হাতুড়ির আঘাতে ‘জীবনের আশা ছেড়ে দেওয়া’ তরিকুল!

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান ফটকের সামনের রাস্তায় ফেলে তরিকুলকে হাতুড়ি দিয়ে পেটায় ছাত্রলীগের নেতা আব্দুল্লাহ আল মামুন। ইনসেটে হাসপাতালে তরিকুল। ছবি: স্টার

ডান পায়ের ভাঙা দুই হাড়, মাথায় আটটি সেলাই ও সারা শরীরে মারের ক্ষত নিয়ে যন্ত্রণায় দিন যাচ্ছে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র তরিকুল ইসলামের।

ছাত্রলীগের হামলার কথা বলতে গিয়ে হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে তরিকুল বলছিলেন, ‘ওদেরকে অনুরোধ করছিলাম, আর যেন না মারে। কেউ কথা শুনল না। যাদের হাতে লাঠি ছিল সবাই পেটাচ্ছিল। খুব কাছে থেকে যেন দেখছিলাম মৃত্যুকে।কী নির্দয়ভাবেই না পেটাচ্ছিল আমাকে! কোনো মানুষ মানুষকে পেটাতে পারে এভাবে, কল্পনাও করিনি কোনোদিন।এক পর্যায়ে জীবনেরই আশা ছেড়ে দিয়েছিলাম।’

কথা বলার শক্তি নেই, ক্ষীণ গলায় থেমে থেমে কথাগুলো বলছিলেন তরিকুল। একটু জোরে কথা বলার চেষ্টা করলেই যন্ত্রণায় কুঁকড়ে যাচ্ছিল তার শরীর।

কোটা সংস্কারের দাবিতে বিক্ষোভের সময় গত সোমবার তরিকুলকে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান গেটের সামনে রাস্তায় ঘিরে ধরে পেটায় ছাত্রলীগের কয়েকজন নেতাকর্মী। গণমাধ্যমে প্রকাশিত ছবিতে দেখা যায়, ছাত্রলীগের বেশ কয়েকজন মিলে যখন লাঠি নিয়ে তরিকুলকে পেটাচ্ছিল তখন আব্দুল্লাহ আল মামুন লোহার হাতুড়ি দিয়ে তার পিঠে ও পায়ে আঘাত করে। কাঠের উপর যেভাবে পেরেক পোঁতা হয়, সেভাবে তরিকুলের শরীরে আঘাত করছিল হাতুড়ি দিয়ে। তরিকুল এই আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়া বাংলাদেশ সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদের যুগ্ম আহ্বায়ক।

লাঠি- হাতুড়ির আঘাতে যন্ত্রণায় কাতরানো তরিকুলকে পুলিশ ও কয়েকজন সাংবাদিক রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে গিয়ে ভর্তি করে। তার ভাঙা পা-টি উরু পর্যন্ত প্লাস্টার করে দেওয়া হয়েছে। ডাক্তাররা এখন তার শারীরিক অবস্থা পর্যবেক্ষণ করছেন।

তরিকুলের অবস্থা সম্পর্কে হাসপাতালের অর্থোপেডিক সার্জারি বিভাগের প্রধান এমএকে শামসুদ্দিন জানান, তার ভাঙা হাড় জোড়া লাগতে অন্তত তিন মাস সময় লাগবে।

হাতুড়ি নিয়ে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের দিকে ধেয়ে যাচ্ছে ছাত্রলীগের নেতা আব্দুল্লাহ আল মামুন। ছবি: স্টার

‘চার সপ্তাহ পায়ের প্লাস্টার রাখা হবে। তার সারা শরীরে যন্ত্রণা হচ্ছে। এখন সম্পূর্ণ বিশ্রাম দরকার তার।’

তরিকুলকে হাতুড়ি দিয়ে পেটানো ছাত্রলীগের উপ সম্পাদক মামুনকে গতরাতে ফোন করা হলে সাংবাদিক বুঝতে পেরেই তিনি ফোন রেখে দেন।

