‘...আমরা কী অন্যায় করেছি?’

একজন শিক্ষার্থী - একজন ছাত্রী, দশ বারোজন দ্বারা পাশবিক নিপীড়নের শিকার হলেন শহীদ মিনারে! সবার সামনে, ক্যামেরার সামনে। ওড়না টেনে নেওয়া হলো। কিল-ঘুষি-লাথি এবং একজন ছাত্রীকে যত রকমের নির্যাতন সম্ভব, সবই করা হলো। নারী শিক্ষার্থী আর্তনাদ করে বলছিলেন, তারা বলে ‘ধর্ষণ করবে- আমরা কী অন্যায় করেছি?’ শহীদ মিনারের আকাশে বাতাসে প্রতিধ্বনিত হচ্ছিল তার আর্তনাদ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের কান পর্যন্ত তা পৌঁছায়নি।
ঢাকায় কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের সামনে কোটা সংস্কার আন্দোলনে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের হাতে নারী নিগ্রহ। ছবি: সংগৃহীত

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়র প্রায় ৩৫ হাজার শিক্ষার্থী ২ হাজার শিক্ষক, মানে ৩৭ হাজার পরিবারের সরাসরি সম্পৃক্ততা। যারা আক্রান্ত হচ্ছেন, তারা কোনো না কোনোভাবে আপানার আমার পরিবারেরই কেউ। ভাবা যায় না এভাবে?

একজন শিক্ষার্থী - একজন ছাত্রী, দশ বারোজন দ্বারা পাশবিক নিপীড়নের শিকার হলেন শহীদ মিনারে! সবার সামনে, ক্যামেরার সামনে। ওড়না টেনে নেওয়া হলো। কিল-ঘুষি-লাথি এবং একজন ছাত্রীকে যত রকমের নির্যাতন সম্ভব, সবই করা হলো। নারী শিক্ষার্থী আর্তনাদ করে বলছিলেন, তারা বলে ‘ধর্ষণ করবে- আমরা কী অন্যায় করেছি?’ শহীদ মিনারের আকাশে বাতাসে প্রতিধ্বনিত হচ্ছিল তার আর্তনাদ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের কান পর্যন্ত তা পৌঁছায়নি।

হ্যাঁ, মেয়েটি সরাসরি ধর্ষণের শিকার হয়নি। ‘ধর্ষণ করা হবে’- হুমকি পেয়েছে। যে দশ বারোজন নিপীড়ন করল তারা কারা? তারাও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী।

একটু কল্পনা করুন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রীকে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা শারীরিকভাবে নিপীড়ন করছে বহিরাগতদের সঙ্গে নিয়ে। ধর্ষণের এবং গুমের হুমকি দিচ্ছে। পত্রিকার পাতায়, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এবং টেলিভিশনে দেখেছেন সেই দৃশ্য।

তা দেখেই স্থির থাকতে পারছেন না। বলছেন, তাই বলে এভাবে নির্যাতন!

চোখ বন্ধ করুন। নিপীড়িত মেয়েটির জায়গায় নিজের মেয়ে বা স্ত্রী বা বোনকে ভাবুন। ভাবতে পারছেন?

আপনি যা ভাবতে পারছেন না, শহীদ মিনারে তা ঘটিয়েছে ছাত্রলীগের নেতা- কর্মীরা। সুনির্দিষ্ট করে তাদের নাম, পদ-পদবি সবকিছু সবার জানা।

শুধু নিপীড়ন নয়, ঢাকা এবং জাহাঙ্গীরনগর থেকে কমপক্ষে দুইজনকে তুলে নিয়ে গেছে, গুম করার হুমকি দিয়েছে। শহীদ মিনার থেকে মোটরসাইকেলে ফারুককে তুলে নিয়ে গেছে ছাত্রলীগ। তার সন্ধান পাচ্ছিলেন না পরিবার। পরে জেনেছেন, ফারুক ডিবির হেফাজতে আছেন।

শাহবাগ মোড়ে যাকে মনে হয়েছে, তাকে মারধর করে পুলিশের হাতে দিয়েছে ছাত্রলীগ। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে লাঠি দিয়ে পিটিয়ে, চাপাতি দিয়ে কুপিয়ে জখম করেছে।

যাদেরকে ক্ষত-বিক্ষত করেছে, তাদের নামেই মামলা দিয়েছে এবং পুলিশ তাৎক্ষণিকভাবে গ্রেপ্তার করেছে, রিমান্ডে নিয়েছে।

যারা পিটিয়ে ক্ষতবিক্ষত করল- তুলে নিয়ে গেল, কুপিয়ে-পিটিয়ে রক্তাক্ত করল, নারী নিপীড়ন করল, ধর্ষণ-গুমের হুমকি দিল, তারা সম্পূর্ণ নিরাপদ থেকে গেল। কারণ তারা ছাত্রলীগ। তারা জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ধর্ষণের সেঞ্চুরি করবে, শহীদ মিনারে ছাত্রী নিপীড়ন করবে, ধর্ষণ করতে চাইবে, ভিসির কার্যালয়ের সামনে ছাত্রীদের যৌন নিপীড়ন করবে, কিছুই প্রমাণ হবে না। সর্বোচ্চ ধর্ষক সেঞ্চুরিয়ান মানিকের মতো দু’একজনকে হয়ত বিদেশে পাঠিয়ে দেওয়া হবে।

২.

