প্রশ্নবিদ্ধ ‘বন্দুকযুদ্ধ’
![](https://tds-images-bn.thedailystar.net/sites/default/files/styles/big_202/public/feature/images/police1_0.jpg?itok=-UgVYUKm×tamp=1527153519)
প্রতি রাতে ‘যুদ্ধ’ চলছে। বাংলাদেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী এলিট বাহিনী র্যাবের সঙ্গে ‘যুদ্ধ’ চলছে, মাদক ব্যবসায়ী বা চোরাচালানি বা বিক্রেতাদের। দুর্গম কোনো অঞ্চলে নয়, আপনার চেনা-জানা জায়গায়গুলোতেই চলছে ‘যুদ্ধ’। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী যার নাম দিয়েছেন ‘বন্দুকযুদ্ধ’। ২০০১ সালের বিএনপি-জামায়াতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী নাম দিয়েছিলেন ‘অপারেশন ক্লিনহার্ট’। র্যাবের জন্মের পর নাম দেওয়া হয় ‘ক্রসফায়ার’। নাম ভিন্ন হলেও, সব গল্পের শেষটা একই রকম।
সেই সময়ের বিডিআর (বর্তমান বিজিবি) পরিচালিত ‘অপারেশন ক্লিনহার্ট’-এ সন্ত্রাসী নামক মানুষ মারা যেত, হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে।
সন্ত্রাসীদের ধরে তাকে সঙ্গে নিয়ে রাতের অন্ধকারে অস্ত্র উদ্ধারের জন্যে বের হয় র্যাব। র্যাবের উপর আক্রমণ করে সন্ত্রাসীদের দলের অন্য সদস্যরা। গুলি চালায় র্যাব। মাঝখানে পড়ে ‘ক্রসফায়ার’-এ হত্যাকাণ্ডের শিকার হয় ‘ধৃত সন্ত্রাসী’। নিজেদের হেফাজতে থাকা ব্যক্তিকে বাঁচাতে পারে না র্যাব।
বর্তমানের ‘বন্ধুকযুদ্ধ’র বিষয়টি এমন, র্যাব মাদক চোরাচালানি বা বিক্রেতাদের বিরুদ্ধে অভিযানে যায়। তারা র্যাবের উপর গুলিবর্ষণ করে। পাল্টা গুলি চালায় র্যাব। মারা যায় মাদক চোরাচালানি বা বিক্রেতারা।
প্রথম দুদিন একক ভাবে অভিযান চালিয়েছে র্যাব। তারপর পুলিশও আলাদাভাবে মাদকের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করছে। একইভাবে মাদক চোরাচালানি বা বিক্রেতাদের মৃত্যু হচ্ছে।
এভাবে গত ১০ রাতে ৫০ জনের বেশি মাদক চেরাচালানি বা বিক্রেতা হিসেবে অভিযুক্ত মানুষ পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়েছে। যখন এই লেখা পড়ছেন, সংখ্যা হয়ত তখনও বাড়ছে।
মাদকবিরোধী অভিযানের ‘বন্দুকযুদ্ধ’র হত্যাকাণ্ড নিয়ে কিছু কথা।
১. মাদক নির্মূলে অভিযান অবশ্যই দেশের সব মানুষকে সমর্থন করতে হবে। কিন্তু অভিযানের অর্থ যদি হয় ‘বন্দুকযুদ্ধ’ এবং তাতে যদি নিয়মিত মানুষের মৃত্যু হয়, তবে তা সমর্থন করা যায় না। শুরুতেই বলে রাখা দরকার ‘বন্দুকযুদ্ধ’র আবরণে দেশের যে ‘যুদ্ধাবস্থা’র চিত্র তুলে ধরা হচ্ছে, তা দেশের সঠিক চিত্র নয়। দেশের কোথাও এমন ‘যুদ্ধ’ পরিস্থিতি বিরাজ করছে না। মাদক আছে ভয়াবহ মাত্রায়, সরাসরি মিয়ানমার থেকে অবৈধ প্রক্রিয়ায় মাদক আমদানিকারক গডফাদার আছে, তার পরিবার আছে, রাজনৈতিক ক্যাডার বাহিনী আছে। যারা বাংলাদেশের সর্বত্র ইয়াবা ছড়িয়ে দিয়েছে। ছড়িয়ে দিচ্ছে। মাঠ পর্যায়ে সরাসরি ইয়াবা বা মাদক বিক্রেতা আছে। গডফাদার অভিযুক্ত অপরাধী, ছোট চোরাচালানি বা মাদক বিক্রেতারাও অভিযুক্ত অপরাধী। কে কম, কে