কী ঘটছে নির্বাচন কমিশনে?
সংবিধান নিয়ে পৃথিবীর আর কোনো দেশে সম্ভবত এত আলোচনা হয় না, যতটা হয় বাংলাদেশে। সেই সংবিধান সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে সুনির্দিষ্টভাবে ক্ষমতায়ন করেছে নির্বাচন কমিশনকে। ক্ষমতা প্রয়োগে দৃষ্টান্তস্থাপনকারী ভারতীয় নির্বাচন কমিশনের চেয়েও বেশি ক্ষমতা বাংলাদেশের নির্বাচন কমিশনের। নির্বাচন বিষয়ক বিশেষজ্ঞরা তা বিশ্লেষণ করে দেখিয়েছেন। সেই নির্বাচন কমিশন আগামী সাড়ে তিন মাস পরে যে জাতীয় নির্বাচনটি অনুষ্ঠিত হবে, তা সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করতে পারবে কি না প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। বিরোধে জড়িয়ে পড়েছেন নির্বাচন কমিশনাররা। এ প্রেক্ষিতে সংক্ষিপ্ত পর্যালোচনা।
১. ‘সুষ্ঠু নির্বাচনের নিশ্চয়তা দেওয়া সম্ভব নয়’- প্রধান নির্বাচন কমিশনার নিজে প্রকাশ্যে এ কথা বলেছেন। এ কথা বলার আগে গণমাধ্যমের চিত্র অনুযায়ী ‘সুষ্ঠু নির্বাচন নয়’- এমন নির্বাচনকে ‘চমৎকার’ নির্বাচন বলেছেন নির্বাচন কমিশনের সচিব। প্রধান নির্বাচন কমিশনারের বক্তব্যের পর কমিশনারদের মধ্যকার মতের ভিন্নতা বা বিরোধ দৃশ্যমান হতে শুরু করে। নির্বাচনে ইভিএম কেনা ও ব্যবহারকে কেন্দ্র করে ‘নোট অব ডিসেন্ট’ দিয়ে সভা বর্জন করেন নির্বাচন কমিশনার মাহবুব তালুকদার। দ্বিতীয়বার তিনি নোট অব ডিসেন্ট দিয়ে সভা বর্জন করলেন, কথা বলতে না দেওয়ার অভিযোগে।
২. বর্তমান নির্বাচন কমিশন দায়িত্ব নেওয়ার পর রাজনৈতিক দল, নাগরিক সমাজ, গণমাধ্যম ব্যক্তিত্ব, পর্যবেক্ষক সংস্থা, নারী নেত্রী, ও নির্বাচন বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে সংলাপের আয়োজন করেছিল। তার ওপর ভিত্তি করে ‘নির্বাচনী সংলাপ ২০১৭’ নামে একটি বইও প্রকাশ করেছে নির্বাচন কমিশন। কে কি মতামত বা সুপারিশ করেছিলেন বইটিতে তা তুলে ধরা হয়েছে। অদ্ভুত বিষয় হলো, সেই মতামত বা সুপারিশের কোনটা গ্রহণ করা হবে কোনটা গ্রহণ করা হবে না, তা নিয়ে কোনো পর্যালোচনা করেনি নির্বাচন কমিশন। কিছু গ্রহণ তো করেইনি।
সেই পর্যালোচনাটি কমিশনের সভায় তুলে ধরতে চেয়েছিলেন নির্বাচন কমিশনার মাহবুব তালুকদার। প্রধান নির্বাচন কমিশনারসহ অন্য তিন কমিশনার তা তুলে ধরতে দেননি। অথচ নির্বাচন কমিশনই পূর্বে তাকে বিষয়টি তুলে ধরার ব্যাপারে সম্মতি দিয়েছিল।
প্রশ্ন আসে, মতামত বা সুপারিশ যদি পর্যালোচনাই না করা হয়, তবে সংলাপের আয়োজন করা হয়েছিল কেন?
‘নির্বাচনী সংলাপ ২০১৭’ বই-ই বা প্রকাশ করা হলো কেন?
