‘এটা আমার এলাকা, কে কে আসবি, আয়’
সেলিম ব্যাপারীর কথা বলছি। বুঝতে পারছি, মনে করতে পারছেন না। নিজেকেই প্রশ্ন করছেন, কোন সেলিম ব্যাপারী?
সেই সেলিম ব্যাপারী, যাকে ১৯ জুন রাত সাড়ে ১০টার দিকে গাড়ি চাপা দিয়ে হত্যা করা হয়েছে। তিনি নিজেও গাড়ি চালাতেন। মালিককে বাসায় রেখে হেঁটে ঘরে ফিরছিলেন। দুর্ঘটনা ঘটার ঠিক পরপর মহাখালী ফ্লাইওভারের এই এলাকা অতিক্রম করছিলাম। অনেক লোকের ভিড়। চালক বললেন, একটু আগে গাড়ি চাপায় একজন নিহত হয়েছেন। রক্তাক্ত দেহ তখনও পড়ে আছে।
বুকের ভেতরটা কেঁপে উঠল। কে নিহত হলেন, ঢাকার এই ফাঁকা রাস্তায়? পরিচিত কেউ নন তো? তখনও ঘরে সেলিম ব্যাপারীর সন্তান-স্ত্রী অপেক্ষায় ছিলেন। গাড়ির ঘাতক চালকের জোরে গাড়ি চালানোর বিনোদনে, হারিয়ে গেলেন সেলিম ব্যাপারী। চালক কে, কে হত্যা করল সেলিম ব্যাপারীকে?
১. গাড়িটি প্রথমে সেলিম ব্যাপারীকে ধাক্কা দিয়েছে। আবার পেছনে গেছে। দ্বিতীয়বার চাপা দিয়ে দ্রুত গতিতে চলে গেছে। গাড়ির ঠিক পেছনে থাকা একজন মোটরসাইকেল চালক গাড়ির পেছনে পেছনে গেছেন। চিৎকার করেছেন। তার চিৎকারে গাড়ি নিয়েও একজন অনুসরণ করেছেন। গাড়িটি একটু ঘুরে সংসদ ভবনের সামনে ন্যাম বিল্ডিংয়ে প্রবেশ করেছে। পেছনে যাওয়া মোটরসাইকেল এবং গাড়ি চালকও পেছন পেছন ন্যাম বিল্ডিংয়ের গেটের ভেতরে ঢুকে পড়েছেন।
মোটরসাইকেল চালক এবং গাড়ি চালকের ভাষ্য অনুযায়ী, গাড়ি থেকে যিনি নেমেছেন তাকে অন্যরা ‘শাবাব’ বলে ডেকেছেন। শাবাব গাড়ি থেকে নেমে বলেছেন, ‘এটা আমার এলাকা। কে কে আসবি, আয়।’
মোটরসাইকেল চালক জানিয়েছেন, এই দৃশ্য তিনি মোবাইলে ধারণ করেছিলেন। শাবাব সেখানে থাকা অন্যদের সঙ্গে নিয়ে, জোর করে ভয় দেখিয়ে মুছে দিয়েছেন। চর-ঘুষিও মেরেছেন তাকে। মুখ বন্ধ রাখার শর্তে, অর্থও দিতে চেয়েছেন।
২. সেলিম ব্যাপারীর লাশের সঙ্গে গাড়ির ঢাকা মেট্রো ঘ-১৩৭৬৫৫ নাম্বার প্লেটটিও পড়ে ছিল লাশের পাশে। এই নাম্বার প্লেটটি তথ্য সূত্র হিসেবে অনেক কিছু সামনে নিয়ে এসেছে। গণমাধ্যম কর্মীরা পরের দিনই বিআরটিএ থেকে গাড়ির মালিকের নাম বের করে প্রকাশ করেছেন। কোনো কোনো গণমাধ্যম প্রত্যক্ষদর্শীদের বর্ণনা এবং নিজস্ব অনুসন্ধানের ভিত্তিতে গাড়ি চালকের নামও প্রকাশ করেছেন।
বিআরটিএ সূত্রানুযায়ী গাড়িটির মালিকের নাম কামরুন্নাহার শিউলি। তিনি নোয়াখালীর কবিরহাট উপজেলা চেয়ারম্যান। তার স্বামী একরামুল হক চৌধুরী। তিনি নোয়াখালী-৪ আসনের আওয়ামী লীগ দলীয় সংসদ সদস্য। তাদের সন্তান শাবাব চৌধুরী।
