বাদী কিছুই জানেন না ‘ভূত এসে মামলা করে গেল’!

মোজাম্মেল হক চৌধুরীর গ্রেপ্তারের সংবাদ হঠাৎ করেই জানা গেল। না, তিনি খুব পরিচিত বা প্রখ্যাত কেউ নন। তিনি যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব। সংগঠন হিসেবেও যা খুব পরিচিত বা শক্তিশালী নয়।
মোজাম্মেল হক চৌধুরী। ফাইল ছবি

মোজাম্মেল হক চৌধুরীর গ্রেপ্তারের সংবাদ হঠাৎ করেই জানা গেল। না, তিনি খুব পরিচিত বা প্রখ্যাত কেউ নন। তিনি যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব। সংগঠন হিসেবেও যা খুব পরিচিত বা শক্তিশালী নয়।

এ ধরনের মানুষের গ্রেপ্তার সাধারণত সংবাদ শিরোনামে স্থান পায় না।

তার বিরুদ্ধে একটি চাঁদাবাজির মামলা হয়েছে এবং তাৎক্ষণিকভাবে পুলিশ গ্রেপ্তার করেছে। যদিও অতীত রেকর্ড বলছে না যে, মোজাম্মেল হক চাঁদাবাজ, সন্ত্রাসী বা মাস্তান। এমন কোনো অভিযোগ আগে কখনো শোনাও যায়নি।

যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব অখ্যাত একজন মোজাম্মেল হক চৌধুরীর গ্রেপ্তার প্রসঙ্গ নিয়ে কিছু কথা।

 

১. যাত্রী কল্যাণ সমিতি ও মোজাম্মেল হক চৌধুরীর কাজ বিষয়ে যাওয়ার আগে, গ্রেপ্তার ও মামলা প্রসঙ্গে আসি।

পুলিশ সূত্রে জানা গেল, দুলাল নামক একজন পরিবহন শ্রমিক মামলা করেছেন মোজাম্মেল হক চৌধুরীর বিরুদ্ধে। দুলাল মামলার অভিযোগে লিখেছেন, তার কাছে দুই লাখ টাকা চাঁদা চেয়েছেন মোজাম্মেল হক চৌধুরী।

মামলার দিন ৫ সেপ্টেম্বর রাতেই পুলিশ মোজাম্মেল হককে গ্রেপ্তার করে। ৬ সেপ্টেম্বর আদালতে হাজির করে ৭ দিনের রিমান্ড চায়। আদালত একদিনের রিমান্ডও দেয়।

গ্রেপ্তারের পরের দুই দিন দৈনিক প্রথম আলো বিষয়টি অনুসন্ধান করে যে তথ্য প্রকাশ করেছে, তা বিস্ময়ের জন্ম দিয়েছে। প্রথম আলোর সাংবাদিক কয়েক দফা কথা বলেছেন পরিবহন শ্রমিক ঢাকা চিড়িয়াখানা পরিবহনের লাইনম্যান দুলালের সঙ্গে।

দুলাল পরিষ্কার করে বলেছেন, মোজাম্মেল হক চৌধুরীকে তিনি চেনেন না। কখনো তার সঙ্গে দেখা হয়নি। দুলালের কাছে মোজাম্মেল হক যে চাঁদা চেয়েছেন, দুলাল নিজে তা জানেন না! তিনি যে মামলা করেছেন, দুলাল তাও জানেন না!

মালিক শ্রমিক ঐক্য পরিষদের মিরপুর শাখার সভাপতি আব্দুর রহিম ও সাধারণ সম্পাদক দেলোয়ার হোসেন টাইপ করা একটি সাদা কাগজে স্বাক্ষর নিয়েছেন দুলালের থেকে। সেই স্বাক্ষরই মামলার অভিযোগ হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে। যা বেরিয়ে এসেছে প্রথম আলোর অনুসন্ধানে।

রিমান্ড শেষে ৮ সেপ্টেম্বর আদালতে হাজির করে পুলিশ বলেছে, মোজাম্মেল হক একজন পেশাদার চাঁদাবাজ। তিনি পরিবহন মালিক এবং শ্রমিকদের থেকে নিয়মিত চাঁদা নিয়ে থাকেন। আরও ৭ দিনের রিমান্ড চায় পুলিশ। আদালত রিমান্ড না দিয়ে মোজাম্মেল হককে কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দেন।

পরিবহন মালিক- শ্রমিকদের প্রভাব সম্পর্কে বাংলাদেশের মানুষের ধারণা আছে। প্রথম প্রশ্ন, ওবায়দুল কাদেরের মতো মন্ত্রী যাদের কাছে অসহায়, সেই প্রভাবশালী মালিক-শ্রমিকরা একজন মোজাম্মেল হক চৌধুরীকে নিয়মিত চাঁদা দিয়ে যাচ্ছেন? পরের প্রশ্ন, যদি দিয়ে থাকেন তবে কেন দিচ্ছেন? মালিকরা কী ভয়ে চাঁদা দিচ্ছেন, না মোজাম্মেল হক চাঁদা নিয়ে মালিকদের পক্ষে কাজ করছেন?

