শীর্ষ খবর

কখনো কথা রাখেনি মিয়ানমার

নুরুল আমিন ১৯৯১ সালে প্রথম বাংলাদেশে পালিয়ে এসেছিলেন। সেবছর আরও আড়াই লাখ রোহিঙ্গার সাথে তাঁর পরিবারও কক্সবাজারে এসেছিল।
রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন
নিপীড়নের হাত থেকে বেঁচে বাংলাদেশে আশ্রয় নিলেও আসন্ন বর্ষায় এখন বন্যা ও ভূমিধসের ঝুঁকির মুখে রয়েছেন রোহিঙ্গা শরণার্থীরা। ছবি: আনিসুর রহমান

নুরুল আমিন ১৯৯১ সালে প্রথম বাংলাদেশে পালিয়ে এসেছিলেন। সেবছর আরও আড়াই লাখ রোহিঙ্গার সাথে তাঁর পরিবারও কক্সবাজারে এসেছিল। জবরদস্তি শ্রম, ধর্ষণ ও ধর্মীয় সহিংসতার হাত থেকে বাঁচতে মাত্র ১০ বছর বয়সে শরণার্থী হয়ে অজানা গন্তব্যের উদ্দেশে যাত্রা করতে হয়েছিল তাঁকে।

দুই বছর কক্সবাজারে অস্থায়ী একটি ক্যাম্পে থাকার পার রাখাইনের মংডুতে নিজের বাড়িতে ফিরে গিয়েছিল পরিবারটি। মিয়ানমার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল ১৯৮২ সালে কেড়ে নেওয়া নাগরিকত্ব তাদেরকে ফিরিয়ে দেওয়া হবে। নাগরিক হিসেবে তাঁরা ফিরে পাবে মৌলিক মানবিক মর্যাদা।

এর পর বহু বছর পেরিয়ে গেলেও মিয়ানমার প্রতিশ্রুতি রক্ষা করেনি। নাগরিকত্বের বদলে তাদের হাতে ধরিয়ে দেওয়া হয় ন্যাশনাল ভেরিফিকেশন কার্ড (এনভিসি), রোহিঙ্গাদের কাছে যা ‘এম্বেসি কার্ড’ নামে পরিচিত। এই কার্ডের অর্থ হলো, মিয়ানমার মনে করে তাঁরা বাংলাদেশ থেকে যাওয়া অবৈধ অভিবাসী।

মা-বাবার একমাত্র সন্তান নুরুল তবু আশা ছাড়েনি। যদিও তাদের অন্য সব রোহিঙ্গাদের মতই তাঁর চলাফেরা ও সম্পত্তি রক্ষার স্বাধীনতা ছিল না। বিয়ে এমনকি লাশের সৎকারের জন্যও তাদের কাছ থেকে অর্থ আদায় করত স্থানীয় কর্মকর্তারা।

এভাবে দুই দশক চলার পর ২০১২ সালে শুরু হয় সামরিক বাহিনীর নিপীড়ন। সে যাত্রায় কোনোমতে রক্ষা হলেও ২০১৬ সালে জাতিগত সংঘাতের আরও দুর্বিষহ হয়ে পড়ে রোহিঙ্গাদের জীবন।

এখন পাঁচ সন্তানের বাবা নুরুল কুতুপালং রোডের ধারে বসে গত  শুক্রবার দ্য ডেইলি স্টারকে বলছিলেন, ‘আমি আর থাকতে পারিনি। অনেকের মত আমাদেরও বাড়ি পুড়িয়ে দেওয়া হয়। জীবন বাঁচাতে আমরা বাংলাদেশে পালিয়ে এসেছি।’

কুতুপালংয়ের এই ক্যাম্পে এখন লাখো রোহিঙ্গার গাদাগাদি করে বসবাস। গত বছর আগস্ট মাসে জাতিগত নির্মূল অভিযান শুরুর পর এটাই এখন পৃথিবীর সবচেয়ে বড় শরণার্থী শিবির। 

এর আগেও নিপীড়নের মুখে বাংলাদেশে এসেছিল রোহিঙ্গারা। ১৯৭৮, ১৯৯১-৯২ সালেও সীমান্ত পাড়ি দিয়েছিল কয়েক লাখ সংখ্যালঘু। এদের বেশিরভাগই সুদিন ফেরার আশায় দেশে ফিরেছিলেন। তবে বার বার তাঁদের সীমান্ত অতিক্রম করে বাংলাদেশে আশ্রয় নিতে হয়েছে। এখন সব মিলিয়ে প্রায় ১১ লাখ রোহিঙ্গার বসবাস বাংলাদেশে।