বেশি, সেই হিসেব করছি না। তা হিসেব করবেন আদালত। যে হিসেবটি সবার বিবেচনায় রাখা দরকার তা হলো, আমরা একটি স্বাধীন দেশে বাস করি। সেই দেশের একটি সংবিধান আছে। তার আলোকে আইন-আদালত আছে। সংবিধান বা আইনানুযায়ী বড়-ছোট যত বড় অভিযুক্তই হোক, তার অপরাধ প্রমাণ করতে হবে রাষ্ট্রকে। একজন মানুষ তখনই অপরাধী, যখন তার অপরাধ প্রমাণ হবে। প্রমাণের আগে পর্যন্ত কোনো মানুষকে, সে যত বড়-ছোট সন্ত্রাসী, মাদক চোরাচালানি বা যাই হোক না কেন- তাকে অপরাধী বলা যাবে না।
এই ব্যবস্থাটা মেনে নিয়েই বাংলাদেশ রাষ্ট্র পরিচালিত হচ্ছে। বিচার ছাড়া, আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ ছাড়া কাউকে অপরাধী বলা যাবে না, হত্যা করার তো প্রশ্নই আসে না। সংবিধান-আইন সেই অধিকার কাউকে দেয়নি, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে তো নয়-ই।
২. প্রশ্ন আসে, সরকার কিছু করলেও সমালোচনা করা হয়, কিছু না করলেও সমালোচনা করা হয়। সরকার তাহলে করবে কি?
মাদক চোরাচালানি বা বিক্রেতাদের গ্রেপ্তার করলে, জামিন নিয়ে অল্প কয়েকদিনের মধ্যে বেরিয়ে আসে। শাস্তি দেওয়া যায় না। কথা অসত্য নয়। তবে এর অন্য দিকও আছে। বিষয়টি এত সরল নয়। পুলিশ মামলা ঠিক মত সাজায় না বলে, আদালত জামিন দিতে বাধ্য হয়। এই তথ্যও অসত্য নয়।
ব্লেম গেমের মধ্যে আটকে আছে বাংলাদেশের মাদকের বাজার।
৩. এক সময় প্রজন্ম ধ্বংসযজ্ঞ শুরু করেছিল ফেনসিডিল। ফেনসিডিলের ধ্বংসযজ্ঞ বন্ধ হয়নি। তার সঙ্গে আরও ভয়াবহ মাত্রায় যোগ হয়েছে ইয়াবা। বাংলাদেশে ফেনসিডিল আসে ভারত থেকে। ইয়াবা আসে মিয়ানমার থেকে। সীমান্ত এলাকায় কারখানা করে ভারত-মিয়ানমার ফেনসিডিল ও ইয়াবা পাঠায় বাংলাদেশে। আর একটি বিষয় ভেবে দেখা দরকার, উৎপাদনকারী দেশের লোকজন ইয়াবা বা ফেনসিডিল সেবন করে না, করে শুধু বাংলাদেশের মানুষ। এর নেপথ্যের কারণ অনুসন্ধান করা খুব জরুরি।
আজকের আলোচনাটা ইয়াবার মধ্যে সীমিত রেখে বলছি।
ক. বাংলাদেশে ইয়াবা আসে টেকনাফের নাফ নদী অতিক্রম করে। কিছু আসে বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়িসহ পাহাড়-জঙ্গল সীমান্ত এলাকা দিয়ে।
খ. মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরসহ সরকারের তিনটি সংস্থা বছর তিনেক আগে পৃথক তিনটি তালিকা করেছিল। তিনটি তালিকাই করা হয়েছিল সরকারের উপর মহলের নির্দেশে। তিনটি তালিকাতেই ইয়াবা চোরাচালানকারী গডফাদার হিসেবে নাম এসেছিল একজনের এবং তার ভাইসহ পরিবারের সদস্যদের। পত্রিকায় ছবিসহ সেই সংবাদ প্রকাশিত হয়েছিল।
দুদকের অনুরোধে যে তালিকাটি মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর করেছিল তার দ্বিতীয় পৃষ্ঠায় লেখা ছিল, ‘মাননীয় সংসদ সদস্য আবদুর রহমান বদি দেশের ইয়াবা জগতের অন্যতম নিয়ন্ত্রণকারী। তার ইশারার বাইরে কিছুই হয় না। দেশের ইয়াবা আগ্রাসন বন্ধের জন্য তার ইচ্ছাশক্তিই যথেষ্ট।’
দৈনিক যুগান্তর গত ৮ জানুয়ারি তাদের প্রতিবেদনে বিষয়টি স্পষ্টভাবে উল্লেখ করেছিল।