৩. পরিবারের পক্ষ থেকে গাড়িটির মালিকানা স্বীকার কথা হয়েছে। কিন্তু দাবি করেছেন, গাড়িটি শাবাব চৌধুরী চালাচ্ছিলেন না। চালাচ্ছিলেন নুরুল আলম নামক তাদের একজন চালক। উল্লেখ যে, বলা হয়েছে তাদের গাড়ি চালকের সংখ্যা পাঁচ ছয় জন। এবং চালক আলমকে তারা খুঁজে পাচ্ছেন না।
প্রত্যক্ষদর্শীদের বর্ণনা, পিছু নেওয়া মোটরসাইকেল ও গাড়ি চালকের বক্তব্যের সঙ্গে পরিবারের বক্তব্য মিলছে না। এখন পর্যন্ত পাওয়া তথ্যের উপর ভিত্তি করে পুলিশ নিশ্চয়ই এই সিদ্ধান্তে পৌঁছে যাবে না যে, চালক হিসেবে শাবাব চৌধুরীই গাড়ি চাপা দিয়ে সেলিম ব্যাপারীকে হত্যা করেছেন।
সিদ্ধান্তে পৌঁছানোর জন্যে প্রয়োজন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর তদন্ত।
৪. যাবতীয় প্রশ্ন ‘তদন্ত’ বিষয়টিকে নিয়েই।
দুর্ঘটনা ঘটেছে ১৯ জুন মঙ্গলবার রাত সাড়ে ১০টায়। আজ ২৩ জুন সকাল সাড়ে ১০টা (যখন লিখছি)। গাড়িটির মালিক কে, পুলিশ এখনও তা নিশ্চিত হতে পেরেছে কি না, তা পরিষ্কার করে বলেনি। কিছুটা অস্বচ্ছভাবে বলেছে, তথ্য পেয়েছে, অনুসন্ধান চলছে।
‘চার দিনেও ঘাতক গাড়ি (ঢাকা মেট্রো ঘ-১৩-৭৬৫৫ নম্বর) জব্দ করেনি পুলিশ।’ (জনকণ্ঠ,২৩ জুন ২০২৮)
বিআরটিএ গণমাধ্যমকে যা নিশ্চিত করেছে ২০ জুন। আর নিশ্চিত হতে না পারায়, পুলিশ এখনও গাড়িটি জব্দ করেনি।
পুলিশ বলছে গাড়ি নয়, চালককে খুঁজছে তারা। সাধারণভাবে জানি, মামলা বা তদন্তের ক্ষেত্রে চালক যেমন গুরুত্বপূর্ণ, আলামত হিসেবে দুর্ঘটনা ঘটানো গাড়িও কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। গাড়িটি এর মধ্যে মেরামত করে ফেলা হলে, আলামত নষ্ট হবে। প্রমাণ করা দুরূহ হয়ে যাবে।
পুলিশ বলেছে, ঘাতককে ধরার জন্যে অভিযান চলছে।
কে ঘাতক, কাকে ধরার জন্যে অভিযান চলছে? পরিবারের দাবি অনুযায়ী চালক আলমকে?
যদি তাই হয়, পরিবার বলল আলমের কথা, পুলিশ তার পেছনে হয়তো ছুটছে। পেছনে যাওয়া মোটরসাইকেল ও গাড়ি চালক যা বললেন, তার ভিত্তিতে পুলিশ নীরব কেন? তারা সত্যি বলছেন, পুলিশ তা মনে নাও করতে পারে। কিন্তু সত্যতা নিশ্চিত হওয়া বা যাচাইয়ের জন্যে সাধারণভাবে যা করার কথা পুলিশ কী তা করছে?
ক. চার দিনেও পুলিশ বিআরটিএ থেকে গাড়ির মালিকের নাম বের করেছে বা সেই অনুযায়ী তদন্ত করছে, তা পরিষ্কার করে বলেনি। কারণ কী? গণমাধ্যম যা একদিনে পারে, পুলিশ তা চার দিনে পারে না?
