বিশ্বকাপের পরপর খেলোয়াড় কিনলেই লোকসান!
![Hirving Lozano Hirving Lozano](https://tds-images-bn.thedailystar.net/sites/default/files/styles/big_202/public/feature/images/2018-06-17t154929z_26653292_rc1307d6d280_rtrmadp_3_soccer-worldcup-ger-mex.jpg?itok=Mh-snaOP×tamp=1531125991)
গত বিশ্বকাপের কথা মনে আছে নিশ্চয়ই? নবাগত হিসেবে পুরো টুর্নামেন্টে আলো ছড়িয়েছিলেন হামেস রদ্রিগেজ, জিতেছিলেন গোল্ডেন বুটও। বিশ্ব ফুটবলের নতুন সেনসেশন এসে গেছেন, এরকম মাতামাতিও হয়েছে রদ্রিগেজকে নিয়ে। নতুন এই সেনসেশনকে সই করানোর সুযোগটা সবার আগে লুফে নেয় রিয়াল মাদ্রিদ, বিশ্বকাপের পরপরই তাড়াহুড়ো করে প্রায় ৬৩ মিলিয়ন পাউন্ডে মোনাকো থেকে নিয়ে আসে হামেসকে।
সেই হামেস রিয়ালে থাকাকালীন তিন মৌসুমের বেশিরভাগ সময়ই কাটিয়েছেন বেঞ্চ গরম করে। তিন মৌসুমে ম্যাচ খেলেছেন সর্বসাকুল্যে ৭৭ টি, গোল করেছেন ২৮ টি। অনেক আলোড়ন তুলে কিনে আনা নতুন সেই সেনসেশনকে গত মৌসুমে বায়ার্ন মিউনিখের কাছে ধারেই পাঠিয়ে দিয়েছে রিয়াল।
শুধু হামেসের ক্ষেত্রে নয়, এমন ঘটনা ঘটে থাকে প্রায় প্রতিটি বিশ্বকাপের পরপরই। হুট করে কোন একজন খেলোয়াড় বিশ্বকাপে ভালো পারফর্ম করলেই নামি দামি ক্লাবগুলো সব উঠেপড়ে লাগে তাকে সই করানোর জন্য। উচ্চমূল্য দিয়ে তাকে কিনেও আনে। কিন্তু বিশ্বকাপের পরে সেই খেলোয়াড় আর প্রত্যাশামাফিক পারফর্ম করতে পারেন না, তখন দল থেকে নীরবে বিদায় নিতে হয় তাকে।
১৯৯২ সালের জুলাইতে অনেক আশা করে ড্যানিশ মিডফিল্ডার জন জেনসেনকে কিনে এনেছিল আর্সেনাল। কারণ, কিছুদিন আগেই ইউরোর ফাইনালে জার্মানির বিপক্ষে দূরপাল্লার দুর্দান্ত এক শটে গোল করে ডেনমার্ককে শিরোপা জিতিয়েছেন জেনসেন। আর্সেনালের তখনকার ম্যানেজার জর্জ গ্রাহাম বলেছিলেন, জেনসেন এমন একজন ফুটবলার যে কি না মিডফিল্ডার হয়েও নিয়মিত গোল করতে পারে।
কিন্তু গ্রাহামের এমন ধারণা সত্যি প্রমাণিত হয়নি, অন্তত জেনসেন যতদিন আর্সেনালে ছিলেন ততদিন। নিয়মিত গোল করবেন এমন আশায়ই জেনসেনকে কিনে এনেছিল আর্সেনাল, কিন্তু গানারদের হয়ে বছরের পর বছর, ম্যাচের পর ম্যাচ গোলশূন্য থেকেছেন তিনি। চার বছর পর ১৯৯৬ সালে যখন জেনসেন আর্সেনাল ছাড়লেন, তার নামের পাশে মাত্র এক গোল! এমনকি আর্সেনাল ভক্তরা টি-শার্টও ছাপিয়েছিলেন এমনটা লিখে, ‘আমরা বেঁচেছিলাম সে সময়ে, যখন জেনসেন গোল করেছিলেন!’