তরিকুল ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগের মাস্টার্সের ছাত্র। তার বাড়ি গাইবান্ধায়। তিন ভাইবোনের মধ্যে তরিকুল দ্বিতীয়। সেদিনের কথা স্মরণ করতে গিয়ে বলছিলেন, পূর্ব ঘোষিত পতাকা মিছিলে অংশ নেওয়ার জন্য তিনি ক্যাম্পাসে যাচ্ছিলেন। মেইন গেটের সামনে গিয়ে দেখেন গেট বন্ধ করে রাখা হয়েছে। গেটের সামনেই একটি জটলা ছিল। পুলিশ তাদের ঘিরে রেখেছিল।

তরিকুল বলেন, জটলা করে থাকা ছাত্রদের আন্দোলনকারী ভেবে সামনে গিয়ে দেখি ছাত্রলীগের নেতাকর্মী। তারা আমাদের ধাওয়া করে। সেখান থেকে পালানোর চেষ্টা করলেও কিছুক্ষণের মধ্যেই ধরে ফেলে ওরা। এর পরই ঘিরে ধরে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা পেটাতে শুরু করে। এসময় কেউ একজন বাঁশের লাঠি দিয়ে তার মাথায় আঘাত করে। সারা শরীরে কত মার পড়েছে আর স্মরণ করতে পারছিলেন না তিনি।

‘মারের চোটে রাস্তায় পড়ে যাই... চিৎকার করে ওদের থামতে বলছিলাম। কিন্তু আর উঠে দাঁড়াতে পারিনি।’

তিনি জানান, এর পরই কেউ একজন ভারি কিছু দিয়ে তার ডান পায়ে আর পিঠে আঘাত করতে শুরু করে।

‘ওটা লাঠি মনে হচ্ছিল না। ভাবলাম রড বা এধরনের ভারি কিছু হবে। প্রথম আঘাতেই চিৎকার করে উঠি। দ্বিতীয় বারের আঘাতে পা-টা ভেঙে গেল মনে হয়েছিল। যন্ত্রণা সহ্য করতে পারছিলাম না।মনে হচ্ছিল আর বাঁচব না।মারা যাওয়াও হয়ত সহজ ছিল, এই কষ্ট সহ্য করার চেয়ে।কাকুতি- মিনতি করেছি বাঁচার জন্যে। তাদের মন একটুও গলেনি।’

এর পরও থামেনি হামলাকারীরা। পুরো ঘটনাটির ছবি ও ভিডিও রয়েছে দ্য ডেইলি স্টারের কাছে।

এক্স-রে রিপোর্টে দেখা যাচ্ছে, তরিকুলের ডান পায়ের দুটি হাড়ই ভেঙে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে।

তরিকুল বলেন, ‘হামলার সময় সেখানেই পুলিশ ছিল। কিন্তু তারা থামায়নি। পুলিশ চাইলেই আমাকে এভাবে মারতে পারত না।’

তরিকুলের সঙ্গে কথা বলার সময় পুলিশের কনস্টেবল নাজমুল ও হাবিলদার হাসিনুর হাসপাতাল কক্ষে ঢুকে এই প্রতিবেদকে তাৎক্ষণিকভাবে সেখান থেকে বেরিয়ে যেতে বলেন। তারা বলেন, তরিকুল পুলিশ হেফাজতে রয়েছে তাই তার সঙ্গে কথা বলতে হলে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের অনুমতি লাগবে। এ ব্যাপারে মতিহার থানার ওসি শাহাদাত হোসেনের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি তরিকুলের পুলিশ হেফাজতে থাকার কথা অস্বীকার করেন।

হাতুড়ির আঘাতে ভেঙে যাওয়া তরিকুলের ডান পায়ের দুই হাড়ের এক্স-রে ছবি। ছবি: স্টার

Comments

The Daily Star  | English

Bangladesh Bank signals market-based exchange rate regime

The central bank will allow the exchange rate of the dollar to be determined by market forces

51m ago