দেশের বাইরে থেকে নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে বাড্ডার অপরাধ জগৎ

দুই বছরে রাজধানীর বাড্ডা এলাকায় সন্ত্রাসীদের গুলিতে অন্তত ১২ জন নিহত হয়েছেন। সংঘবদ্ধ কয়েকটি অপরাধী চক্রের হাতে এসব হত্যাকাণ্ড ঘটেছে। দেশে বাইরে থেকে নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে এই অপরাধ জগৎ।

দুই বছরে রাজধানীর বাড্ডা এলাকায় সন্ত্রাসীদের গুলিতে অন্তত ১২ জন নিহত হয়েছেন। সংঘবদ্ধ কয়েকটি অপরাধী চক্রের হাতে এসব হত্যাকাণ্ড ঘটেছে। দেশে বাইরে থেকে নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে এই অপরাধ জগৎ।

ক্যাবল টিভির ব্যবসা, অটোরিকশা স্ট্যান্ড, পশুর হাট ও ফুটপাতের ওপর অবৈধ দোকান থেকে তোলা চাঁদার টাকা ভাগাভাগিকে কেন্দ্র করে রাজনৈতিক নেতা ও অপরাধী চক্রের মধ্যে আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে এসব খুনোখুনির ঘটনা ঘটছে।

আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সূত্রে জানা গেছে, এসব অপরাধী চক্রের সদস্যরা রীতিমত মাসিক বেতন পায়। ‘দক্ষতা ও অভিজ্ঞতা’ অনুযায়ী সর্বনিম্ন ১০ হাজার টাকা থেকে শুরু হয় বেতন। অপরাধী চক্রের হোতারা ভাইবার, হোয়াটস অ্যাপ ও আইএমও’র মাধ্যমে তাদের বাহিনীর সদস্যদের নির্দেশনার সঙ্গে হুন্ডি ও ব্যাংকের মাধ্যমে টাকা পাঠিয়ে দেয়। মাঝে মাঝে শীর্ষ অপরাধীরা মালয়েশিয়াতে বসেও আলাপ-আলোচনা করে।

পুলিশ বলছে, বাড্ডা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ফরহাদ হোসেন হত্যার পর এধরনের চাঞ্চল্যকর তথ্য তাদের হাতে এসেছে। গত ১৫ জুন প্রকাশ্য দিবালোকে অস্ত্রধারী একদল সন্ত্রাসী উত্তর বাড্ডা এলাকায় ফরহাদকে গুলি করে হত্যা করে। বাড্ডার অপরাধ জগতের সর্বশেষ শিকার আওয়ামী লীগের এই নেতা।

ফরহাদ হত্যার তদন্তকারীরা জানান, চাঁদাবাজিতে ‘বাধা হয়ে হয়ে দাঁড়ানোয়’ ফরহাদকে হত্যা করা হয়েছে।

এ প্রসঙ্গে গতকাল ডিএমপির মিডিয়া সেন্টারে সংবাদ সম্মেলনে গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) যুগ্ম কমিশনার আব্দুল বাতেন বলেন, তিন শীর্ষ সন্ত্রাসী রমজান, নরোত্তম সাহা ওরফে আশিক ও মেহেদী এই হত্যাকাণ্ডের মূল পরিকল্পনাকারী। এই তিন জনই ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের যুব সংগঠন যুবলীগের সাবেক নেতা। এদের মধ্যে রমজান ও আশিক ভারতে পালিয়ে রয়েছে, আর মেহেদী অবস্থান করছে যুক্তরাষ্ট্রে।

ওই ডিবি কর্মকর্তা বলেন, ফরহাদকে হত্যার জন্য আশিক ও মেহেদীর সঙ্গে পরামর্শ করে রমজান তার ছোট ভাই সুজনকে নিযুক্ত করে। পরে সুজন কয়েকজন ‘শ্যুটারকে’ এক লাখ টাকা দিয়ে হত্যাকাণ্ডটি ঘটায়।

শুক্রবার ডিবি পুলিশের একটি দল রাজধানীর গুলশান ও মিরপুরের বিভিন্ন এলাকায় অভিযান চালিয়ে এই হত্যা মামলায় সন্দেহভাজন পাঁচ জনকে গ্রেপ্তার করেছে। তারা হলেন, মোহাম্মদ জাকির হোসেন, মোহাম্মদ আরিফ মিয়া, মোহাম্মদ আবুল কালাম আজাদ ওরফে অনির, মোহাম্মদ বদরুল হুদা ওরফে সৌরভ ও মোহাম্মদ বিল্লাল হোসেন ওরফে রনি। পুলিশের দাবি, গ্রেপ্তারকৃতদের কাছ থেকে চারটি পিস্তল, চারটি ম্যাগাজিন ও ১২টি বুলেট উদ্ধার করা হয়েছে। এর আগে গত ১০ জুলাই জহিরুল ইসলাম ওরফে সুজন নামের একজনকে গ্রেপ্তার করে গোয়েন্দা পুলিশ। তার কাছ থেকে পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতেই পাঁচ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়। আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছে সুজন।

সংবাদ সম্মেলনে বাতেন বলেন, নুর ইসলাম নামের একজনের সঙ্গে সৌরভ ও অনির হত্যাকাণ্ডটি ঘটায়। এর মধ্যে নুর গত ৪ জুলাই নিহত হয়েছে। নুর ও মেহেদী গ্রুপের সদস্য অমিত ওরফে দাদা অমিতের সঙ্গে পুলিশের ‘বন্দুকযুদ্ধে’ সে নিহত হয়।