বিশ্বকাপের পরপরই খেলোয়াড় কেনার এই ফাঁদে পড়েছিলেন কিংবদন্তি অ্যালেক্স ফার্গুসনও। ১৯৯৬ ইউরোর পারফরম্যান্স দেখে কিনে এনেছিলেন জর্দি ক্রুইফ ও কারেল পোবোরস্কিকে, যাদের কেউই ক্লাবে এসে মন ভরাতে পারেননি। ফার্গুসন এমন হওয়ার পেছনে একটা কারণ অনুমান করেছিলেন, ‘কখনো কখনো বিশ্বকাপ ও ইউরোর জন্য খেলোয়াড়েরা নিজেদের বিশেষভাবে অনুপ্রাণিত করে থাকে। কিন্তু বিশ্বকাপ শেষে ওই অনুপ্রেরণাটা আর থাকে না, ফলে ক্লাবে ওই মানের পারফরম্যান্স দেখাতে পারেন না তারা।’
আসলে বিশ্বকাপ কিংবা ইউরোর মতো টুর্নামেন্টগুলো এত স্বল্প সময়ে ও স্বল্প ম্যাচে শেষ হয়ে যায় যে, একজন খেলোয়াড়ের সম্পর্কে সিদ্ধান্ত নেয়ার জন্য এটি খুবই অপর্যাপ্ত। আপনি যদি এই বিশ্বকাপের পারফরম্যান্সের দিকেই তাকান, কলম্বিয়ার হুয়ান কুয়াদ্রাদোর পারফরম্যান্সকে আপনার লিওনেল মেসির পারফরম্যান্সের চেয়ে ভালো মনে হতে পারে, কিংবা ইয়েরি মিনাকে সার্জিও রামোসের চেয়ে কার্যকরী ডিফেন্ডার বলে মনে হতে পারে। ফলে বিশ্বকাপের পারফরম্যান্স দেখে এক প্রকার ভ্রমের মধ্যে পড়ে যায় ক্লাবগুলো। এই যে জাপানের বিপক্ষে শেষ মুহূর্তে গোল করে বেলজিয়ামকে বাঁচিয়েছেন নাসের শাদলি, তিনি কিন্তু টটেনহাম কিংবা ওয়েস্ট ব্রমউইচ অ্যালবিয়নের হয়ে এমন আহামরি কোন পারফরম্যান্স দেখাননি। একটি বিশ্বকাপের পারফরম্যান্স দিয়ে তাই অনেক সময়ই একজন খেলোয়াড়কে সঠিকভাবে যাচাই করা সম্ভব হয়ে ওঠে না।
২০১০ বিশ্বকাপে ঘানার হয়ে ভালো পারফরম্যান্স দেখানোর পর ক্লাব রেকর্ড ১৩ মিলিয়ন পাউন্ড দিয়ে আসামোয়া জিয়ানকে কিনে নিয়েছিল ইংলিশ ক্লাব সান্ডারল্যান্ড। পারফরম্যান্স আশানুরূপ না হওয়ায় এক বছর পরই তাকে আরব আমিরাতের এক দলের কাছে ছেড়ে দিয়েছিল ক্লাবটি।
গত বিশ্বকাপে চারটি ম্যাচেই অসাধারণ পারফর্ম করেছিলেন মেক্সিকান কিপার গিলের্মো ওচোয়া। বিশেষ করে গ্রুপ পর্বে ব্রাজিলের বিপক্ষে অসাধারণ সব সেইভের পরপরই আলোচনায় আসেন তিনি। বিশ্বকাপের পরপরই তার সাথে বড় অঙ্কের চুক্তি করে স্প্যানিশ ক্লাব মালাগা। দুই বছরের মেয়াদকালে ক্লাবের হয়ে খুব কমবারই মাঠে নামার সুযোগ পেয়েছিলেন তিনি। পরে যখন গ্রানাডাতে ধারে পাঠানো হলো তাকে, স্প্যানিশ ফুটবলের সর্বোচ্চ পর্যায়ে এক মৌসুমে সর্বোচ্চ ৮২ গোল খাওয়ার রেকর্ড সঙ্গী হয়েছিল ওচোয়ার।
বিশ্বকাপের পরে কেনা খেলোয়াড়দের মধ্যে সফল হয়েছেন এমন খেলোয়াড়দের নাম বলতে গেলে কেইলর নাভাস ও লুইস সুয়ারেজের নাম আসবে। কিন্তু তাদের কেনার পেছনে বিশ্বকাপের পারফরম্যান্স যতটা না প্রভাব রেখেছে, তার চেয়ে বেশি প্রভাব রেখেছে আগের মৌসুমে ক্লাবের হয়ে তাদের পারফরম্যান্স। বিশ্বকাপের ঠিক আগের মৌসুমেই লেভান্তের হয়ে আলো ছড়িয়েছিলেন নাভাস, আর সুয়ারেজকে বার্সেলোনা কিনেছিল তখন, যখন ইতালিয়ান ডিফেন্ডার কিয়েলিনিকে কামড়ানোর অপরাধে দীর্ঘ নিষেধাজ্ঞায় ছিলেন উরুগুইয়ান এই স্ট্রাইকার।
এই বিশ্বকাপের পরপরও খুব সম্ভবত মেক্সিকোর হার্ভিং লোজানো, রাশিয়ার আলেক্সান্ডার গোলোভিনদের নিয়ে ক্লাবগুলোর মধ্যে মাতামাতি শুরু হয়ে যাবে। কে জানে, এক মৌসুমে পরেই এই মাতামাতি বিরক্তিতে পরিণত হয় কি না!
Comments