গ. বদি এবং তার পরিবারের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। বদি এখন বলছেন, ‘ক্রসফায়ার আরও আগে শুরু করা দরকার ছিল’। আরও আগে মানে কত আগে? যখন তালিকায় তার নাম এসেছিল, তখন ‘বন্দুকযুদ্ধ’র অভিযান শুরু হলে, বদির ভাগ্যে কী ঘটতে পারত? তা নিয়ে যদিও তাদের চিন্তা করতে হয় না।
২০১৫ সালে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরেরই একটি অনুষ্ঠানে বদির সংশ্লিষ্ট না থাকার কথা বলে দিয়েছিলেন। ২০১৫ সালের ৪ সেপ্টেম্বর দৈনিক প্রথম আলো লিখেছিল, “ইয়াবা চোরাচালানের তালিকায় সাংসদ বদির নাম থাকা ও সরকারি কর্মকর্তাদের মারধরের ঘটনা প্রসঙ্গে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে মন্ত্রী বলেন, ‘অনেকের নামই আসে। কিন্তু আমরা তাঁর সংশ্লিষ্টতার প্রমাণ পাইনি। ...অনেকে ইমোশনালি নাম দিয়ে দেয়। অনেকে চিন্তাভাবনা করেও নাম দিয়ে দেয় যে, এটা হতে পারে। কিন্তু এসব হতে পারে দিয়ে তো আর বিচার হয় না। বিচার হবে তখনই, যখন সাক্ষ্যপ্রমাণ পাওয়া যাবে।’ মন্ত্রীর এই বক্তব্যের সময় কয়েকজন কর্মকর্তাকে পরস্পরের দিকে চাওয়াচাওয়ি করতে দেখা যায়। এই কর্মকর্তারাই ওই ইয়াবা পাচারকারীদের তালিকাসম্বলিত প্রতিবেদন তৈরির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন।’’
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মাদক বিরোধী সপ্তাহও উদ্বোধন করেছিলেন বদিকে সঙ্গে নিয়ে। দুদিন আগে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আবারও বলেছেন, ‘বদির বিরুদ্ধে অভিযোগ আছে, প্রমাণ নেই’। উল্লেখ্য আবদুর রহমান বদি কক্সবাজার-৪ অর্থাৎ টেকনাফ অঞ্চলের আওয়ামী লীগ দলীয় এমপি। তার পরিবার একসময় মিয়ানমার থেকে এসে টেকনাফ অঞ্চলে বসত গড়েছিল।
গত কয়েক বছরে তিনিও রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশের নাগরিক-ভোটার করায় প্রধান ভূমিকা পালন করেছেন। টেকনাফ অঞ্চলের অধিকাংশ স্থানীয় সরকারের চেয়ারম্যান-মেম্বার, এখন মিয়ানমার থেকে আগত রোহিঙ্গা-বাংলাদেশিরা। অভিযোগ রয়েছে, এর নেপথ্যের প্রধান ব্যক্তি আবদুর রহমান বদি এমপি।
ঘ. বদির বিরুদ্ধে অভিযোগের বিষয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর দেওয়া বক্তব্যের সঙ্গে সম্পূর্ণ একমত। অভিযোগ থাকলেও প্রমাণ না হওয়ার আগে পর্যন্ত কারও বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া যাবে না। তিনি বদি হন বা যেই হন।
ঙ. মাননীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী প্রশ্ন হলো, এখন যে তালিকা অনুযায়ী ‘বন্দুকযুদ্ধ’ সংগঠিত হচ্ছে সেই তালিকায় আপনার বক্তব্য অনুযায়ী ‘অনেকে ইমোশনালি নাম দিয়ে দেয়নি’- তা নিশ্চিত না হয়েই, অভিযান চলছে- মানুষ মরছে।
আপনিই বলেছেন, ‘বিচার হবে তখনই, যখন সাক্ষ্যপ্রমাণ পাওয়া যাবে’।
‘বন্দুকযুদ্ধ’র নামে যারা হত্যাকাণ্ডের শিকার হচ্ছেন, তাদের কার বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণ হয়েছে?
