শিশু হত্যার বিক্ষোভে কেন বসুন্ধরা আর কাঁপছে না

'নারীর প্রতি সহিংতা প্রতিরোধ পক্ষ' শুরুর দিনই আমরা খবর পেলাম ৫ বছর বয়সী এক শিশুকে টুকরো টুকরো করে কেটে সাগরে ভাসিয়ে দেওয়া হয়েছে। শুধু এই খবর কেন, প্রতিদিনই এমন সব লোমহর্ষক ঘটনার খবর সংবাদমাধ্যমে দেখছি। এসব খবর আমাদেরকে নতুন করে আতঙ্কিত করছে, শিহরিত করছে, অবাক করছে, ব্যথিত করছে। কষ্টে কুঁকড়ে যাচ্ছি, কিন্তু এত নিরুপায় যে, কিছুই করতে পারছি না। সত্যি করে বললে বলতে হয়, কিছু যেন করতে চাইছিও না।

নিত্যদিন এমন অনেক শিশু নিহত হচ্ছে, নির্যাতিত হচ্ছে, যৌন হয়রানির শিকার ও ধর্ষণ হচ্ছে। কয়েক বছর আগে যেমনটা হয়েছিল দিনাজপুরের ৫ বছর বয়সী ছোট্ট শিশুর সঙ্গে। অবুঝ শিশুটিকে এমনভাবে ধর্ষণ করা হয়েছিল যে তার পুরো যৌনাঙ্গ ছিঁড়ে গিয়েছিল। বহু কষ্টে সে বেঁচে আছে, খুব কষ্ট করে ওর চিকিৎসা চলছে।

এ দেশের ধনী মানুষ, নাগরিক সমাজের বরেণ্য ব্যক্তিত্ব, বড় শিল্পী, তারকা, খেলোয়ার, বেসরকারি সংস্থা ও করপোরেটগুলো কী করছে বা কতটুকু করছে? দিবস পালনের মধ্যে সীমাবদ্ধ নারী নির্যাতন বিরোধী আন্দোলন ও সংগ্রাম। সম্মিলিতভাবে কোটি টাকা খরচ করছি বিভিন্ন অনুষ্ঠান, আলোচনা, টিভি টক শো, ব্যানার, ফেষ্টুন, মঞ্চ সজ্জায় বা ফ্যাশান প্যারেড আয়োজনে।

সেদিন দেখলাম নারীর ক্ষমতায়নের প্রোগ্রামে কয়েক কোটি টাকা ব্যয়ে আন্তর্জাতিক তারকা নোহা ফাতহিকে আনা হয়েছিল। সব আয়োজনই শিশু ও নারীর নিরাপত্তার জন্য, অথচ কোনোটাই শিশু বা নারীর জীবনের এই অঘটন ও ক্লেশগুলোকে স্পর্শ করতে বা সারিয়ে তুলতে পারে না।

ধর্ষণের পর জীবন নিয়ে শঙ্কায় থাকা ওই শিশুটিকে বিদেশে উন্নত চিকিৎসার জন্য পাঠাতে পারেন এমন কেউ নেই এ দেশে? কত টাকা এহাত-ওহাত হয়ে যাচ্ছে, বিদেশে পাড়ি জমাচ্ছে। বেসরকারি সংস্থাগুলো কত আয়োজনের মাধ্যমে নারী দিবস, প্রতিরোধপক্ষ পালন করছে, করপোরেটগুলোও ফুল দিয়ে নারীদের শুভেচ্ছা জানাচ্ছে। কিন্তু এমন কাউকে পাওয়া যায় না, যে বা যারা শিশু নির্যাতিত হলে আইনি সহায়তা, চিকিৎসা সহায়তা ও কাউন্সিলিং সহায়তা দেবে। আছে খুব হাতেগোণা কিছু মানুষ বা সংস্থা, প্রয়োজনের তুলনায় যা খুবই অপ্রতুল।

সম্প্রতি এক বন্ধু আকুতি জানিয়ে বলেছেন, একটা নারী দিবস শুধু ওই শিশুর চিকিৎসায় ব্যয় হোক, একটা উদাহরণ তৈরি হোক। একটা নারীর প্রতি সহিংসতা প্রতিরোধ পক্ষ শুধু নিহত শিশুটির জন্য হোক, অপরাধীর বিচার নিশ্চিত হোক এই ১৫ দিনের মধ্যেই। কোটি শিশু নিরাপদে বাঁচুক।