৩. ‘আগামী নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহারের কোনো পরিকল্পনা নেই’- প্রধান নির্বাচন কমিশনার বিভিন্ন সময়ে কয়েকবার এমন কথা বলেছেন। গণমাধ্যম প্রতিনিধিদের সঙ্গে সংলাপের দিনেও তার মুখ থেকে এ কথা শুনেছি। অন্যান্যদের সঙ্গে সংলাপেও তিনি এ কথা বলেছেন। কিন্তু হঠাৎ করে ‘আগামী নির্বাচনে ১০০ আসনে ইভিএম’ ব্যবহার করা হতে পারে বলে ঘোষণা দিলেন নির্বাচন কমিশন সচিব।
তারপর নির্বাচন কমিশনের বেশ কিছু স্ববিরোধী এবং অসংলগ্ন বক্তব্য বা অবস্থানের বিষয়টি দৃশ্যমান হলো।
ক. নির্বাচন কমিশন সচিব ও প্রধান নির্বাচন কমিশনার বললেন, ‘রাজনৈতিক দলগুলো রাজি থাকলে ইভিএম ব্যবহার করা হবে’।
রাজনৈতিক দলগুলো রাজি কি না, বোঝা যাবে কীভাবে?
‘রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা করা হবে’- বলল নির্বাচন কমিশন। তার আগে একাধিকবার বলেছে নির্বাচনের আগে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আর আলোচনা করা হবে না।
রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আবার সংলাপের আয়োজন করবে নির্বাচন কমিশন?
‘নির্বাচনের আগে আর রাজনৈতিক দলের সঙ্গে আলোচনা করার সুযোগ নেই’- পূর্বের বক্তব্যে ফিরে গেল নির্বাচন কমিশন! কিন্তু ইভিএম থেকে সরল না।
খ. তড়িঘড়ি করে ইভিএম ব্যবহারের জন্যে আরপিও সংশোধনের প্রস্তাব পাঠিয়েছে নির্বাচন কমিশন। ‘রাজনৈতিক দলগুলো রাজি হলে’- বিষয়টি আর তাদের এজেন্ডায় থাকল না। বলতে শুরু করল, ‘সরকার যদি আইন পাস করে দেয়, তবে কিছু আসনে ইভিএম ব্যবহার করা হবে’। পূর্বে বলেছিল ‘১০০ আসন’ তারপর বলতে শুরু করল ‘কিছু আসন’। ‘কিছু আসন’ মানে কত আসন? ১০০ আসন না ১৫০ আসন? ইভিএম কেনার পরিমাণ, তেমন ইঙ্গিতই দিচ্ছে।
গ. নির্বাচনী সংলাপে আওয়ামী লীগসহ অল্প কয়েকটি রাজনৈতিক দল ইভিএমের পক্ষে বলেছিল। বিএনপিসহ অধিকাংশ রাজনৈতিক দল বিপক্ষে বলেছিল। পর্যবেক্ষক সংস্থার দু’একজন ইভিএম ব্যবহারের কথা বলেছিলেন, রাজনৈতিক দলগুলোর সম্মতির প্রেক্ষিতে। অন্য কেউ ইভিএমের পক্ষে বলেননি। পুরো সংলাপে ইভিএম প্রসঙ্গটি আলোচনায় কোনো গুরুত্বই পায়নি।
৪. ইভিএম ব্যবহারের সিদ্ধান্ত যখন নির্বাচন কমিশন সচিব ঘোষণা দিলেন, প্রধান নির্বাচন কমিশনার ছাড়া বাকি চারজন কমিশনার বিষয়টি সম্পর্কে কিছুই জানতেন না। অথচ আইন অনুযায়ী প্রধান নির্বাচন কমিশনার একা কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারেন না। নির্বাচন কমিশন চলবে ‘কালেকটিভ সিদ্ধান্তে’। এককভাবে প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও সচিব কোনো সিদ্ধান্ত নিয়ে নিতে পারেন না। অথচ ইভিএমসহ আরও কিছু ক্ষেত্রে সেটাই হয়েছে।
৫. ইভিএম বিষয়ে নির্বাচন কমিশনের কয়েক রকমের বক্তব্য, জনমনে প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। প্রশ্ন উঠেছে ইভিএম কেনার প্রক্রিয়া নিয়েও। প্রায় ৪ হাজার কোটি টাকার কেনাকাটা। পুরো প্রক্রিয়াটি স্বচ্ছ নয়। জামিলুর রেজা চৌধুরীর কারিগরি কমিটির মতামত উপেক্ষা করা হয়েছে। যদিও বলছে, কারিগরি কমিটির মতামত অনুযায়ী ইভিএম কেনার প্রক্রিয়া চলছে। অথচ জামিলুর রেজা চৌধুরী নিজে বলছেন, আমাদের কমিটির মতামত অনুসরণ করছে না নির্বাচন কমিশন।
