়িত্ব যার যার প্রয়োজন অনুযায়ী ঘুমানো। শিক্ষার্থীরা ঠিক মতো ঘুমাচ্ছে কী না তা নিশ্চিত করার দায়িত্ব তাদের মা-বাবার। কেননা, সন্তানের শারীরিক ও মানসিক সুস্বাস্থ্যের জন্যে নির্দিষ্ট পরিমান ঘুমের প্রয়োজন। তাই আমরা যেন সেই নির্দিষ্ট পরিমাণের ঘুমকে অবহেলা না করি। আর আসুন উদযাপন করি আজকের বিশ্ব ঘুম দিবস।
Comments