আপনি, হ্যাঁ আপনাকে বলছি। ভাবছেন, আপনার স্ত্রী-সন্তান-বোন নিরাপদে আছেন। আপনার তো কিছু হয়নি। কতক্ষণ থাকবেন নিরাপদ? চোখে যা দেখছেন, লিখছেন বা বলছেন তার উল্টোটা। নির্বাচন হয়ে যায়, মানুষের ভোটের অধিকার কোথায় গিয়ে দাঁড়িয়েছে, সবই জানেন। সত্য চাপা দিয়ে বলেন, অসত্যটা। যে মেয়েটি সাধারণ ছাত্রীদের নির্যাতন করে ক্ষুব্ধ করে তুলেছিল, তাকে জুতার মালা পরিয়ে অসম্মান করায়, আপনার হৃদয় ভেঙে গিয়েছিল। গলার রগ ফেটে যেন রক্ত ঝরছিল। একটি অন্যায় বা অপরাধকে আরেকটি অন্যায় দিয়ে জাস্টিফাই করা যাবে না। আপনার সেই অবস্থানকে সমর্থন করছি। কিন্তু জুতার মালা পরানোয় আপনি যতটা ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন, নিপীড়ন-ধর্ষণের হুমকির পর আপনি তার চেয়েও বেশি নীরব- শীতল কেন? বিবেক ঘুমিয়ে কেন? ধর্ষণের হুমকি পাওয়া মেয়েটির আর্তনাদ আপনার কান পর্যন্ত পৌঁছাচ্ছে না?

মেয়েরা মেয়েটিকে জুতার মালা পরিয়েছিল। শহীদ মিনারে দশ-বারোজন পুরুষ মিলে একজন নারীকে নিপীড়ন করল, শারীরিকভাবে নির্যাতন করল। জুতার মালা পরানোর ভিডিও চিত্র ছিল, শহীদ মিনারের নিপীড়নেরও ভিডিও চিত্র আছে। অথচ আপনার সেই বিবেক এখন আর জাগছে না।

৩.

বিশ্ববিদ্যালয়ে অতি সম্মানীয় একটি পদ আছে। পদটির নাম উপাচার্য। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েও এই পদ আছে, পদে একজন উপাচার্যও আছেন। মাননীয় উপাচার্য শিক্ষার্থীদের তো বটেই, পুরো বিশ্ববিদ্যালয় তথা শিক্ষকদেরও অভিভাবক। গত দুইদিন ধরে তার বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রছাত্রীরা নিপীড়ন-নির্যাতনের শিকার হলেন। ছাত্রীদের শারীরিকভাবে নির্যাতন করা হলো, সম্মানিত-শ্রদ্ধেয় অভিভাবক উপাচার্যের প্রতিক্রিয়া জানা গেল না।

প্রক্টর নামক আরেকটি পদ আছে, পদে একজন মানুষও আছেন। সরাসরি শিক্ষার্থীদের দেখে রাখার দায়িত্ব এই প্রক্টরেরই। দায়িত্ব নিয়েই যখন ঘুষি দিয়ে একজন শিক্ষকের নাক ফাটিয়ে দিলেন, তখন তাকে করিৎকর্মাই মনে হয়েছিল! গত তিনদিনের যে তাণ্ডব সারা বাংলাদেশের মানুষ, সারা পৃথিবীতে বসবাসরত বাংলাদেশের মানুষ, জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম যা দেখাল, প্রক্টর তার কোনো কিছুই দেখলেন না, জানলেন না।

সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠে প্রায় দুই হাজার শিক্ষক আছেন। শিক্ষক সমিতি আছে, শিক্ষক নেতা আছেন। তাদের কোনো কথা নেই, প্রতিক্রিয়া নেই। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষক খালি পায়ে হেঁটে তার বিভাগে গিয়ে নিপীড়নের প্রতিবাদ করতে চাইছেন। প্রক্টরিয়াল বডি তা করতে দিতে রাজি না। বাধা দেওয়া হচ্ছে, খালি পায়ে হাঁটা যাবে না। কুপিয়ে- পিটিয়ে জখম করলে সমস্যা নেই, খালি পায়ে প্রতিবাদ করলে বিশ্ববিদ্যালয়ের ইজ্জত চলে যায়!

