টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ ২০০৯: সন্ত্রাসবাদ ছাপিয়ে ক্রিকেটের জয়
টি-টোয়েন্টি ক্রিকেট তখনও পৌঁছায়নি জনপ্রিয়তার শীর্ষে। তবে ২০০৭ সালে অনুষ্ঠিত এই সংস্করণের উদ্বোধনী বিশ্বকাপ দাগ কেটেছিল ভক্তদের হৃদয়ে। ফলে দুই বছর পর আবারও বসে চার-ছক্কায় ভরপুর ক্রিকেটের বিশ্ব আসর। সেই আয়োজনে শিরোপার মুকুট মাথায় তোলে পাকিস্তান, পেছনে ফেলে দুঃসময়কে। উঠতি দলগুলোর কাছে বড় দলগুলোর হার ছিল ওই বিশ্বকাপের একটি তাৎপর্যপূর্ণ দিক। আর রিকি পন্টিং, মাইক হাসিদের শক্তিশালী অস্ট্রেলিয়া সেবার পেরোতে পারেনি গ্রুপ পর্বই।
ইংল্যান্ডের মাটিতে ২০০৯ টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ আয়োজিত হয়েছিল জুনে। সে বছরের মার্চেই ঘটে যায় ক্রিকেট ইতিহাসের এ যাবৎকালের সবচেয়ে কলঙ্কিত ঘটনা। লাহোরে শ্রীলঙ্কা দলের গাড়িবহরে হামলা চালায় সন্ত্রাসীরা। এতে গুরুতর আহত হন ৬ লঙ্কান ক্রিকেটার। এই হামলা নিষেধাজ্ঞার খড়গ বয়ে আনে পাকিস্তান ক্রিকেটের ওপর। দীর্ঘদিন আন্তর্জাতিক ক্রিকেট আলোর মুখ দেখেনি দেশটির মাটিতে।
দেশের ক্রিকেটের এমন দুর্দিনে ইউনুস খান, শহিদ আফ্রিদি, মিসবাহ উল হকদের শিরোপাজয় ছিল পাকিস্তান ভক্তদের হৃদয়ের ক্ষতে শ্রেষ্ঠ প্রলেপ। কাকতালীয়ভাবে ফাইনালে তাদের সামনে পড়ে সেই শ্রীলঙ্কাই। তিলকরত্নে দিলশান, সনাথ জয়সুরিয়া, মাহেলা জয়াবর্ধনে, কুমার সাঙ্গাকারাদের তারকাখচিত দলকে হারিয়ে শেষ হাসি হাসে পাকিস্তান।
উদ্বোধনী ম্যাচেই আন্ডারডগ নেদারল্যান্ডসে ধরাশায়ী হয় ইংল্যান্ড। তৎকালীন সময়ে টি-টোয়েন্টিতে '১৬২' রান বিবেচিত হতো নিরাপদ সংগ্রহ হিসেবেই। তবে সবাইকে চমকে দিয়ে ইংলিশদের দেওয়া ১৬৩ রানের লক্ষ্য আইসিসি সহযোগী সদস্য ডাচরা ছুঁয়ে ফেলে ৪ উইকেট হাতে রেখেই। আসরের তৃতীয় ম্যাচে অস্ট্রেলিয়াকে হেসে খেলে হারায় ক্রিস গেইলের ওয়েস্ট ইন্ডিজ। ইউনিভার্স বস ও আন্দ্রে ফ্লেচারের তাণ্ডবে অজিদের ১৬৯ রানও একদম সাদামাটা মনে হয়েছিল।
এরপর ভারতের বিপক্ষে বাংলাদেশের ও দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে স্কটল্যান্ডের হারটা ছিল অনুমিতই। বিশ্বকাপের তৃতীয় দিনে নিজেদের প্রথম ম্যাচে মাঠে নামে শেষ পর্যন্ত চ্যাম্পিয়ন হওয়া পাকিস্তান। সেদিন ঘুরে দাঁড়ায় স্বাগতিক ইংল্যান্ড, রান পাহাড়ে চাপা দিয়ে তারা রুখে দেয় প্রতিপক্ষকে। তেমনটা অবশ্য করে দেখাতে পারেনি ইংলিশদের চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী অস্ট্রেলিয়া। শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে বাঁচা-মরার ম্যাচে হেরে খালি হাতে বিদায় নেয় পন্টিংবাহিনী।