মালিক-শ্রমিকরা মোজাম্মেল হক চৌধুরীকে ভয়ে চাঁদা দেবেন, তা বোধকরি কেউ-ই বিশ্বাস করবেন না।

এবার ধারণা নেওয়া যাক মোজাম্মেল হক চৌধুরীর কাজ সম্পর্কে।

গত ৩১ আগস্ট সংবাদ সম্মেলন করে মোজাম্মেল হক তুলে ধরেছেন কিছু তথ্য-উপাত্ত। মোজাম্মেল হক বলেছেন, গত ঈদুল আযহায় বাড়ি ফেরার পথে মোট দুর্ঘটনা ঘটেছে ২৩৭টি, মৃতের সংখ্যা ২৫৯ জন।

সংবাদ সম্মেলনে বলেন, গত তিন বছরে শুধুমাত্র ঈদুল আযহার আগে-পরে সড়কে মোট দুর্ঘটনা ঘটেছে ৫৭৯টি, মারা গেছেন ৭৮১ জন মানুষ।

ঈদুল ফিতর বা সারা বছরের দুর্ঘটনার হিসাব এখানে অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি।

২০১৬ সালে সংবাদ সম্মেলন করে তুলে ধরেছিলেন ২০১৫ সালের দুর্ঘটনার সার্বিক চিত্র। যাত্রী কল্যাণ সমিতির প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘২০১৫ সালে সারাদেশে ৬ হাজার ৫৮১টি ছোট-বড় সড়ক দুর্ঘটনা ঘটে। এতে ৮ হাজার ৬৪২ জন নিহত এবং ২১ হাজার ৮৫৫ জন আহত হন।’ (১২ জানুয়ারি ২০১৬, বিডিনিউজ২৪)

এই প্রতিবেদন সম্পর্কে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সড়ক ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেন, ‘যাত্রী কল্যাণ সমিতির রিপোর্টের বেসিসটা কী? কিভাবে তারা রিপোর্ট করে, তাদের মেকানিজমটা কী? এ সংগঠন সম্পর্কে আপনারা অনেকেই জানেন, এমন একটা ভুয়া রিপোর্ট...খোঁজ খবর নেবেন-যারা রিপোর্টটা দিল তারা কারা, আর কিছু বলব না। ডিসেন্ট ল্যাংগুয়েজে বলছি, তাদের রিপোর্ট তথ্যভিত্তিক নয়।’ (১২ জানুয়ারি ২০১৬, বিডিনিউজ২৪)

এই প্রতিক্রিয়া থেকে সরকারের মনোভাব বোঝা যায়।

চাঁদা নিয়ে তিনি মালিক- শ্রমিকদের পছন্দ অনুযায়ী তথ্য উপস্থাপন করেছেন, তার সংবাদ সম্মেলনের ভাষ্য তা বলে না।

 

২. তাহলে এই মামলা- রিমান্ডের নেপথ্যের কারণ কী হতে পারে?

যাত্রী কল্যাণ সমিতি সড়কে দুর্ঘটনা, হতাহত ও যাত্রী হয়রানির যে তথ্য তুলে ধরে, সরকার এবং পরিবহন মালিকরা তার সত্যতা স্বীকার করেন না। গণমাধ্যম আবার তাদের প্রতিবেদনের তথ্য গুরুত্ব দিয়ে প্রচার করে।

যিনি সরকারের প্রতিমন্ত্রী তিনিই পরিবহন মালিক সমিতির সভাপতি। যিনি পরিবহন শ্রমিক নেতা (প্রকৃত অর্থে তিনিও শ্রমিক নন, মালিক) তিনিই সরকারের মন্ত্রী। মন্ত্রী-মালিকদের প্রতিপক্ষে পরিণত হয়েছেন যাত্রী কল্যাণ সমিতি বা মোজাম্মেল হক চৌধুরী। কিছু তথ্য ছাড়া যার বা যাদের আর কোনো প্রভাব বা শক্তি নেই।