৫ বছরের শিশুটি যেদিন হারিয়ে গেল, সেদিন থেকেই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তার খোঁজে বিজ্ঞাপণ ও অনুরোধ চোখে পড়েছিল। মনে মনে তীব্রভাবে প্রার্থনা করছিলাম, শিশুটি যেন বাবা-মায়ের কোলে ফিরে যায়। হ্যাঁ, সত্যিই সে ফিরে এসেছে, কিন্তু ৬ টুকরা লাশ হয়ে। এতটুকু একটি দেহ কীভাবে কেটে এতগুলো টুকরা করলো অপরাধী? ভাবতেই পারছি না তার বাবা-মা কীভাবে একমাত্র সন্তান হারানোর এই শোক সহ্য করবেন?

১৯ বছর বয়সী তরুণ আবির আলী ভারতীয় টিভি সিরিয়াল 'ক্রাইম পেট্রল' আর 'সিআইডি' দেখে যে লোমহর্ষক অপরাধ কৌশল শিখেছে, সেটারই প্রয়োগ করেছে ওই ছোট্ট শিশুটির উপর। বাড়িওয়ালার ছোট্ট মেয়েটিকে সে মুক্তিপণ আদায়ের জন্য অপহরণ করলেও শেষ পর্যন্ত হত্যা করেছে। সে এক বাসায় শ্বাসরোধ করে মেয়েটিকে হত্যা করে। সেই লাশ প্যাকেটে মুড়িয়ে আরেক বাসায় নিয়ে কেটে ৬ টুকরা করে। এরপর আলাদা-আলাদা প্যাকেটে ভরে ৩টি টুকরো ফেলে সাগরে আর নালায়।

এই ভয়াবহ ঘটনা আমাদের মনে কতগুলো প্রশ্ন সৃষ্টি করেছে। শিশুটিকে হত্যার এই প্রক্রিয়ার কথা শুনে মনে হচ্ছে, কেন দেশে দিন দিন শিশু, কিশোর ও তরুণদের মধ্যে বীভৎসতা দানা বাঁধছে? কেন পরিচিত মানুষের হাতেই শিশুরা নিহত হচ্ছে বা যৌন হয়রানির শিকার হচ্ছে? কেন পারিবারিক পরিবেশেও শিশু নিরাপদ নয়? কেন নারী শিশুর অধিকার ও নিরাপত্তার প্রশ্নটি শুধু দিবস পালনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকছে?

আইন ও সালিশ কেন্দ্রের হিসাব অনুযায়ী, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে অক্টোবর পর্যন্ত ৪৩৯টি শিশুকে হত্যা করা হয়েছে। তাদের মধ্যে ১০৪ জনের বয়স ৬ বছরের নীচে, ৭৯ জনের বয়স ৭ থেকে ১২ বছরের মধ্যে। ৯৭৫ জন শিশুর ওপর নানা ধরনের সহিংসতা হয়েছে। এগুলো শুধু পত্রিকায় প্রকাশিত খবরের হিসাব। বাস্তবে এই সংখ্যা আরও অনেক বেশি।

শিশুর প্রতি অপরাধ করছে কারা? করছে তার চারপাশে বসবাসকারী পরিচিতরাই। তাদের হাত থেকে ছোট্ট মানুষগুলো পালিয়ে বাঁচতে পারে না। শিশু হত্যাকারী, শিশুকে যৌন নিপীরণকারীদের মধ্যে সবাই আছে। শিশুর পরিবার-পরিজন, আত্মীয়-স্বজন, পাড়া-প্রতিবেশি, পারিবারিক বন্ধু, সবাই। রক্ষকরাই ভক্ষক হয়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশে জন্মের পর থেকেই একটি শিশু ত্রাসের পরিবেশে এসে পড়ছে।

কেন বাড়ছে শিশুর প্রতি অপরাধ? সমাজের বড় একটা অংশ ক্রমেই অপরাধী হয়ে উঠছে, মাদকসেবীর হার বাড়ছে, দুর্নীতি, অপরাধ ও অর্থের প্রতি মানুষের লোভ বাড়ছে, পরিবারের মধ্যে বিভেদ-ব্যবধান বাড়ছে, নৈতিক মূল্যবোধ নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। আর এর সব প্রভাব প্রথমেই গিয়ে পড়ছে শিশুদের উপর। অন্যায় দাবি আদায়ের, সম্পত্তি হাতিয়ে নেওয়ার, মুনাফা লাভের, এমনকি যৌন সুখের অস্ত্র হিসেবে শিশুকে ব্যবহার করা হচ্ছে।