একজনেরও নয়। অথচ শাস্তি হয়ে যাচ্ছে।
বলছি না যে, যাদের মৃত্যু হচ্ছে তারা সবাই ভালো মানুষ। তাদের অধিকাংশই এলাকার ছোট সন্ত্রাসী-বখাটে। কেউ মাদকাসক্ত, কেউ কেউ মাদক চোরাচালানি- বিক্রেতা। তাদের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী গ্রেফতার করতে পারে, বিচারের মধ্য দিয়ে আইনানুযায়ী শাস্তি দিতে পারে। শাস্তি হবে, অপরাধ প্রমাণের পর। আইনানুযায়ী অপরাধের মাত্রা বিবেচনায় মৃত্যুদণ্ডও দেওয়া যেতে পারে। বর্তমান আইন অনুযায়ী তা সম্ভব না হলে, নতুন আইন করা যেতে পারে। কিন্তু ‘বন্দুকযুদ্ধ’র নামে তার মৃত্যুর কারণ হওয়া সমর্থন করা যাবে না।
চ. মাননীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, আপনি এক আইনের প্রয়োগে দুই রকমের দৃষ্টান্ত তৈরি করছেন। বদির ক্ষেত্রে বলছেন, ‘অভিযোগ আছে, প্রমাণ নেই’। আর শুধু অভিযোগের ভিত্তিতে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ অন্যদের জীবন চলে যাচ্ছে। বদির ক্ষেত্রে প্রমাণের প্রয়োজন হচ্ছে, অন্যদের ক্ষেত্রে প্রমাণের প্রয়োজন হচ্ছে না। কোনোভাবেই বলছি না যে, বদির ক্ষেত্রে ‘বন্ধুকযুদ্ধ’র পথ অনুসরণ করতে হবে। কারও ক্ষেত্রেই তা অনুসরণ করা যাবে না, সে কথা বলছি।
৪. ‘বন্দুকযুদ্ধ’র হত্যাকাণ্ড সাধারণ জনমানুষের একটা অংশ সমর্থন করেন। ‘অপারেশন ক্লিনহার্ট’ বা ‘ক্রসফায়ার’র সময়ও এই সমর্থন দৃশ্যমান হয়। সব সরকারই ভেবে নেয়, মানুষ এসব সমর্থন করছেন, তাদের জনপ্রিয়তা বাড়ছে।
মানুষ সমর্থন করেন, স্থানীয় কিছু মানুষ খুশি হন এই বিবেচনায় যে, তারা মাদকাসক্ত-মাদক বিক্রেতা বা সন্ত্রাসীর হাত থেকে রেহাই পেতে চান। খুশি হওয়ার নেপথ্যের কারণ মানুষ বিশ্বাস করে যে, গ্রেপ্তার করে এসব সন্ত্রাসী মাদক চোরাচালানিদের শাস্তি নিশ্চিত করা যাবে না। পুলিশ ঠিক মতো রিপোর্ট দেবে না, আদালতে অপরাধ প্রমাণ হবে না। তারা জামিনে বেরিয়ে আসবে। মানুষের এই বিশ্বাসের অর্থ-আপনারা ভেবে নিচ্ছেন ‘সমর্থন’ করছে। একটু চিন্তা দিয়ে ভেবে দেখেন। এই বিশ্বাসের অর্থ হলো মানুষ নিশ্চিত হয়ে গেছে যে, দেশে আইনের শাসন নেই। আইনের প্রতি মানুষের আস্থা হারিয়ে যেতে বসেছে। আরও একটু চিন্তা করে দেখেন, আপনারা যারা আইন তৈরি করেন, আইনের প্রয়োগ করার জন্যে দায়িত্বপ্রাপ্ত, তারাও আইনের প্রতি আস্থা রাখছেন না। বিচারহীন ‘বন্দুকযুদ্ধ’র প্রতি আস্থা রাখছেন।
