সুখেই আছে বেসিক ব্যাংক লুণ্ঠনকারীরা

২০০৯ থেকে ২০১৩ সালের মধ্যে চার বছরে বেসিক ব্যাংক থেকে ঋণ জালিয়াতির মাধ্যমে ৪,৫০০ কোটি টাকা বের করে নিয়ে যাওয়া হয়। টাকার অঙ্কে দেশের ইতিহাসে এককভাবে এটাই সবচেয়ে বড় ঋণ কেলেঙ্কারি হলেও দুর্নীতির কথা প্রকাশ্যে আসার পর একে ঘিরে যেসব ঘটনা ঘটেছে তা আরও বেশি হতাশাব্যাঞ্জক।
একটি প্রতিষ্ঠানকে রক্ষা করার জন্য যাদের ওপর দায়িত্ব থাকে তারাই যে লুণ্ঠনকারী হয়ে উঠতে পারে তার একটি জ্বলন্ত উদাহরণ বেসিক ব্যাংক কেলেঙ্কারি। ব্যাংকটি লুণ্ঠন নিয়ে যতগুলো তদন্ত হয়েছে তার প্রত্যেকটিতেই বলা হয়েছে ব্যাংকটির তৎকালীন চেয়ারম্যান আব্দুল হাই বাচ্চু আক্ষরিক অর্থেই পরিচালনা পর্ষদের সহায়তায় লুটপাট চালিয়েছেন।
২০১৫ সালে দুর্নীতি দমন কমিশন এই কেলেঙ্কারি নিয়ে ৫৬টি মামলা দায়ের করে। কিন্তু যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ সেই বাচ্চু ও পরিচালনা পর্ষদের কাউকেই মামলাগুলোতে অভিযুক্ত করা হয়নি। এতেই বোঝা যায় ক্ষমতাধর দুর্নীতিবাজদের বিচারের আওতায় আনতে রাষ্ট্রযন্ত্র কতটা অসহায়।
বেসিক ব্যাংক কেলেঙ্কারি নিয়ে এখন পর্যন্ত দৃশ্যমান ব্যবস্থা বলতে ব্যাংকটির পাঁচ জন কর্মকর্তাকে কারাগারে পাঠানোর ব্যবস্থা করা। কিন্তু এদের মধ্যে বেশ কয়েকজন রয়েছেন যারা শুধুমাত্র উচ্চ পর্যায়ের আদেশ তামিল করেছিলেন। সিদ্ধান্ত নেওয়ার ধারে কাছেও ছিলেন না তারা। কিন্তু এক সময়ের খ্যাতিসম্পন্ন রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকটি ডুবতে বসলেও বহাল তবিয়তে রয়েছেন বাচ্চু ও পরিচালনা পর্ষদের সবাই।
বেসিক ব্যাংকে যখন সাধারণ আমানতকারীদের টাকা লুট হচ্ছিল বাচ্চু তখন ১৫০ কোটি টাকা দিয়ে গভীর সমুদ্রে মাছ ধরার ১১টি ট্রলার ভাসিয়েছিলেন। শুধু বাচ্চুই নন, তার সহযোগী ও পরিচালনা পর্ষদের অন্যান্যদের পুরস্কৃত করে সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও সংস্থায় পদোন্নতি দিয়ে বসানো হয়েছে।
বেসিক ব্যাংক দুর্নীতিতে সংশ্লিষ্টতার অভিযোগে এখন পর্যন্ত ১৪ জনকে গ্রেপ্তার করেছে দুদক। এর মধ্যে রয়েছেন আট জন ব্যবসায়ী, একজন সার্ভেয়ার ও ব্যাংকের উচ্চ পর্যায়ের পাঁচ জন কর্মকর্তা। এই কর্মকর্তাদের সবাই হাইকোর্ট থেকে জামিন নিয়ে এখন কারাগারের বাইরে।
ঋণ কেলেঙ্কারির ৫৬ মামলার তদন্ত আড়াই বছরেরও বেশি সময়ে শেষ না হওয়া ও রাঘব বোয়ালদের গ্রেপ্তার করাতে না পারায় গত সপ্তাহে তদন্ত কর্মকর্তাদের তলব করে দুদকের প্রতি তীব্র ক্ষোভ ও হতাশা ব্যক্ত করেন হাইকোর্ট। আদালত বলেন, ‘এখন লজ্জায় চোখ ঢাকি। মনে হয় কালো কাপড় দিয়ে মুখ ঢাকি।’
আসামিদের সঙ্গে তদন্তকারী কর্মকর্তাদের যোগসাজশ প্রসঙ্গে বিচারপতি এম এনায়েতুর রহিম বলেন, ‘…আপনাদের নির্লিপ্ততার কারণে যেসব আসামি ভেতরে আছে তারা বেরিয়ে যাচ্ছে। তাদের সাথে আপনাদের সখ্য আছে বলে মনে হচ্ছে। চার্জশিট দিতে দেরি করছেন, যাতে আসামিরা জামিন পেয়ে যায়। আমরা তাদের জামিন দিতে বাধ্য হচ্ছি।’
গত বছর জুলাই মাসে ঋণ কেলেঙ্কারির সঙ্গে বাচ্চু ও পরিচালনা পর্ষদের সদস্যদের সংশ্লিষ্টতা খতিয়ে দেখতে হাইকোর্ট দুদককে নির্দেশনা দেন। এর পর বাচ্চুকে পাঁচবার জিজ্ঞাসাবাদ করেছে দুদক। সেই সঙ্গে পরিচালনা পর্ষদেরও সবাইকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। কিন্তু তাদের কেউই গ্রেপ্তার হননি। এ থেকেই ধারনা করা যায় দুদক তাদের বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগই পায়নি। যদিও ভিন্ন কথা বলছে বাংলাদেশ ব্যাংকের তদন্ত প্রতিবেদন।