হত্যার দায়ে অভিযুক্ত আবির আলীর জন্ম ও বেড়ে ওঠা  নিহত শিশুটিরই বাবার বাড়িতেই, ভাড়াটিয়া হিসেবে। শিশুটি তাকে 'চাচ্চু' বলে সম্বোধন করত। ২ পরিবারের মধ্যে দীর্ঘদিনের ঘনিষ্ঠতা, যাতায়াত। এই আবিরই শিশুটিকে কোলে তুলে নিয়ে একটি ঘরে ঢুকে গলা টিপে হত্যা করেছে।

আমরা আগেও দেখছি, শিশুদের যারা ক্ষতি করে, শিশুদের যারা হত্যা করে, তাদের প্রায় সবাই ওই শিশুর পরিচিত মুখ। আমরা শিশুদের সবসময় অপরিচিত মানুষের কাছ থেকে নিরাপদ থাকার পরামর্শ দেই, সাবধান থাকতে বলি। কিন্তু একবারও পরিচিতজন সম্পর্কে সতর্ক থাকার পরামর্শ দেই না। আর তাই খুব সহজেই আবিরের মতো পরিচিত কেউ ঘরের ছোট্ট শিশুকে কোলে তুলে নিতে পারে এবং হত্যাও করতে পারে।

শিশু বিশেষজ্ঞরা বলেন, যখন শিশুর প্রতি কোনো অপরাধ করা হয়, তখন শতকরা ৯০ ভাগ ক্ষেত্রে শিশু ও তার পরিবার অপরাধীকে চেনে। তারা বলেন, ৭ থেকে ১৩ বছরের শিশুরা সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত হয়ে থাকে। কারণ তারাই সবচেয়ে অবুঝ এবং পরিচিতদের বিশ্বাস করে।

যৌন হয়রানির বা শিশুর প্রতি অপরাধের ঘটনা সাধারণত ঘটে বাড়িতে, আত্মীয় বা পারিবারিক বন্ধুদের বাড়িতে, স্কুলে, স্কুলে যাওয়ার পথে, পরিচিত পরিবেশে। পরিচিত জন ছাড়া শিশুদের যৌন হয়রানির ঘটনার নজির খুবই কম। তাই পারিবারিক সুরক্ষা সবার আগে প্রয়োজন। শিশুকে পরিবারের কোনো বন্ধু-বান্ধব, আত্মীয়ের বাসা, পরিচিতদের কাছে, গৃহকর্মী বা ড্রাইভারের কাছে একা রাখা উচিত না। মোট কথা, যতদূর সম্ভব শিশুকে বাবা-মায়ের তত্ত্বাবধানে তাদের দৃষ্টির মধ্যে রাখতে হবে। শিশুকে নজরের বাইরে রাখা একদমই নিরাপদ নয়।

আসি আরেকটি প্রসঙ্গে। অনেকেই প্রশ্ন করেন, প্রতিবাদ ও মৃত্যুদণ্ডের বিধান থাকার পরেও কেন দেশে ধর্ষণের হার বাড়ছে? বিচার প্রক্রিয়ার দীর্ঘসূত্রিতা, নানাধরনের আর্থ-রাজনৈতিক-সামাজিক প্রভাব এবং কিছু ক্ষেত্রে আইন প্রয়োগকারীর সংস্থার সদিচ্ছার অভাব এজন্য দায়ী। এমনকি ভুক্তোভোগী ও স্বাক্ষীকে সুরক্ষা দেওয়ারও কোনো আইন বাংলাদেশে নেই। এই কারণে কোনো মামলা দায়েরের পরে নির্যাতিত শিশু, নারী ও সাক্ষী অসহায় বোধ করেন।

একটি করে শিশু খুন হয়, একটি করে শিশুকে ধর্ষণ করা হয়, একজন করে নারীকে অসম্মানিত করার ঘটনা ঘটে আর আমরা স্তম্ভিত হয়ে যাই, কষ্ট পাই, ক্ষোভ প্রকাশ করি। কিন্তু এসব ঘটনার সুরাহা হয় না বা অবস্থার কোনো পরিবর্তন ঘটে না। কারণ পরিবর্তন ঘটানোর মতো কোনো ব্যবস্থা সরকার ও সরকারের বাইরের কেউ যথাযথভাবে গ্রহণ করে না।

