ভয়ঙ্কর পদ্মা, হুমকিতে নড়িয়া
পদ্মার এই ভয়ঙ্কর রূপ আগে দেখেনি শরীয়তপুরের নড়িয়া উপজেলার বাসিন্দারা। সর্বগ্রাসী পদ্মার ভাঙনে বিলীন হতে চলেছে পদ্মা সেতু নির্মাণের স্থান থেকে ২০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত এই উপজেলার বেশ কিছু ইউনিয়ন।
ভাঙনে নদী গর্ভে চলে যাচ্ছে গ্রামের পর গ্রাম। একদিন আগেও যারা সম্পদশালী ছিল রাতারাতি নিঃস্ব হয়ে যাচ্ছে তারাও।
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সানজিদা ইয়াসমিন বলেন, গত কয়েক মাসে নড়িয়া উপজেলার পাঁচ ইউনিয়নের চার হাজারের বেশি পরিবার আশ্রয়হীন হয়ে গেছে। ভয়ঙ্কর ভাঙনের ঝুঁকিতে রয়েছে উপজেলার ২০০ বছরের পুরনো বাজার মুলতাফগঞ্জ।
‘এছাড়া পাঁচ ইউনিয়নের মোক্তার চর, নড়িয়া পৌরসভার ২ নম্বর ও চার নম্বর ওয়ার্ড এবং কেদারপুরসহ ১০টি গ্রাম ঝুঁকিতে রয়েছে।’
স্থানীয়দের আশঙ্কা, পাঁচ থেকে ছয় বছর আগে পদ্মার ডান পাড়ে শুরু হওয়া এই ভাঙনে এক সময় পৌরসভা এলাকা বিলীন হয়ে যেতে পারে। মইনুদ্দীন মাতবর নামের স্থানীয় এক বাসিন্দা বলেন, নড়িয়া এই দিকটায় আগে পদ্মার ভাঙন ছিল না। কিন্তু পাঁচ থেকে ছয় বছর ধরে এটি ভাঙতে শুরু করেছে।
গত ৮ আগস্ট সন্ধ্যায় উপজেলার সাধুর বাজার লঞ্চ ঘাট ধসে পড়ে। এসময় সেখানে কাজ করছিলেন এমন ১০ জন নিখোঁজ হন।
এই নিখোঁজদের একজন হলেন গোপীনাথ। লঞ্চঘাটে তার একটি চায়ের দোকান ছিল। তার নিখোঁজের কয়েক দিন পর পদ্মায় বিলীন হয়ে যায় তার বসতভিটাও। গোপীনাথের বিধবা স্ত্রী পার্বতী যদিও জানেন তার স্বামী আর কখনও ফিরবেন না তবুও তিনি সিঁথিতে সিঁদুর নিয়ে নদীর পাড়ে অপেক্ষায় আছেন।
স্থানীয়দের দাবি, মাওয়ায় পদ্মা সেতুর জন্য নদী শাসন প্রকল্পের কাজ শুরুর পরই নদীর ডান পাড় ভাঙতে শুরু করেছে। এ বছর ভাঙন আরও বেশি হচ্ছে বলে জানান তারা।
হিমালয় থেকে উৎপন্ন গঙ্গার প্রধান শাখা পদ্মা বঙ্গোপসাগরে মিশেছে। গতিপথের দিক থেকে পৃথিবীর কয়েকটি রহস্যময় নদীর মধ্যে পদ্মা একটি। ফরিদপুর নদী গবেষণা ইন্সটিটিউটের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা স্বপন কুমার দাস বলেন, ‘আমি বলতে পারব না কেন নদীর ডান দিকে ভাঙন শুরু হয়েছে। তবে পদ্মা তার গতিপথ পরিবর্তন করেছে।’ এর কারণ জানতে খুব তাড়াতাড়ি জরিপ করা হবেও বলে জানান এই কর্মকর্তা।
বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ডের প্রকৌশলী সাইফুল ইসলাম শেখের দাবি, নদী ভাঙনের সঙ্গে নদী শাসন প্রকল্পের কোনো সম্পর্ক নেই।
ভাঙন কবলিত এলাকাগুলো ঘুরে দ্য ডেইলি স্টার প্রতিনিধি জানায়, নদী পাড়ের মানুষগুলো নির্ঘুম রাত কাটাচ্ছেন। নিজেদের বাড়ি ভেঙে অন্যত্র সরিয়ে নিচ্ছেন অনেকে। জানালার ফ্রেম, দরজা, টিনের ছাদ এমনকি কেউ কেউ ঘরের ইট খুলে সরিয়ে ফেলছেন।
মুলতাফগঞ্জ বাজারের ব্যবসায়ীরা জানান, এই বাজারে ১,৫০০ ব্যবসা প্রতিষ্ঠান রয়েছে। যার সবগুলোই এখন ঝুঁকিতে।
মুলতাফগঞ্জ বাজার ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি নূর হোসেন বলেন, এই বাজার বিলীন হলে ১০ হাজার মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
এই প্রতিবেদক যখন ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলছিলেন ঠিক তখনই উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের কাছের একটি তিনতলা ভবন ২০ সেকেন্ডের মধ্যে ধসে পড়ে।
এছাড়া চর জুরিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও পূর্ব নড়িয়া প্রাথমিক বিদ্যালয়টি ইতিমধ্যে বিলীন হয়ে গেছে। ঝুঁকিতে রয়েছে আরও ১২টি স্কুল।
এই ভাঙন রোধে সরকারের পরিকল্পনা জানতে চাইলে নির্বাহী কর্মকর্তা সানজিদা বলেন, ‘ভাঙন রোধে সরকার ১,০৯৭ কোটি টাকার প্রকল্প হাতে নিয়েছে।’
আগামী নভেম্বরেই এই প্রকল্পের কাজ শুরু হবে বলে জানান পানি উন্নয়ন বোর্ডের প্রকৌশলী সাইফুল ইসলাম।
পরিবেশ ও ভৌগোলিক তথ্য সেবা কেন্দ্রের সহকারী কার্যনির্বাহী পরিচালক মমিনুল হক সরকার বলেন, ‘ভাঙন বেড়েছে। তবে কেন ভাঙন বাড়ছে তা জরিপ ছাড়া বলা যাবে না।’
Comments