কেলেঙ্কারিতে বাচ্চুর নেতৃত্বাধীন পরিচালনা পর্ষদকেই সম্পূর্ণভাবে দায়ী করছেন বেসিক ব্যাংকেরই একজন কর্মকর্তা। তিনি জানান, কয়েক দফায় লুট হওয়া মোট ৪,৫০০ কোটি টাকার মধ্যে ৯৫ শতাংশ ক্ষেত্রেই পরিচালনা পর্ষদের অনুমোদন ছিল। প্রত্যেক ক্ষেত্রেই ঋণের পরিমাণ ছিল এক কোটি ৫০ লাখ টাকার বেশি।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে ডেইলি স্টারকে তিনি বলেন, ‘ঋণের পরিমাণ দেড় কোটি টাকার বেশি হলে পরিচালনা পর্ষদের অনুমোদনের প্রয়োজন হয়। তখনও প্রত্যেক ক্ষেত্রেই বোর্ডের সবুজ সংকেতে ঋণ দেওয়া হয়।’
বেসিক ব্যাংক দুর্নীতি নিয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংক যেসব তদন্ত করেছে তাতেও ঋণ কেলেঙ্কারিতে সরাসরি পরিচালনা পর্ষদের সংশ্লিষ্টতা পাওয়া গেছে বলে যোগ করেন তিনি।
দুদককে ২০১৪ সালে এরকমই একটি তদন্ত প্রতিবেদন দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। বিভিন্ন ভুয়া কোম্পানি ও সন্দেহজনক একাউন্টের মাধ্যমে কীভাবে বেসিক ব্যাংক থেকে টাকা বের করে নিয়ে যাওয়া হয়েছে তার বিবরণ তুলে ধরা হয় ওই প্রতিবেদনে। নিয়ম লঙ্ঘন করে কীভাবে ঋণ অনুমোদন দেওয়া হয়েছিল তা প্রায় পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে জানা যায় ৪৭ পৃষ্ঠার প্রতিবেদন থেকে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, বেশ কয়েকটি ঋণ প্রস্তাব নিয়ে ব্যাংকের শাখাগুলো থেকে পর্যবেক্ষণে নেতিবাচক জানানো হওয়ার পরও বেসিক ব্যাংকের সদর দপ্তর থেকে এর পরিচালনা পর্ষদ ও ঋণ সংক্রান্ত কমিটি তা উপেক্ষা করে ঋণ অনুমোদন করা হয়েছে।
দুদকের একজন তদন্তকারী এখন বলছেন, নথিপত্র পরীক্ষা নিরীক্ষা করে তারা আবার পরিচালকদের জিজ্ঞাসাবাদ করবেন।
বেসিক ব্যাংকের তৎকালীন পরিচালকদের মধ্যে বেশিরভাগই এখন বিভিন্ন সরকারি দপ্তরের উচ্চ পর্যায়ে রয়েছেন। তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করাও এখন দুদকের জন্য চ্যালেঞ্জের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। দ্য ডেইলি স্টারের সঙ্গে আলাপকালে সম্প্রতি এমনটাই জানিয়েছেন সংস্থাটির পরিচালক সৈয়দ ইকবাল হোসেন।
উদাহরণ হিসেবে দুদক পরিচালক বলেন, বেসিক ব্যাংকের তৎকালীন পরিচালকদের মধ্যে একজন শুভাশিস। তিনি এখন বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সচিব। জিজ্ঞাসাবাদের জন্য তাকে বেশ কয়েকবার ডাকা হলেও তিনি সময় চেয়েছিলেন। পরে মন্ত্রণালয়ের অফিসে গিয়ে তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়।
তবে মন্তব্যের জন্য চেষ্টা করেও বাচ্চুর সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারেনি দ্য ডেইলি স্টার। বুধবার শুভাশিসের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলে তার ব্যক্তিগত সহকারী বলেন, তিনি দেশের বাইরে আছেন। গতরাতে ফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলে তার মোবাইল বন্ধ পাওয়া যায়।
এছাড়াও ব্যাংকটির তৎকালীন পরিচালনা পর্ষদের সদস্যদের মধ্যে শ্যাম সুন্দর শিকদার, নীলুফার আহমেদ ও কামরুন নাহারের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে প্রত্যেকেরই ব্যক্তিগত সহকারীরা বলেন যে তারা মিটিংয়ে রয়েছেন।
আর বরখাস্ত হওয়ার পর থেকেই আত্মগোপনে রয়েছেন ব্যবস্থাপনা পরিচালক কাজী ফখরুল ইসলাম। ২০১৪ সালের মে মাসে ব্যাংকটির ঊর্ধ্বতন নয় জন কর্মকর্তার সঙ্গে তাকেও বরখাস্ত করা হয়েছিল।
Comments