৪.

বাংলাদেশে নারী আছেন, নারী নেত্রী আছেন। নারী নির্যাতন নিয়ে তাদের কোনো বক্তব্য নেই।

বাংলাদেশে ‘মানবতা’ আছে, তবে তা রোহিঙ্গাদের জন্যে। গরিব নুরুল বা রাশেদদের জন্যে মানবতা নেই। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের শিক্ষার্থী, গরিবের সন্তান লাথি- ঘুষিতে মুমূর্ষু হয়ে ঢাকা মেডিকেলের বারান্দায় পড়ে থেকেছেন। জনগণের টাকায় চলা হাসপাতালে চিকিৎসা পাননি। বেসরকারি আনোয়ার মেডিকেলে এসেছেন, মাঝ রাতে বের করে দেওয়া হয়েছে পুলিশের ভয়ে। শিক্ষক-নাগরিক সমাজ নীরব, নিশ্চুপ। তারা হয়ত আর্জেন্টিনার পরাজয় আর ব্রাজিলের বিজয়ের কারণ বিশ্লেষণ করছেন!

৫.

প্রত্যক্ষদর্শী প্রতিবেদকের তথ্যে দ্য ডেইলি স্টার লিখেছে, শহীদ মিনারে শিক্ষার্থীরা যখন প্রতিবাদে জড়ো হয়েছিলেন, তখন সেখানে পুলিশ ছিল। দশ বারোটি মোটরসাইকেল যোগে ছাত্রলীগের নেতারা এলেন। তাদের আসা দেখে পুলিশ চলে গেল।

একসময় পরীক্ষায় ট্রান্সলেশন আসত, ‘ডাক্তার আসিবার পর রোগী মারা গেল’। এখন ট্রান্সলেশন আসবে, ‘ছাত্রলীগ আসিবার পর পুলিশ চলিয়া গেল। ছাত্রলীগ নিরীহ শিক্ষার্থীদের উপর ঝাঁপাইয়া পড়িল।’

গরিবের সন্তান নুরুল বা রাশেদরা নির্যাতনে ক্ষত-বিক্ষত হবে, গ্রেপ্তার হয়ে রিমান্ডেও যাবে। নুরুল, রাশেদদের নির্যাতন-নিপীড়ন করার জন্যে, একদল গরিবের সন্তানদের লাঠিয়ালে পরিণত করা হয়েছে। ক্ষমতা টিকিয়ে রাখার জন্যে সব যুগে এই লাঠিয়াল বাহিনী অপরিহার্য ছিল।

নুরুল, রাশেদদের বাবা-চাচারা মুক্তিযুদ্ধ করেছিলেন। দেশের শাসকরা এখন তাদের বলছেন, রাজাকার-মুক্তিযুদ্ধবিরোধী। কারণ ক্ষমতা তাদের হাতে। নুরুল, রাশেদদের পরিণতি কী হবে, জানি না। পরিণতি ভেবে আতঙ্কিত হওয়ার কারণ আছে। তবে এই আতঙ্ক শুধু নুরুলদের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকবে না। যারা অন্যায়ের পক্ষে অবস্থান নিয়ে অসত্য বলছেন, তাদের জীবনে-পরিবারেও আসবে। বলতে পারেন, এটা প্রকৃতির নিয়ম। ধর্ষণের হুমকি দল দেখে দেওয়া হবে না, ধর্ষণ দল দেখে করা হবে না। জাহাঙ্গীরনগরের সেই মানিকের কথা আরেকবার স্মরণ করুন।

যে সমাজ-দেশ নির্মাণ করছেন, তার ফলাফল ভোগ করতে হবে, আপনাকেও ভোগ করতে হবে। বিচ্ছিন্নভাবে ভালো থাকা যায় না, ভালো থাকতে পারবেন না।

নুরুলদের রক্ত ঝরিয়ে কোটা সংস্কার কমিটি হলো, নির্যাতন এখনো বন্ধ হলো না। হয়ত আন্দোলনের সুফল ভোগ করবেন সবাই। অতীতেও গরিব- দিনমজুর নুরুল বা রাশেদদের বাবা- চাচাদেরই বেশি মূল্য দিতে হয়েছিল, স্বাধীন দেশেও মূল্য তারা বা তাদের সন্তানরাই বেশি দিচ্ছেন।

Comments

The Daily Star  | English

Abu sayed’s death in police firing: Cops’ FIR runs counter to known facts

Video footage shows police shooting at Begum Rokeya University student Abu Sayed, who posed no physical threat to the law enforcers, during the quota reform protest near the campus on July 16. He died soon afterwards.

7h ago