খ. ন্যাম ভবনের গেটে সিসিটিভি সব সময় সক্রিয় থাকে। নিরাপত্তার ব্যবস্থা বেশ কঠোর। দুর্ঘটনা ঘটানো গাড়িটি যখন ন্যাম ভবনের গেট দিয়ে প্রবেশ করে, তখন চালকের আসনে কে ছিলেন তা স্পষ্ট দেখা যাওয়ার কথা সিসিটিভি ফুটেজে। সংসদ ভবনের সামনে মানিক মিয়া এভিনিউ ও তার আশেপাশের এলাকাতেও সিসিটিভি আছে।
গ. পেছনে যাওয়া মোটরসাইকেল চালক ও গাড়ি চালক সত্য বলছেন কিনা, তা যাচাইয়ের জন্যে সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য প্রমাণ সিসিটিভি ফুটেজ। কিল-ঘুষি, মোবাইলের দৃশ্য মুছে ফেলা, শাবাবসহ অন্যদের দৃশ্য, সবই সিসিটিভি ফুটেজে থাকার কথা।
ঘ. দুর্ঘটনার চার দিন পরও পুলিশ সিসিটিভি ফুটেজ সংগ্রহ করেছে কি না,তা নিয়ে বিভ্রান্তি দূর হচ্ছে না। একটি সূত্র বলছে, পুলিশ সিসিটিভি ফুটেজ সংগ্রহ করেছে। সংগ্রহ করেনি, এমন কথাও শোনা যাচ্ছে।
২১ জুন প্রথম আলোকে পুলিশের মিরপুর বিভাগের উপ-কমিশনার মাসুদ আহাম্মদ বলেছিলেন, ‘গাড়িটি নোয়াখালীর সাংসদের স্ত্রী কামরুন্নাহারের। ঘটনাস্থলের আশপাশ থেকে সিসিটিভি ফুটেজ সংগ্রহ করা হয়েছে। সিসিটিভি ফুটেজে চালক শনাক্ত হওয়ার পর তাকে গ্রেপ্তার করা হবে।’
আবার আজ ২৩ জুন জনকণ্ঠ লিখেছে, ‘সেখানকার সিসিটিভির ফুটেজও সংগ্রহ করা হয়নি।’
সিসিটিভি ফুটেজ বিষয়ক সময়ক্ষেপণ বা নীরবতার কারণ কী?
৫. অডি গাড়ি ঢাকা শহরে খুব বেশি নেই। প্রচলিত গাড়ির চেয়ে অডি বেশ দামি গাড়ি। তদন্তের গতি- প্রকৃতি অনুযায়ী ধারণা করা যায়, গাড়ির মালিকানাও নিশ্চিত হওয়া যেত না, যদি না নাম্বার প্লেট পাওয়া যেত। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এই আশঙ্কাও সামনে আসছে, সিসিটিভি ফুটেজ আদৌ পাওয়া যাবে কি না! পাওয়া যাওয়া ফুটেজে ওই কয়েক মিনিটের দৃশ্য থাকবে কি না। আদৌ ওই কয়েক মিনিট রেকর্ড হয়েছে কি না!
‘চালক দুর্ঘটনার পর কিছু দূর গিয়ে, গাড়ি থেকে নেমে পালিয়ে গেছেন। তারপর শাবাব গাড়ি চালিয়ে এসেছেন’- এমন একটি গল্পের আভাস পাওয়া যাচ্ছে। ‘শাবাব বাড়িতেই ছিল’- মা কামরুন্নাহার শিউলির এমন বক্তব্যের পর, গল্পটি ভিত্তি পাওয়ার সম্ভাবনা কম।
তবে অর্থ- ক্ষমতার প্রভাব থাকলে তো সবই সম্ভব। বিচার- তদন্ত কী বা কেমন হবে, সেলিম ব্যাপারীর পরিবার সেই ধারণা পেয়ে গেছে। একমাত্র উপার্জনক্ষম অভিভাবককে হারিয়ে, পরিবারটি তদন্ত- বিচারের পেছনে ছুটবে, না আপোষ প্রস্তাবে রাজি হবে? ধারণা করা খুব বেশি কষ্টকর নয়।
তারপরও আমরা বলব, রাষ্ট্রের নীতি- নির্ধারকরা বলবেন, তদন্ত- বিচার- আইনের শাসন ‘অপরাধী যেই হোক, রক্ষা পাবে না’!
Comments