এর মধ্য দিয়ে যা প্রকাশিত হয়ে পড়ছে, তার নাম ‘ব্যর্থতা’ এবং সেটা আপনাদের। দেশের মানুষ তা বিশ্বাস করছেন।
৫. ফিলিপাইনসহ পৃথিবীর কোনো দেশ মাদকের সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের হত্যা করে, মাদক থেকে মুক্তি পায়নি। আইনের শাসনের প্রয়োগ নিশ্চিত করে মুক্তি পেয়েছে অনেক দেশ। মাদক থেকে পুরোপুরি মুক্তি মিলবে না। তবে ভয়াবহতা কমানো সম্ভব। এর জন্যে সরকারের আন্তরিকতা অপরিহার্য। মাদকের ভয়াবহতা সমাজ থেকে কমাতে চাইলে, সরকারের রাজনৈতিক সদিচ্ছা দৃশ্যমান করতে হবে। প্রথমে মাদকের উৎস বন্ধের কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে। কার্যকর উদ্যোগ নিলেও মিয়ানমার থেকে ইয়াবা আসা পুরোপুরি হয়ত বন্ধ হবে না। তবে আসার পরিমাণ অনেক কমে যাবে। ইয়াবার সহজলভ্যতা থাকবে না।
তারপর ধরতে হবে গডফাদারদের। একই সঙ্গে ব্যবস্থা নিতে হবে মাঠ পর্যায়ের চোরাচালানি বা বিক্রেতাদের বিরুদ্ধে। উৎস বন্ধের চেষ্টা না করে, গডফাদারদের অক্ষত রেখে, মাঠের চোরাচালানি- বিক্রেতা বা মাদকাসক্তদের হত্যা করলে, সমাধান মিলবে না। তার পরের স্তরের চোরাচালানিরা সাময়িকভাবে আত্মগোপনে বা বিদেশে পালাবে। সুবিধাজনক সময়ে আবার তারা ফিরে আসবে। মাঠ পর্যায়ের চোরাচালানি বা বিক্রেতা যত জন নিহত হবে, তারচেয়ে বেশি সংখ্যক আবার তারা তৈরি করবে।
৬. প্রয়োজনে একটি কমিশন করে, তাদের মতামতের ভিত্তিতে একটি সামগ্রিক পরিকল্পনা নেওয়া দরকার। কেন সামগ্রিক পরিকল্পনা নেওয়া জরুরি তার জন্যে, মাননীয় রাষ্ট্র পরিচালকগণ অতীতের সব নয়, দু’ একটি বিষয় বিবেচনায় নিয়ে একটু কষ্ট করে ‘বন্দুকযুদ্ধ’ বিষয়ে দ্বিতীয়বার ভাবুন।
চারশোর উপরে পুলিশ সদস্যের সম্পৃক্ততা পাওয়া গেছে মাদক বা ইয়াবা চোরাচালানের সঙ্গে। মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের শতাধিক কর্মকর্তার বিরুদ্ধে অভিযোগ মাদক সংশ্লিষ্টতার। অভিযুক্ত গাইবান্ধার পুলিশ সদস্যকে হয়ত, কুমিল্লায় বদলি করা হয়েছে। পুলিশের ‘শাস্তি’ তো এমন-ই। কুমিল্লায় মাদক বিরোধী অভিযানে হয়ত সেই পুলিশ সদস্যও অংশ নিচ্ছেন। তার বা তাদের অভিযানে শিকার কি শুধুই মাদক চোরাচালানি বা বিক্রেতারাই হবে, নিশ্চিত করে তা বলা যায়?