হত্যা, ধর্ষণ, অপহরণ— এসব খবর সংবাদমাধ্যমে দেখতে দেখতে আমরা যতোই কষ্ট পাই না কেন, তাতে অভ্যস্তও হয়ে যাই। বেশিদিন এই শোক বয়েও বেড়াতে পারি না। প্রতিদিনের জীবনযুদ্ধ, সংসারের টানাটানি, নানান সমস্যা ও ব্যক্তিগত কষ্টে অধিকাংশ মানুষ এতই জর্জরিত থাকেন যে, এইসব মর্মান্তিক ঘটনা খুব বেশিদিন মনেও রাখতে পারেন না। আর সমাজের যে শ্রেণী চাইলেই কিছু করতে পারেন, তারা কিন্তু বাংলাদেশের শিশুদের ভবিষ্যৎ নিয়ে একদম ভাবলেষহীন। তারা ভাবেন, শুধু যেন তাদের সন্তান থাকে দুধে ভাতে।

আমাদের শিশুদের রক্ষায় সরকার, সুশীল সমাজ, বেসরকারি সংস্থা সবাই মিলে যে উদ্যোগ গ্রহণ করে, প্রয়োজনের তুলনায় তা খুবই অপ্রতুল। সবচেয়ে বড় কথা, শিশু নির্যাতন ইস্যুতে প্রতিষ্ঠানগুলোর পক্ষ থেকে দায়বদ্ধতা নেই। শিশু নিহত হলে বা তাদের ধর্ষণ করা হলে সেই দায় যেন শুধু শিশুর পরিবারের।

বাংলাদেশ কি শিশুদের জন্য কিছুই করেনি? করেছে, অনেক কিছুই করেছে। বাংলাদেশ ১৯৮৯ সালে শিশু অধিকার সনদে সই করেছে, সফলভাবে শিশুমৃত্যুর হার কমিয়েছে, টিকা দিয়েছে, শিশুর খর্বকায়ত্ব কমিয়েছে, শিশুদের বিদ্যালয়ে ভর্তির হার বাড়িয়েছে এবং বাল্যবিয়ে ঠেকানোর চেষ্টা করেছে।

কিন্তু এতগুলো বছরেও শিশু-কিশোরদের জন্য নিরাপদ সমাজ গড়ে তুলতে পারেনি। আগেও বলেছি, আবারও বলছি, সব অর্জন ফিকে হয়ে যায়, যখন আমি আর আমার সন্তান নিরাপত্তাহীন থাকি।

দেশ যতোই আধুনিক হোক বা অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি অর্জন করুক বা উন্নত বিশ্বের কাতারে নাম লেখানোর স্বপ্ন দেখুক, তাতে ভুক্তোভোগী শিশুদের বাবা-মা ও পরিবার এবং এমন আরও অসংখ্য পরিবারের কিছুই আসবে যাবে না।

শিশু অধিকার সনদে সই করার পর কেটে গেছে ৩৩ বছর। আমরা যখন ঝলমলে আয়োজনে শিশু অধিকার সপ্তাহ বা নারীর প্রতি সহিংতা প্রতিরোধ পক্ষ বা অন্য কোনো দিবস পালন করছি, তখনই হয়তো কোনো শিশুকে কেটে টুকরো করা হচ্ছে বা কোনো ছোট্ট শিশুকে ধর্ষণ করা হচ্ছে এই দেশে, এই মাটিতে।

শাহানা হুদা রঞ্জনা, সিনিয়র কোঅর্ডিনেটর, মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন

(দ্য ডেইলি স্টারের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির আইনগত, মতামত বা বিশ্লেষণের দায়ভার সম্পূর্ণরূপে লেখকের, দ্য ডেইলি স্টার কর্তৃপক্ষের নয়। লেখকের নিজস্ব মতামতের কোনো প্রকার দায়ভার দ্য ডেইলি স্টার নেবে না।)

Comments

The Daily Star  | English

Beyond development paradox & unnayan without democracy

As Bangladesh seeks to recalibrate its path in the aftermath of recent upheavals, the time is ripe to revisit an oft-invoked but under-examined agenda: institutional reform. Institutions are crucial to understand, as they are foundational for governance, transformation, and economic development.

16h ago