গ্রুপ পর্বে দক্ষিণ আফ্রিকা-নিউজিল্যান্ড ম্যাচটি লো স্কোরিং হলেও ছিল উত্তেজনায় ঠাসা। ১ রানের রুদ্ধশ্বাস জয় নিয়ে মাঠ ছাড়ে প্রোটিয়ারা। আগের বিশ্বকাপের মতোই দুই ফাইনালিস্ট পাকিস্তান ও শ্রীলঙ্কা পরস্পরের মুখোমুখি হয় দুবার। প্রথম দেখায় সুপার এইটের ম্যাচে বিজয় কেতন ওড়ায় লঙ্কানরা। একই দিনে সুপার এইটের অপর ম্যাচে ভারতকে হারায় উইন্ডিজ।
শেষ পর্যন্ত সেমির লড়াইয়ে জায়গা করে নেয় পাকিস্তান, দক্ষিণ আফ্রিকা, শ্রীলঙ্কা ও ওয়েস্ট ইন্ডিজ। প্রোটিয়াদের বিপক্ষে জিততে পাকিস্তানকে অনেক ঘাম ঝরাতে হলেও সহজ জয় পায় শ্রীলঙ্কা। দিলশানের অনবদ্য ৯৬ রানে আগে ব্যাট করে ১৫৮ রানের সংগ্রহ পায় লঙ্কানরা। জবাবে মাত্র ১০১ রানে অলআউট হয়ে যায় ক্যারিবিয়ানরা।
২১ জুনের ফাইনালে জ্বলে উঠেছিলেন পাকিস্তানি বোলারদের সকলেই। লঙ্কানদের মাত্র ১৩৮ রানে বেঁধে ফেলতে ৩ উইকেট নিয়ে সামনে থেকে নেতৃত্ব দেন অলরাউন্ডার আব্দুল রাজ্জাক। জবাবে আফ্রিদির অপরাজিত ৫৪ ও কামরান আকমলের ৩৭ রানের ইনিংসে ৮ উইকেটের বিশাল জয় পায় পাকিস্তান। বল হাতে ৪ ওভারে মাত্র ২০ রান দিয়ে ১ উইকেট শিকার ও ব্যাট হাতে ফিফটির সুবাদে ফাইনালের ম্যাচসেরা হন আফ্রিদি।
আসরের সেরা খেলোয়াড় নির্বাচিত হন রানের ফোয়ারা ছোটানো দিলশান। তিন ফিফটিতে ৩১৭ রান করে সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহকও ছিলেন এই লঙ্কান ওপেনার। শুধু তাই নয়, সেমিতে উইন্ডিজের বিপক্ষে তার অপরাজিত ৯৬ রানই ছিল আসরের সর্বোচ্চ ব্যক্তিগত সংগ্রহ। সর্বোচ্চ দলীয় সংগ্রহের (২১১/৫) কীর্তিটা ধরে রাখতে সক্ষম হয়েছিল দক্ষিণ আফ্রিকা। স্কটল্যান্ডের বিপক্ষে এই কীর্তি গড়েছিল তারা।
বোলারদের মধ্যে সবচেয়ে উজ্জ্বল ছিলেন পাকিস্তানের খেলোয়াড়রাই। ১৩ উইকেট নিয়ে আসরের সর্বোচ্চ উইকেট শিকারি হন পেসার উমর গুল। আর আসর জুড়েই কিপটে বোলিং করে নেপথ্যের নায়ক ছিলেন আফ্রিদি। সব মিলিয়ে বিরুদ্ধ পরিস্থিতিতে আফ্রিদি-গুলদের শিরোপা জয়ে আনন্দের বন্যা বয়ে যায় পাকিস্তানে। সাধারণ জনগণ উল্লাসে মাতে ইসলামাবাদের রাস্তায় রাস্তায়। জয় হয় ক্রিকেটের, ফেভারিটের তালিকায় নাম না থাকলেও শিরোপা উঁচিয়ে ধরে পাকিস্তানই।
Comments