র্যাব খুঁজছিল হাবিব শেখকে, সোর্স মোশাররফ পূর্ব শত্রুতার জেরে ধরিয়ে দিয়েছে হাবিবুর রহমানকে। ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত হয়েছে হাবিবুর রহমান। ভুল তথ্য দেওয়ায় সোর্স মোশাররফকে ফোন করে ডেকে নেয় র্যাব। মোশাররফও ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত হয়।
সংবাদ সম্মেলন করে এই অভিযোগ করেছেন ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত হাবিবুর রহমানের স্ত্রী- সন্তান।
মাননীয় দেশ পরিচালকেরা, হাবিবুর রহমানের অসহায় স্ত্রী, অষ্টম শ্রেণীর ছাত্রী কন্যা ইভার আকাশ- বাতাস কাঁপানো হাহাকার আর্তনাদ, চোখের পানি, আপনাদের বিবেক পর্যন্ত পৌঁছায় না কেন!
একবার স্মরণ করার চেষ্টা করেন, লিমনকে কারা- কেন- কীভাবে গুলি করে পঙ্গু করে দিয়েছে। সবাই নিশ্চিত করেই জানেন, লিমনের কোনো দোষ ছিল না।
মাননীয় দেশ পরিচালকেরা একবার কী স্মরণে আনবেন, কারা-কেন-কীভাবে নারায়ণগঞ্জে সাত জনকে অপহরণ করে হত্যা করেছিল।
এখনকার ‘বন্দুকযুদ্ধ’র ক্ষেত্রেও এমন কিছু ঘটছে না, তা কেউ বুকে হাত দিয়ে বলতে পারবেন না।
গাইবান্ধার সাঁওতাল পল্লীর সেই ভিডিও চিত্রটি দয়া করে আরও একবার দেখুন। দরিদ্র সাঁওতালদের যাদের রক্ষা করার কথা ছিল, তারাই সাঁওতালদের ঘরে আগুন দিয়েছিল, গুলি করেছিল। কেন করেছিল? প্রভাবশালীদের সুবিধা করে দিয়েছিল। বিনিময়ে প্রভাবশালীদের থেকে সুবিধা নিয়েছিল।
৭. বলতেই পারেন এসব ‘বিচ্ছিন্ন’ ঘটনা। সামগ্রিকভাবে বাহিনীগুলো এর জন্যে দায়ী নয়। নিশ্চয় সমগ্র বাহিনী দায়ী নয়- তা বলা যায়, কিন্তু দায় মুক্ত কী হওয়া যায়?
আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কিছু সদস্য যখন মাদক চোরাচালান সংক্রান্ত অভিযোগে অভিযুক্ত হয়, তার জন্যে পুরো বাহিনীকে দায়ী করা যায় না। তবে বোঝা যায়, বাহিনীর ভেতরে ত্রুটি-বিচ্যুতি এবং নৈতিকতার ভিত্তি কতটা দুর্বল।
সেই বাহিনীর ‘বন্দুকযুদ্ধে’ যখন প্রতি রাতে ১০-১২ জনের বেশি মানুষকে জীবন হারাতে হয়, তা দেখে-জেনে বিচলিত বা আতঙ্কিত না হয়ে উপায় থাকে না। বিবেচনায় রাখা দরকার স্থানীয়ভাবে কিছু সংখ্যক মানুষ ‘বন্দুকযুদ্ধ’র ঘটনায় খুশি হলেও এতে আত্মতৃপ্তির সুযোগ নেই। এই প্রবণতা অব্যাহত থাকলে, অভিযোগ ছাড়া অনেক মানুষ জীবন হারাতে শুরু করবেন, সেই সম্ভাবনা উড়িয়ে দেওয়া যায় না। একজনের সঙ্গে আরেকজনের বিরোধের প্রেক্ষিতে ‘বন্দুকযুদ্ধ’র জীবন হারানোর ঘটনা ঘটতে পারে। যার একটি অভিযোগ ইতিমধ্যে সুনির্দিষ্ট করে এসেছে। অতীতে ‘ক্রসফায়ার’র ক্ষেত্রেও তার নজীর আছে। সবচেয়ে বড় কথা ‘বন্দুকযুদ্ধ’ বা মানুষের জীবনের বিনিময়ে কিছু অর্জনও করা যাবে না।
Comments