ফরহাদ হত্যার তদন্তের সমন্বয়কারী গোয়েন্দা পুলিশের উপ-কমিশনার মশিউর রহমান দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, এই হত্যার ঘটনায় এখন পর্যন্ত ১৬ জনের সংশ্লিষ্টতার কথা তারা জানতে পেরেছেন। এদের মধ্যে দুজন পুলিশের সঙ্গে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত হয়েছে ও ছয়জন গ্রেপ্তার হয়েছে। তিনি আরও বলেন, হত্যায় জড়িত অন্যদের সম্পর্কেও তারা বিস্তারিত তথ্য পেয়েছেন। এদের মধ্যে বেশ কয়েকজন এখন দেশের বাইরে অবস্থান করছে। সন্দেহভাজন সবাইকে গ্রেপ্তারের চেষ্টা চালাচ্ছে আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী।

গত ৯ মে ব্যবসায়িক দ্বন্দ্বের জের ধরে খুন হন আব্দুর রাজ্জাক বাবু নামের একজন। ক্যাবল টিভির এই ব্যবসায়ী স্থানীয়ভাবে ‘ডিশ বাবু’ নামে পরিচিত ছিলেন। তার প্রায় দুই সপ্তাহ আগে ২৩ এপ্রিল কামরুজ্জামান দুখু নামের একজন খুন হন। তিনি বাড্ডা থানা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক জাহাঙ্গীর আলমের ভাই। সিমেন্ট ও জমি ব্যবসায় আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে তিনি খুন হন বলে জানা গেছে।

তদন্তকারীরা বলছেন, দুটি হত্যাকাণ্ডেরই নির্দেশ এসেছে মালয়েশিয়া থেকে।

ডিবি যুগ্ম কমিশনার বাতেন বলেন, শীর্ষ সন্ত্রাসীরা এখন যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, সুইডেন, মালয়েশিয়া ও ভারতে বসে দেশের অপরাধ জগৎ নিয়ন্ত্রণ করছে। তারা বাংলাদেশে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি তৈরির চেষ্টা করছে।

তিনি বলেন, ফরহাদকে হত্যার পর তারা আরেকজনকে হত্যার পরিকল্পনা আঁটছিল। এই অপরাধী চক্রগুলোর সব সদস্যদের অবস্থান বের করার চেষ্টা করা হচ্ছে।

সূত্রগুলো বলছে, বাড্ডায় অপরাধ জগৎ যারা নিয়ন্ত্রণ করছে তাদের মধ্যে রবিন ও ডালিম মালয়েশিয়ায়, সাখাওয়াত হোসেন চঞ্চল যুক্তরাষ্ট্রে ও নাহিদ সুইডেনে অবস্থান করছে। যুবলীগ নেতা রিয়াজুল হক খান মিল্কি হত্যার পর ২০১৩ সালে চঞ্চল দেশ ছাড়ে। আর র‍্যাবের অভিযানের মুখে ২০০৫ থেকে ২০০৮ সালের মধ্যে অন্যান্যদের মধ্যে রবিন, ডালিম ও নাহিদ বিদেশে পালায়। দেশে না থেকেও বেতনভুক্ত খুনিদের মাধ্যমে বাড্ডা এলাকায় প্রভাব বিস্তার করে রেখেছে তারা। পুলিশ সূত্রগুলো বলছে, ২০১৬ সালের এপ্রিলের পর থেকে বাড্ডা এলাকায় মোট ২১ জন খুন হয়েছেন। এদের মধ্যে অধিকাংশকেই গুলি করে হত্যা করা হয়।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের একজন উপ-কমিশনার দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘অপরাধীদের স্বর্গরাজ্যে’ পরিণত হয়েছে বাড্ডা এলাকা।

তার ভাষ্য, বিশেষ একটি এলাকায় দিবালোকে একের পর এক হত্যাকাণ্ড থেকে পরিষ্কার বোঝা যায় সেখানে আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে। হত্যাকাণ্ডের পরিকল্পনাকারীরা ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে যাওয়ায় এ ধরনের ঘটনা বন্ধ করা সম্ভব হচ্ছে না।

পুলিশ জানায়, প্রত্যেক শীর্ষ সন্ত্রাসীই তিনটি করে গ্রুপ পরিচালনা করে। প্রত্যেক গ্রুপে পাঁচ-ছয় জন সন্ত্রাসী থাকে। প্রথম গ্রুপটি সিদ্ধান্ত নেওয়ার কাজ করে। যার ওপর হামলা হবে তার সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করে দ্বিতীয় গ্রুপটি। আর তৃতীয় গ্রুপটি প্রত্যক্ষভাবে হত্যাকাণ্ড ঘটায়।

গত এক দশকের বেশি সময় ধরে এসব সন্ত্রাসীদের ওপর নজর রাখছেন এমন দুজন শীর্ষস্থানীয় পুলিশ কর্মকর্তা বলেন, হত্যার সিদ্ধান্ত নেয় যে গ্রুপটি তাদের সঙ্গে শীর্ষ সন্ত্রাসীরা মালয়েশিয়ায় বসে বৈঠক করে। অপরাধ জগতের বিভিন্ন দিক নিয়ে সেখানেই তাদেরকে নির্দেশনা দেওয়া হয়।

Comments

The Daily Star  | English

Floods cause Tk 14,421 crore damage in eastern Bangladesh: CPD study

The study highlighted that the damage represents 1.81 percent of the national budget for fiscal year (FY) 2024-25

2h ago