বিস্ময়কর রকমের বেশি দাম দিয়ে ইভিএম কিনছে নির্বাচন কমিশন।
ভারতের তুলনায় ১১ গুণ বেশি দামে ইভিএম কেনা হচ্ছে। ‘আমেরিকার চেয়ে দাম কম’- অদ্ভুত যুক্তি দেওয়ার চেষ্টা চলছে। আমেরিকার সকল গুরুত্বপূর্ণ প্রযুক্তিবিদরা যে ইভিএম ব্যবহারের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছেন, তা বিবেচনায় রাখছে না নির্বাচন কমিশন। ইউরোপের গুরুত্বপূর্ণ সব দেশ যে যুক্তিতে ইভিএম ত্যাগ করল, তাও বিবেচনায় নিচ্ছে না নির্বাচন কমিশন। ভারতসহ কিছু দেশ ইভিএম ব্যবহার করছে, সেসব দেশেও এখন তুমুল বিতর্ক চলছে।
বর্তমান পৃথিবীর প্রেক্ষাপট বিবেচনায় এটা প্রতিষ্ঠিত সত্য যে, ইভিএম নির্ভরযোগ্য কোনো প্রযুক্তি নয়। সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্যে ইভিএম বিশ্বস্ত কিছু নয়।
৬. নির্বাচনে সেনা মোতায়েনের বিষয় সহ পাঁচটি প্রসঙ্গ নিয়ে কথা বলতে চেয়েছিলেন মাহবুব তালুকদার। বর্তমান আইনশৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর ‘গায়েবি’ মামলার প্রেক্ষাপট আরও বেশি প্রাসঙ্গিক হয়ে পড়েছে সেনা মোতায়েনের বিষয়টি।
‘সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব নয়’- কেন সম্ভব না, সে কারণেই নির্বাচন কমিশনের সক্ষমতা বৃদ্ধির বিষয়টি আলোচনা হওয়া দরকার ছিল।
‘নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক হলে কারচুপি বা প্রশ্ন ওঠার সুযোগ কমে যায়’- এ বক্তব্য প্রধান নির্বাচন কমিশনারেরও। নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক করার জন্যে নির্বাচন কমিশনের আরও কী করার আছে, তা নিয়ে আলোচনা জরুরি বিষয় হওয়ার কথা।
সংসদ বহাল থাকলে ‘সবার জন্যে সমান সুযোগ’ তৈরি হবে না। সুষ্ঠু নির্বাচনের স্বার্থে বিষয়টি আলোচনা করবে না নির্বাচন কমিশন?
নির্বাচন কমিশনের ওপর সরকারের গভীর আস্থা। নির্বাচনকালীন যে সরকার তারাও রুটিন কাজ ছাড়া অন্য কিছু করবে না। আগের নির্বাচনগুলোতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও প্রশাসনের কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে নির্বাচন কমিশনের নির্দেশ না মানার অভিযোগ এসেছিল। ফলে নির্বাচনকালীন সরকারের সময়ে জনপ্রশাসন ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় নির্বাচন কমিশনের অধীনে আনার বিষয়টি তো অপ্রাসঙ্গিক হওয়ার কথা নয়। নির্বাচন কমিশনাররা তা আলোচনা করতে পারবেন না নিজেদের সভায়?
৭. নির্বাচন কমিশনারদের মধ্যে মতের ভিন্নতা দেখা দেওয়া অস্বাভাবিক বিষয় নয়। আলোচনা- পর্যালোচনা করে সিদ্ধান্ত নেওয়ার সুযোগ সব সময়ই থাকে। অর্থাৎ পাঁচজন কমিশনারের মধ্যে তিনজন একমত হলে সেটাই সিদ্ধান্ত হবে। কিন্তু এটা তো জনগণের ভোটের গণতন্ত্র নয়। এটা জনগণের গণতান্ত্রিক অধিকার নিশ্চিত করার বিষয়। এখানে পাঁচ জনের মধ্যে একজন যদি যৌক্তিক কথা বলেন, সংখ্যা গরিষ্ঠতার জোরে তা বাতিল করে দেওয়া ভালো দৃষ্টান্ত নয়।
পূর্বে বলে, কয়েকদিন পর ‘বলিনি’ বা স্ববিরোধী অবস্থান, প্রশ্নবিদ্ধ আর্থিক কেনাকাটা, দেশের সবচেয়ে শক্তিশালী সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানের জন্যে সম্মানজনক নয়। নিজেরা বিবাদে জড়িয়ে পড়া লজ্জাজনক অক্ষমতার প্রকাশ।
Comments