কক্সবাজারের রোহিঙ্গা ক্যাম্পে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের সফরকে সামনে রেখে ১৩ দফা দাবি দিয়েছে শরণার্থীরা। এসব দাবি বিশ্লেষণ করে দেখলে মিয়ানমারে তাঁদের অনিশ্চিত জীবনের একটি চিত্র পাওয়া যায়। দাবিগুলোর মধ্যে রয়েছে, রাখাইনে বাস্তুচ্যুত যাঁদেরকে ক্যাম্পে রাখা হয়েছে সেসব ক্যাম্প বন্ধ করতে হবে; নিরাপত্তার নিশ্চিত করার জন্য আন্তর্জাতিক শান্তিরক্ষী মোতায়েন করতে হবে ও রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব ফিরিয়ে দিতে হবে।

আন্তর্জাতিক চাপের মুখে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের জন্য গত নভেম্বরে বাংলাদেশের সাথে একটি চুক্তি করে মিয়ানমার। কিন্তু চুক্তির শর্তের জটিলতার কারণে এখনও রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন আরম্ভ করা যায়নি।

অন্য অনেকের মতই নুরুল আমিনও বাংলাদেশে শরণার্থী শিবিরে মানবেতর জীবন যাপনে আগ্রহী নয়। মংডুতে তিনি নিজের বাড়িতে ফিরতে চাইলেও মিয়ানমার কর্তৃপক্ষের ওপর তাঁর আর আস্থা নেই। মিয়ানমার সরকার বলছে, রোহিঙ্গাদের প্রথমে এনভিসি কার্ডের জন্য আবেদন করতে হবে। তাদের মতে, এই কার্ড নাগরিকত্ব পাবার একটি পথ।

মিয়ানমারের রাখাইনের ত্রাণ, পুনর্বাসন ও উন্নয়ন সংক্রান্ত মন্ত্রী বাংলাদেশ সফরে এসেও এনভিসি কার্ডের কথা বলে গিয়েছিলেন। আশ্বাস দিয়ে বলেছিলেন, এই কার্ডের মাধ্যমেই তাদের নাগরিকত্ব দেওয়া হবে।

তবে তিনি এটাও স্বীকার করেছিলেন যে আগে যাঁদের এই কার্ড দেওয়া হয়েছিল তাদের স্বাধীনভাবে চলাফেরা করার উপায় ছিল না। রোহিঙ্গারা বলেছেন, যারা এই কার্ড নিয়েছিলেন তাঁরা শুধু আশপাশের এলাকাতেই চলাফেরা করতে পারতেন। তবে এর জন্যও অর্থ পরিশোধ করতে হতো। এক এলাকা থেকে অন্য এলাকায় যেতে অনেক বেশি অর্থ দিতে হতো তাদের।

তুন থেট বলেছিলেন, এনভিসি কার্ড দিয়ে রাখাইনে নিজেদের এলাকায় চলাফেরা করতে কোনো বাধা থাকবে না। ধীরে ধীরে বিশ্বাস অর্জনের মাধ্যমে তাঁরা জাতীয় রেজিস্ট্রেশন কার্ড নিতে পারবে। তবে মিয়ানমারের সমাজকল্যাণ মন্ত্রী বলেছিলেন ভিন্ন কথা। গত এপ্রিলে কক্সবাজারে এসে তিনি বলেন, এনভিসি কার্ড সম্পর্কে ভুল তথ্য দেওয়া হয়েছিল। বাংলাদেশ থেকে ফিরে ইয়াঙ্গুনে তিনি সংবাদ সম্মেলনে বলেছিলেন, এনভিসি কার্ডধারীরা পাঁচ মাসের মাথায় জাতীয় পরিচয়পত্র নিতে পারবেন।

তবে নুরুলের অভিজ্ঞতা ভিন্ন কথা বলছে। তিনি জানান, মিয়ানমার সরকার এর আগেও এ ধরনের প্রতিশ্রুতির কথা শোনালেও তাদের সাথে বিমাতাসুলভ আচরণ বন্ধ হয়নি। নাগরিকত্ব থেকেও বঞ্চিত রাখা হয়েছে দশকের পর দশক। হতাশ হয়ে তিনি বলেন, ‘মিয়ানমার সরকারকে আর কিভাবে বিশ্বাস করি?’ এই হতাশা শুধু নুরুলের একার না। বার বার বঞ্চনার শিকার হওয়া কক্সবাজারের সব রোহিঙ্গা নারী-পুরুষই মিয়ানমার সরকারের এরকম আশ্বাসের ওপর আস্থা রাখতে চাইছেন না।

বাংলাদেশ থেকে অবৈধ অভিবাসী হিসেবে নয় বরং রোহিঙ্গা হিসেবেই মাতৃভূমিতে ফিরে যেতে চাইছেন তাঁরা।

Comments

The Daily Star  | English

US vetoes Security Council demand for Gaza ceasefire

13 Security Council members voted in favor of a brief draft resolution, put forward by the UAE, while Britain abstained

4h ago