প্রতিপক্ষ হিসেবে তারা অনেক বেশি ‘অসম’। এই অতি ‘অসম’ প্রতিপক্ষের তথ্যকে ‘ভুয়া’ বললেও অসত্য হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করা যাচ্ছে না। দেশের মানুষের যেহেতু পরিবহন সেক্টরের নৈরাজ্য সম্পর্কে ধারণা আছে, ফলে সরকারের বক্তব্য বা অবস্থান মানুষকে প্রভাবিত করতে পারছে না। যত জোর দিয়ে ‘ভুয়া’ বলা হয়, যাত্রী কল্যাণ সমিতির তথ্যের শক্তি যেন তত বাড়ে। ফলে ‘দুর্ঘটনা কমেছে’ ‘পরিবহন সেক্টরে শৃঙ্খলা ফিরে এসেছে’ ‘মানুষ স্বস্তিতে বাড়ি ফেরে’- এসব বক্তব্য মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্য তো হয়ই না, বিরক্তিকর হয়ে ওঠে।

 

৩.  স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন, ‘বিনা অপরাধে কাউকে গ্রেপ্তার করা হচ্ছে না।...যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মোজাম্মেল হককে চাঁদাবাজির অভিযোগে গ্রেপ্তারের বিষয়টি আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তদন্ত করছে। তদন্তের আগে কোনো মন্তব্য করা সম্ভব নয়।’ (৮ সেপ্টেম্বর ২০১৮, বাসস)

সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হলো, মোজাম্মেল হকের বিরুদ্ধে চাঁদাবাজির অভিযোগে মামলা করল কে? বাদী দুলাল কিছু জানেন না, তিনি থানায় যাননি, মামলাও করেননি। মোজাম্মেল হকের আইনজীবী ব্যারিস্টার জ্যোতির্ময় বড়ুয়ার কাছে বিষয়টি জানতে চাইলে তিনি দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘ভূত এসে মামলা করে গেছে। আমরা ভূতের বিরুদ্ধে লড়ছি। যেখানে একটি সাধারণ জিডি করতেও থানায় যেতে হয়, সেখানে চাঁদাবাজির মতো গুরুতর অভিযোগে একটি মামলা হয়ে গেল, বাদীকে থানায় যেতে হলো না! ভূতের করা মামলায় পুলিশ গ্রেপ্তার করে ফেলল।’

স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন, পুলিশ তদন্ত করছে। তদন্তে নিশ্চয় সত্য বেরিয়ে আসবে?

ব্যারিস্টার জ্যোতির্ময় বড়ুয়া বলেন, ‘যে পুলিশ ভূতের মামলা নিল, আগে তো সেই পুলিশের বিরুদ্ধে তদন্ত হওয়া দরকার। মামলার বাদী ‘ভূত’ চিহ্নিত না করে পুলিশ তদন্ত করে কী সত্য বের করবে?’

মাননীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এই প্রশ্ন কি খুব স্বাভাবিক নয় যে, মামলার বাদী কে?

কার করা মামলায় আপনার পুলিশ, অতীত রেকর্ড বা অভিযোগের সত্যতা বিষয়ে সামান্যতম কোনো যাচাই ছাড়া মোজাম্মেল হককে গ্রেপ্তার করে রিমান্ডে নিল?

মামলা হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে গ্রেপ্তার, মাননীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আপনারা কি সব ক্ষেত্রে এমন করেন? এমপি বদি ‘ইয়াবা গডফাদার’ আপনার আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর রিপোর্টেও তা উল্লেখ করা হয়েছে। এক্ষেত্রে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আপনি বলেছেন, ‘অভিযোগ থাকলে হবে না, প্রমাণ হতে হবে।’

মোজাম্মেল হককে গ্রেপ্তারের ক্ষেত্রে প্রমাণ লাগল না কেন? তিনি সাধারণ মানুষের পক্ষে ন্যায্যতার কথা বলেন, এটা তো আর যাই হোক অপরাধ হতে পারে না!

হাতুড়ি দিয়ে পিটিয়ে যারা মানুষকে রক্তাক্ত করে, টেলিভিশনে সাক্ষাৎকার দিয়ে তা স্বীকার করে, তাদের ধরেন না। পরিচয় জানার পরও হেলমেট বাহিনীর কাউকে ধরেন না। কিন্তু সাধারণ মানুষের প্রতিনিধিত্ব করা একজনকে এভাবে ধরে ফেললেন! কথিত চাঁদাবাজির মামলায় গ্রেপ্তার করে, তদন্ত শেষ হওয়ার আগেই পুলিশ বলে দিল তিনি ‘পেশাদার চাঁদাবাজ’!

এভাবে মামলা নিয়ে, একজনকে গ্রেপ্তার করে, এমন মন্তব্য করতে পারে পুলিশ?

আইন কি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে এই অধিকার দিয়েছে? উত্তর দেবেন মাননীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী?

Comments

The Daily Star  | English

Abu sayed’s death in police firing: Cops’ FIR runs counter to known facts

Video footage shows police shooting at Begum Rokeya University student Abu Sayed, who posed no physical threat to the law enforcers, during the quota reform protest near the campus on July 16. He died soon afterwards.

5h ago